গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
রাজনৈতিক দলগুলিকে অনুদান দেওয়ার ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদী সরকারের চালু করা নির্বাচনী বন্ডের ব্যবহারে কোনও অস্বচ্ছতা রয়েছে কি না, সে বিষয়ে বৃহস্পতিবার গুরুত্বপূর্ণ রায় দিতে পারে সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ গত ২ নভেম্বর এ সংক্রান্ত মামলার শুনানি শেষে রায় সংরক্ষিত রেখেছিল।
নির্বাচনী বন্ড প্রকল্পের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে দায়ের হওয়া মামলাগুলির শুনানিতে গত নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছিল, নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে কারা শাসক দলকে আর্থিক সাহায্য করছে, সেই তথ্য গোপন রাখা গেলেও একই প্রকল্পে বিরোধীদের পাওয়া টাকার সূত্র প্রকাশ পেয়ে যেতে পারে। সেই সঙ্গে ‘রাজনৈতিক দলগুলোর আর্থিক অনুদানের উৎস সম্পর্কে ভোটারের কিছুই জানার অধিকার থাকতে পারে না’— মোদী সরকারের ওই যুক্তিও খারিজ করে দিয়েছিল শীর্ষ আদালত।
প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ওই বেঞ্চে রয়েছেন বিচারপতি সঞ্জীব খন্না, বিচারপতি বিআর গাভাই, বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্র। গত ২ নভেম্বরের শুনানিতে কেন্দ্রীয় সরকারের হয়ে সওয়াল করতে গিয়ে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা জানান, বর্তমান ব্যবস্থায় অনুদানদাতা এবং অনুদানপ্রাপ্ত দল উভয়েই জানে দেওয়া-নেওয়ার কথা। বিচারপতি খন্না তখন মন্তব্য করেন, ‘‘শুধু ভোটারই জানেন না! এটা মেনে নেওয়া একটু কঠিন! সবটা খুলে দিচ্ছেন না কেন?’’
প্রসঙ্গত, ভোটে কালো টাকার খেলা বন্ধ করার কথা বলে নির্বাচনী বন্ড চালু করেছিল মোদী সরকার। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন ২০১৮ সালে প্রয়াত অরুণ জেটলি নির্বাচনী বন্ডের কথা ঘোষণা করেছিলেন। ২০১৭-র অর্থ বিলের মাধ্যমে আইনে একগুচ্ছ সংশোধনী এনে মোদী সরকার ২০১৮ থেকে নির্বাচনী বন্ড চালু করেছিল। এর ফলে কোনও ব্যক্তি বা কর্পোরেট সংস্থা রাজনৈতিক দলগুলিকে চাঁদা দিতে চাইলে, বন্ড কিনে সংশ্লিষ্ট দলকে দিতে হবে। ১ হাজার, ১০ হাজার, ১ লক্ষ, ১০ লক্ষ এবং ১ কোটি টাকা মূল্যের বন্ড পাওয়া যাবে। রাজনৈতিক দলগুলি নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে সেই বন্ড ভাঙিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু কে, কত টাকা দিচ্ছেন তা বোঝা যাবে না।
নির্বাচনী বন্ড চালু হওয়ার পর বিষয়টির স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। বিরোধী দল এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করেন, এতে অস্বচ্ছতাই বাড়বে। বিশ্বের কোনও দেশেই এমন ব্যবস্থা নেই, বন্ড ভাঙাচ্ছে রাজনৈতিক দল। ফলে কোন কর্পোরেট সংস্থা কাকে ভোটে সাহায্য করছে, তার বিনিময়ে ক্ষমতাসীন দলের থেকে কী সুবিধে আদায় করছে, তা জানার কোনও উপায় নেই।
তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন বন্ড-বিরোধীরা। তাঁদের দাবি, কেন্দ্র এবং অধিকাংশ রাজ্যে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে নির্বিবাদে অর্থ আমদানির কার্যত ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ করে ফেলতে চাইছে গেরুয়া শিবির। আর সে কারণেই তারা নির্বাচনী বন্ড চালু রাখতে মরিয়া। প্রায় ৫ বছর ধরে সুপ্রিম কোর্টে ঝুলে থাকা মামলা চলাকালীন ৫ জন প্রধান বিচারপতি এসেছেন। প্রতি বারেই মোদী সরকারের বন্ড-প্রীতি স্পষ্ট হয়েছে শীর্ষ আদালতে।
পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, মূলত ১০ লক্ষ টাকা ও ১ কোটি টাকার বন্ড কেনা হচ্ছে। যা থেকে স্পষ্ট, কর্পোরেট সংস্থাগুলিই রাজনৈতিক দলকে চাঁদা দিয়ে সুবিধা আদায় করতে চাইছে। আর সেই চাঁদা পাওয়ার নিরিখে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। অন্য দিকে, সরকারের যুক্তি, চাঁদা কারা দিচ্ছেন, তা প্রকাশ করতে গেলে এত দিনের মতো নগদে, কালো টাকার লেনদেনই হবে। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি গড়িয়েছে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চে।