Manipur Violence

‘সংবিধান ভেঙে পড়েছে’, মণিপুরকাণ্ডে সুপ্রিম-মন্তব্য, প্রকাশ্যে এল এক নিগৃহীতার লজ্জার বিবরণ

সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া মণিপুরের ভিডিয়ো ঘিরে উত্তাল দেশ। ছবিটি ৪ মে তোলা বলে দাবি মণিপুর পুলিশের। নির্যাতিতার দাবি, পুলিশের কাছে অভিযোগ জানানো হলেও পদক্ষেপ করা হয়নি। 

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০২৩ ১১:৪১
SC directs Centre and Manipur government to take immediate steps and apprise it on what action has been taken on assault of two women

গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ

গোষ্ঠীহিংসা দীর্ণ মণিপুরে দুই মহিলাকে বিবস্ত্র করে রাস্তায় ঘোরানোর ঘটনার ভিডিয়ো (যার সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন) এবং গণধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে এ বার কড়া প্রতিক্রিয়া জানাল সুপ্রিম কোর্ট। বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ অবিলম্বে এ নিয়ে কেন্দ্র এবং মণিপুর সরকারের রিপোর্ট তলব করেছে। সেই সঙ্গে প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের হুঁশিয়ারি, ‘‘বিষয়টি নিয়ে আমরা গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন। এ বিষয়ে সরকার কোনও পদক্ষেপ না করলে আদালত স্বতঃপ্রণোদিত পদক্ষেপ করতে বাধ্য হবে।’’ শুক্রবার আবার এই মামলার শুনানি হবে শীর্ষ আদালতে।

বুধবার সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া মণিপুরের ওই ভিডিয়ো ঘিরে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে দেশ জুড়ে। ছবিটি গত ৪ মে তোলা বলে দাবি মণিপুর পুলিশের। থৌবল জেলায় নংপোক সেকমাই থানার অদূরে ওই দুই মহিলার উপর হামলা হয় বলে অভিযোগ। যদিও একটি সংগঠনের দাবি, ঘটনাটি কঙ্গপকপি জেলার। বিরোধীদের দাবি, ঘটনার কয়েক দিন পরেই এ নিয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানানো হলেও কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি।

Advertisement

দুই নির্যাতিতার এক জন ইতিমধ্যেই গত ৪ মের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। তাঁর দাবি, খুনের ভয় দেখিয়ে দুষ্কৃতীরা সে দিন তাঁদের জনসমক্ষে পোশাক খুলতে বাধ্য করেছিল। সেই ঘটনা নিয়ে গত ১৮ মে কঙ্গপকপি জেলার বি ফাইনম গ্রামের প্রধানের সাহায্যে ওই জেলারই সাইকুল থানায় অভিযোগ জানিয়েছিলেন নির্যাতিতা। দায়ের করেছিলেন, ‘জ়িরো এফআইআর’। প্রসঙ্গত, ‘সাধারণ এফআইআর’ বলে, ঘটনাস্থল যে থানা এলাকায়, এফআইআর দায়ের করতে হবে সেখানেই। কিন্তু ‘জ়িরো এফআইআর’ যে কোনও থানায় দায়ের করা যায়। অপরাধের ঘটনা যে থানার এলাকাতেই ঘটুক না কেন। ওই থানা অভিযোগ তখন সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠিয়ে দেয়। অর্থাৎ, এই ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে নির্যাতিতা বা তাঁর পরিবারের লোকেদের ঘটনাস্থলের থানায় যেতে হয় না।

২১ বছরের ওই মহিলা বলেছেন, ‘‘দুষ্কৃতীদের অনেকের হাতে একে-৪৭, ইনসাস, এসএলআর-সহ আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। গ্রামে ঢুকে তারা নির্বিচারে বাড়িতে আগুন ধরায়, গুলি চালায়। আমরা পাঁচ জন— তিন মহিলা এবং দু’জন পুরুষ (নির্যাতিতার বাবা এবং ভাই) দৌড়ে পাশের জঙ্গলে ঢুকে পড়ায় তখনকার মতো বেঁচে গিয়েছিলাম।’’

নির্যাতিতা মহিলা বলেন, ‘‘পরে নংপোক সেকমাই থানা থেকে পুলিশকর্মীরা গিয়ে আমাদের উদ্ধার করেন। কিন্তু থানায় ফেরার পথে রাস্তায় দুষ্কৃতীরা আমাদের ঘিরে ফেলেন।’’ তিনি জানান, তিন মহিলাকে খুনের ভয় দেখিয়ে জোর করে বিবস্ত্র করানো হয়। এমনকি, তাঁকে গণধর্ষণ করা হয় বলেও জানিয়েছেন ওই মহিলা। বলেছেন, তাঁর বাবা এবং ভাইকে খুন করেছিল হামলাকারী জনতা। বলেন, ‘‘আমার ৫৬ বছরের বাবাকে প্রথমেই খুন করা হয়। আমাকে বাঁচাতে গিয়ে ভাইও নিহত হয়।’’ তবে হামলাকারীদের মধ্যে কয়েক জন অন্য দুই মহিলার পরিচিত হওয়ায় তাঁরা ধর্ষণ থেকে রেহাই পেয়েছিলেন বলে ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম ‘দ্য কুইন্ট’-কে জানিয়েছেন নির্যাতিতা মহিলা।

ঘটনাটি বি ফাইনম গ্রামের অদূরে থৌবল জেলায় নংপোক সেকমাই থানার দু’কিলোমিটার দূরে তৌবু গ্রামের পাশে ঘটেছিল। বিষয়টি নিয়ে সাইকুল থানায় ‘জ়িরো এফআইআর’ দায়ের করে খুন, ধর্ষণ-সহ একাধিক অভিযোগ এনেছিলেন তিনি। অভিযোগ আনা হয়েছিল ৮০০ থেকে ১০০০ জন অজ্ঞাতপরিচয় সশস্ত্র দুষ্কৃতীর বিরুদ্ধে। কিন্তু সমাজমাধ্যমে ভিডিয়ো ছড়িয়া না-পড়া পর্যন্ত পুলিশ কোনও পদক্ষেপ করেনি বলে অভিযোগ।

তবে বুধবার ওই ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পরেই ‘সক্রিয়’ হয়েছে বিজেপি শাসিত মণিপুরের পুলিশ। সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহ বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন ঘটনার মূল অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে। টুইটারে তিনি লিখেছেন, ‘‘ঘটনার তদন্ত চলছে। অপরাধীদের যাতে মৃত্যুদণ্ডের সাজা হয়, তা নিশ্চিত করব আমরা।’’ পুলিশ জানিয়েছে, ধৃত ব্যক্তি থৌবল জেলার বাসিন্দা।

প্রসঙ্গত, গত ৩ মে জনজাতি ছাত্র সংগঠন ‘অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন অফ মণিপুর’ (এটিএসইউএম)-এর কর্মসূচি ঘিরে অশান্তির সূত্রপাত হয়েছিল উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ওই বিজেপি শাসিত রাজ্যে। মণিপুর হাই কোর্ট মেইতেইদের তফসিলি জনজাতির মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে রাজ্য সরকারকে বিবেচনা করার নির্দেশ দিয়েছিল। এর পরেই কুকি, জ়ো-সহ বিভিন্ন জনজাতি গোষ্ঠীর সংগঠনগুলি তার বিরোধিতায় পথে নামে। আর সেই ঘটনা থেকেই হিংসার সূচনা হয় সেখানে।

গোষ্ঠীহিংসার সূচনা পর্বেই দুই মহিলা গণধর্ষণ এবং হিংসার শিকার হলেও ৭৭ দিন পরে কেন পুলিশ সক্রিয় হল, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। এখনও পর্যন্ত মণিপুরে গোষ্ঠীহিংসায় প্রায় দু’শো মানুষের মৃত্যু ঘটেছে এবং ৬০ হাজারের বেশি মানুষ গৃহহীন হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বুধবার বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা এবং নিষ্ক্রিয়তা মণিপুরকে নৈরাজ্যের দিকে নিয়ে গিয়েছে।’’

গত আড়াই মাস ধরে মণিপুরের ধারাবাহিক হিংসা নিয়ে মুখ না খুললেও বৃহস্পতিবার দুই মহিলাকে নির্যাতনের ঘটনার নিন্দা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বাদল অধিবেশনে যোগ দিতে সংসদ ভবন চত্বরে পৌঁছে তিনি বলেন, ‘‘মণিপুরের ঘটনা যে কোনও সভ্য সমাজের পক্ষে লজ্জার। ওই ঘটনার জন্য দেশের ১৪০ কোটি মানুষের মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছে।’’ দুই মহিলাকে বিবস্ত্র করে হাঁটানোর ঘটনায় তিনি ব্যথিত এবং ক্রুদ্ধ বলেও জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে মণিপুরের পাশাপাশি কংগ্রেস শাসিত রাজস্থান এবং ছত্তীসগঢ়ের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের বার্তা দেন তিনি।

Advertisement
আরও পড়ুন