সংসদের পুরনো ভবনে অধিবেশনের শেষ দিনে বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই।
বিরোধীদের অভিযোগ, সংসদে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বক্তৃতায় থাকে তাঁর নিজের এবং সরকারের প্রচার, সেই সঙ্গে বিরোধীদের আক্রমণ। জনসভায় ভাষণের থেকে আলাদা কিছু হয় না লোকসভায় মোদীর বক্তৃতা। কিন্তু আজ সংসদের পুরনো ভবনে অধিবেশনের শেষ দিনে কিছুটা ভিন্ন পথে হেঁটে রাষ্ট্রনেতার ভূমিকায় নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা করলেন মোদী। একাধিক বার উল্লেখ করলেন জওহরলাল নেহরুর ভূমিকা। স্মরণ করলেন ইন্দিরা গান্ধী, নরসিংহ রাওয়ের কথা। ভারতের ৭৫ বছরের যাত্রায় সবার ভূমিকা রয়েছে সে কথাও উঠে এল তাঁর বক্তৃতায়। কিন্তু সেই সঙ্গে নিজস্ব ভঙ্গিতে বারবার কংগ্রেসকে খোঁচা মারতেও ছাড়লেন না তিনি। তুললেন জরুরি অবস্থার প্রসঙ্গ। সব প্রধানমন্ত্রীর উল্লেখ করলেও নামোচ্চারণ করলেন না রাজীব গান্ধীর। সনিয়া গান্ধীর প্রতি সরাসরি অভিযোগ হেনে বললেন বিজেপি জমানায় ‘খুবই মসৃণ ভাবে’ উত্তরাখণ্ড, ঝাড়খণ্ড এবং ছত্তীসগঢ় তৈরি করা গেলেও তেলঙ্গানা তৈরির সময় ‘খুনের নদী’ বয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের উল্লেখে তিনি টেনে আনলেন ২০০৮ সালে কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ, অনাস্থা ভোটে জেতার জন্য ‘ক্যাশ ফর ভোট’ কেলেঙ্কারিকে।
কংগ্রেস সূত্রে এই চারটি দিক নিয়েই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। কংগ্রেস সভাপতি তথা রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা মল্লিকার্জুন খড়্গে তাঁর বক্তৃতায় সরাসরি ওই চার বিষয় নিয়ে মুখ না খুললেও, মোদীকে নিশানা করে বলেছেন, “নেহরু মনে করতেন, মজবুত বিরোধী না থাকার অর্থ গোটা ব্যবস্থায় খামতি রয়েছে। এখন বিরোধী মজবুত হলে তাকে সিবিআই, ইডি পাঠিয়ে দুর্বল করার চেষ্টা হয়। কারও বিরুদ্ধে মামলা থাকলে তাদের দলে টেনে ওয়াশিং মেশিনে ফেলে সাফ করে নেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী এখন সংসদে কখনও সখনও আসেন। এলেও ‘ইভেন্ট’ তৈরি করে চলে যান।’’
বক্তৃতার শুরুতে খুবই আবেগঘন শুনিয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে। নিজের চা বিক্রির কাহিনীও তুলে এনেছেন তিনি গণতন্ত্রের নিদর্শন হিসাবে। বলেন, “আমি যখন প্রথম সাংসদ নির্বাচিত হই ও প্রথম বারের জন্য সংসদে প্রবেশ করি, তখন প্রবেশদ্বারে প্রণাম করে গণতন্ত্রের এই মন্দিরে পা রেখেছিলাম। সেই মুহূর্তটিতে আমি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। ভারতের গণতন্ত্রের শক্তি এবং নাগরিকদের প্রতিশ্রুতি ও প্রশংসার কারণেই রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে বসবাসকারী একটি দরিদ্র পরিবারের ছেলে সংসদে পৌঁছেছিল।”
মুদ্রার এ-পিঠ ও-পিঠের মতো একই সঙ্গে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদান এবং জরুরি অবস্থা জারি করার প্রসঙ্গ তুলতে দেখা গিয়েছে আজ মোদীকে। বলেছেন, “বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের সমর্থনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। আমরা গণতন্ত্রের উপর হামলা হতে দেখেছি জরুরি অবস্থার সময়।“ গান্ধী নেহরু পরিবারের বাইরের কংগ্রেসী প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের প্রশংসা করে মোদী বলেন, “নরসিংহ রাওয়ের সরকার সাহস দেখিয়ে নতুন নীতি নিয়েছিলেন, যার সুফল আজ দেশ পাচ্ছে।” কিন্তু পরিবারের বাইরের আর এক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের জমানার উল্লেখ করেন তিনি অশ্রদ্ধার সঙ্গেই। তাঁর কথায়, “মনমোহন সিংহ সরকারের সময়ে আমরা ‘ভোট ফর ক্যাশ’ কাণ্ড দেখেছি।”
আরও একটি বিষয়ে বিরোধীদের সমালোচনা করে মোদী বলেন, “দুর্ভাগ্যজনক ভাবে অনেক সময় আলোচনার মাঝে রাজনীতি চলে আসে। অনেক বিষয়ে হাততালি পাওয়ার কথা, কিন্তু বিরোধীরা তা দেন না। সংসদ ও গণতন্ত্রের জয়যাত্রায় নেহরুর যোগদানের প্রসঙ্গ উঠলে কে হাততালি দেবেন না?” নেহরুর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “অনেক কারণেই পণ্ডিতজিকে স্মরণ করা উচিত। তার মধ্যে একটি ‘অ্যাট দ্য স্ট্রোক অব মিডনাইট’— নেহরুজির এই বক্তব্য আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে।”
অন্য দিকে মল্লিকার্জুন খড়্গে আজ নেহরুর সঙ্গে মোদীর তুলনা টেনে মোদী জমানায় কি ভাবে বিরোধীদের দমন করা হচ্ছে, মোদী কি ভাবে সংসদকে গুরুত্বহীন করে দিতে চাইছেন তা ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর বক্তৃতায়।