Coromandel Express accident

করমণ্ডল দুর্ঘটনায় মালগাড়ি নিয়ে নানা মত, মুখোমুখি সংঘর্ষ, না কি পিছন থেকে ধাক্কা? রেলের দাবি ও বাস্তব

ওড়িশার বালেশ্বরে করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার কারণ এখনও স্পষ্ট নয়। যেমন স্পষ্ট নয় ওই বিষয়ে রেলের বক্তব্যও। শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ ঠিক কী ঘটেছিল, তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। যে রহস্য খুব দ্রুত কাটবে বলে মনে হচ্ছে না।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
বালেশ্বর শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০২৩ ১৫:০৫
photo of Coromandel Express Accident

মালগাড়ির উপর উঠে গিয়েছে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন। ছবি: পিটিআই।

মালগাড়ির উপর উঠে গিয়েছে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন। যেন একতলা বাড়ির নীচের তলার উপর দোতলা। পাশে খেলনা গাড়ির মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে যাত্রিবাহী অন্য দু’টি ট্রেনের কামরা। শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ ওড়িশার বালেশ্বরে ট্রেন দুর্ঘটনার পর এই ছবি প্রকাশ্যে এসেছে। কী ভাবে দুর্ঘটনা ঘটল, তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। সরকারি ভাবে শনিবার বিকেল পর্যন্ত কিছু জানানো হয়নি। গোটা দুর্ঘটনায় লাইনে দাঁড়িয়ে-থাকা মালগাড়িটির ভূমিকা নিয়েও রেলের তরফে একপ্রকার ‘লুকোচুরি’ খেলা শুরু হয়েছে। রেলের একাধিক সূত্রে দাবি করা হচ্ছে, সংঘর্ষে মালগাড়ির কোনও ভূমিকাই নেই।

শুক্রবার রাতেই বোঝা গিয়েছিল। শনিবার ভোরের আলো ফোটার পর দুর্ঘটনাস্থলের যে সমস্ত ছবি দেখা গিয়েছে, তাতে সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক হল মালগাড়ির নীল রঙের ওয়াগনের একেবারে উপরে করমণ্ডলের ইঞ্জিনের উঠে যাওয়া। যা করমণ্ডল এক্সপ্রেস এবং মালগাড়িটি একই লাইনে না থাকলে সম্ভব নয়। ছবিতে এটা আরও স্পষ্ট যে, করমণ্ডলের সঙ্গে মালগাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটেনি। কারণ, মালগাড়ির পিছনের অন্তত পাঁচটি ওয়াগন অতিক্রম করে ষষ্ঠ ওয়াগনের উপর করমণ্ডলের ইঞ্জিনটি চেপে বসেছে। তবে রেলের তরফে মুখোমুখি সংঘর্ষ তো বটেই, একই লাইনে করমণ্ডল এক্সপ্রেস এবং মালগাড়ি থাকার তত্ত্বও উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বস্তুত, দুর্ঘটনার খবর আনুষ্ঠানিক ভাবে জানাতে গিয়ে কোনও মালগাড়ির কথা উল্লেখই করেনি রেল! অথচ, ছবিতে এবং খোলা চোখেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রেললাইনের উপর মালগাড়িটির অস্তিত্ব।

Advertisement

বালেশ্বরে কী ভাবে দুর্ঘটনা ঘটল, তা নিয়ে নানা বিবরণ পাওয়া গিয়েছে। কেউ দাবি করছেন, করমণ্ডল এক্সপ্রেস তীব্র গতিতে গিয়ে ধাক্কা মারে একই লাইনে আগে আগে চলতে-থাকা একটি মালগাড়ির পিছনে। দুর্ঘটনার অভিঘাতে করমণ্ডলের ইঞ্জিনটি মালগাড়ির উপরে উঠে যায়। করমণ্ডলের কামরাগুলি পাশের লাইনে ছিটকে পড়ে। সেই লাইন দিয়ে তখন আসছিল ডাউন বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস। করমণ্ডলের লাইনচ্যুত কামরাগুলির সঙ্গে সংঘর্ষে হাওড়াগামী সেই ট্রেনটিরও দু’টি কামরা লাইনচ্যুত হয়। আবার রেলের দাবি, মালগাড়ির সঙ্গে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের কোনও সংঘর্ষ হয়ইনি। কোনও কারণে প্রথমে আপ করমণ্ডল এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয়। সেটি গিয়ে পড়ে পাশের ডাউন লাইনে। সেই লাইন ধরে তখন আসছিল ডাউন বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস। সেটি এসে ধাক্কা মারে করমণ্ডলের লাইনচ্যুত কামরাগুলিকে। সেই ধাক্কার কারণেই করমণ্ডলের ইঞ্জিনটি তৃতীয় লাইনে দাঁড়িয়ে-থাকা মালগাড়ির উপরে উঠে যায়।

শনিবারও রেলের তরফে জানানো হয়েছে, শালিমার-চেন্নাই করমণ্ডল এক্সপ্রেসের সঙ্গে বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসের পাশাপাশি ধাক্কা লেগেছে। তাতেই করমণ্ডল এক্সপ্রেসের কিছু কামরা লাইনচ্যুত হয়ে পাশের লুপ লাইনে দাঁড়ানো মালগাড়ির দিকে হেলে পড়ে। মালগাড়ির ওয়াগনগুলির সঙ্গে করমণ্ডলের লাইনচ্যুত কামরাগুলির পাশাপাশি ধাক্কা লাগে (সাইড ড্যাশ)। কিন্তু পাশাপাশি ধাক্কা লাগলে কী ভাবে করমণ্ডলের ইঞ্জিন মালগাড়ির ওয়াগনের উপর উঠে পড়ল, আপাতদৃষ্টিতে তার কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা মিলছে না। এই ব্যাপারে অবশ্যে বিশদে জানায়নি রেল। দক্ষিণ-পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক আদিত্য চৌধরি আনন্দবাজার অনলাইনকে স্পষ্টই বলেছেন, ‘‘কোনও মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়নি। দু’টি ট্রেনের পাশাপাশি ধাক্কা লাগার ফলে দুর্ঘটনা ঘটেছে।’’

বালেশ্বরে দুর্ঘটনার পর রেলের ‘কবচ’ প্রযুক্তি নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে। অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক সিস্টেমে নকশা-করা একটি স্বয়ংক্রিয় ট্রেন সুরক্ষা পদ্ধতির পোশাকি নাম ‘কবচ’। পরিভাষায় বলা হয় ‘অটোমেটেড ট্রেন প্রোটেকশন সিস্টেম’। ওই ‘কবচ’ প্রযুক্তি ট্রেনে-ট্রেনে সংঘর্ষ রোধ করতে পারে। কিন্তু ‘কবচ’ পদ্ধতি তখনই কাজ করবে, যখন সংশ্লিষ্ট দু’টি ট্রেনেই ওই পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে। একটি ট্রেনে তা থাকলে সংঘর্ষ রোখার ক্ষমতা ওই প্রযুক্তির নেই। করমণ্ডলে কি ‘কবচ’ পদ্ধতি ছিল? দক্ষিণ পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক জানিয়েছেন, করমণ্ডল এক্সপ্রেস এবং বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস— দু’টি ট্রেনেই ‘কবচ’ পদ্ধতি ছিল না।

তা হলে কি ওই প্রযুক্তি না থাকার কারণেই দুর্ঘটনা ঘটল? আদিত্যের জবাব, ‘‘কোনও মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়নি। তাই কবচ পদ্ধতি থাকলেও তা কাজ করত না।’’ রেলের সুরক্ষা যন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। শনিবার দুর্ঘটনাস্থল ঘুরে দেখার পরে মমতা বলেন, ‘‘পরিস্থিতি খুবই খারাপ। সংঘর্ষ এড়ানোর যন্ত্র ছিল না। থাকলে দুর্ঘটনা ঘটত না।’’

ট্রেনের এই ‘কবচ’ পদ্ধতি প্রসঙ্গে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে রাজ্যসভায় এক প্রশ্নের লিখিত জবাব দিয়েছিলেন রেলমন্ত্রী। তিনি জানিয়েছিলেন, দক্ষিণ-পূর্ব রেলের ১,৪৪৫টি রুটে ইতিমধ্যে পর্যায়ক্রমে ‘কবচ’ কার্যকর হয়েছে। ৫ মাস আগে রেলমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘এখন দিল্লি-মুম্বই এবং দিল্লি-হাওড়া করিডরে (৩,০০০ কিলোমিটার) কাজ চলছে।’’ কেন পর্যায়ক্রমে ওই কাজ হচ্ছে? জবাবে রেলমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, এমন অত্যাধুনিক ব্যবস্থা কার্যকর করার মতো সব রেলপথ জুতসই নয়। তাই আগে রেলপথের আধুনিকীকরণ করতে হচ্ছে। তার পরে সংঘর্ষরোধী অত্যাধুনিক ওই ‘সিস্টেম’ কার্যকর করা যাবে। সে জন্য ধাপে ধাপে কাজ চলছে। সেই কাজ এখন কতটা এগিয়েছে, তা অবশ্য ঠিকঠাক কেউই বলতে পারছেন না। ওই পদ্ধতি নিজে হাতেকলমে পরীক্ষা করে দেখেছিলেন রেলমন্ত্রী। সেই ভিডিয়ো গত মার্চ মাসে টুইট করেছিলেন তিনি।

আরও পড়ুন
Advertisement