এ বার ডিজিটাল গ্রেফতারির ফাঁদে মুম্বইয়ের বৃদ্ধা। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন। গ্রাফিক সহায়তা: এআই
এখনও পর্যন্ত দীর্ঘতম ‘ডিজিটাল গ্রেফতারি’র ঘটনা ঘটল মুম্বইয়ে! দক্ষিণ মুম্বইয়ের বাসিন্দা ৭৭ বছর বয়সি এক বৃদ্ধাকে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ডিজিটাল হেফাজতে রাখার বাহানায় তাঁর থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে কয়েক কোটি টাকা!
পুলিশ সূত্রে খবর, প্রতারিত বৃদ্ধার বয়স ৭৭ বছর। তাঁর দুই সন্তান বিদেশে থাকেন। দক্ষিণ মুম্বইয়ের একটি আবাসনে অবসরপ্রাপ্ত স্বামীর সঙ্গে থাকেন তিনি। গত সেপ্টেম্বর মাসে একটি অচেনা নম্বর থেকে তাঁর হোয়াট্সঅ্যাপ নম্বরে একটি ফোন আসে। অপর প্রান্ত থেকে নিজেকে পুলিশ বলে দাবি করে এক পুরুষকণ্ঠ জানায়, তাইওয়ানে পাঠানো বৃদ্ধার একটি পার্সল বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। তাতে মিলেছে পাঁচটি পাসপোর্ট, একটি ব্যাঙ্কের এটিএম কার্ড, বেশ কিছু কাপড় এবং মাদক। বৃদ্ধা জানান, তিনি এমন কোনও পার্সল পাঠাননি! কিন্তু তাঁকে বলা হয়, আধার কার্ডের নম্বরের মাধ্যমে তাঁকে শনাক্ত করা হয়েছে।
এর পর ফোনকলটি মুম্বই পুলিশের এক ‘আধিকারিক’-এর কাছে স্থানান্তরিত করা হয়। ওই আধিকারিকও ছিলেন ভুয়ো। ভিডিয়ো কলের মাধ্যমে ওই বৃদ্ধাকে ‘ডিজিটাল গ্রেফতার’ করেন ওই আধিকারিক। এখানেই শেষ নয়! এর পর এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চলে প্রতারণা। ওই এক মাসে বৃদ্ধার সঙ্গে বিভিন্ন ‘আধিকারিক’-এর কথা হয়। নিজেকে আইপিএস আনন্দ রানা হিসাবে পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি চেয়ে নেন তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের বিশদ বিবরণ। এর পর ফোন করেন আর এক ‘আইপিএস’ জর্জ ম্যাথিউ। তিনি বৃদ্ধাকে নির্দিষ্ট একটি অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে বলেন। বলা হয়, নির্দোষ প্রমাণিত হলে গোটা টাকাটাই ফেরত পাবেন তিনি। দফায় দফায় এক মাস ধরে ছ’টি অ্যাকাউন্টে প্রায় তিন কোটি ৮০ লক্ষ টাকা পাঠান ওই বৃদ্ধা। কিন্তু টাকা ফেরত আসেনি। এর পরেই বৃদ্ধা বুঝতে পারেন, প্রতারিত হয়েছেন তিনি।
ঘটনায় তদন্ত শুরু করেছে পুলিশের সাইবার অপরাধ দমন শাখা। ওই ছ’টি অ্যাকাউন্টে লেনদেন বন্ধ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে চার আধিকারিককে নিয়ে একটি বিশেষ তদন্তকারী দলও গঠন করা হয়েছে। উল্লেখ্য, গত কয়েক মাস ধরেই ডিজিটাল গ্রেফতারির একাধিক ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। একের পর এক সাইবার প্রতারণা ঠেকাতে নড়েচড়ে বসেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। যে অ্যাকাউন্টগুলি থেকে এই ধরনের সাইবার প্রতারণার কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে, তার বেশ কয়েকটি চিহ্নিত করে ব্লক করা হয়েছে। এমন প্রায় ১৭ হাজার অ্যাকাউন্টের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।
নামে গ্রেফতার শব্দটি থাকলেও গ্রেফতারির সঙ্গে ‘ডিজিটাল গ্রেফতারি’-র দূরদূরান্তেও কোনও সম্পর্ক নেই। এটি আসলে সাইবার প্রতারণার একটি ফাঁদ। অনলাইনে জালিয়াতিচক্রের নতুন ‘অস্ত্র’ হয়ে উঠেছে এটি। এখানে প্রতারকেরা সিবিআই, নারকোটিক্স শাখা, আরবিআই, ট্রাই, শুল্ক এবং আয়কর আধিকারিক হিসাবে নিজেদের পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষকে ফোন করেন। এর পর ওই ব্যক্তি কিংবা তাঁর পরিজনদের কারও বিরুদ্ধে গুরুতর কোনও অভিযোগের কথা বলে তাঁকে ভয় দেখানো হয়। এক বার ফাঁদে পা দিলেই ‘ডিজিটাল গ্রেফতার’ করা হয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সাইবার শাখা সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রতি দিন ‘ডিজিটাল গ্রেফতারি’র মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সাইবার অপরাধীরা। কেন্দ্রীয় সরকারের সাইবার অপরাধ নথিভুক্তির পোর্টাল (এনসিআরপি)-র তথ্য অনুসারে গত কয়েক বছরে সাইবার অপরাধের প্রবণতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে ৭ লাখ ৪০ হাজার অভিযোগ জমা পড়েছে। ২০২৩ সালে গোটা বছরে অভিযোগ জমা হয়েছিল সাড়ে ১৫ লাখের কিছু বেশি। ২০২২ সালে অভিযোগ জমা পড়েছিল সাড়ে ৯ লাখের কিছু বেশি। ২০২১ সালে ছিল তা ছিল সাড়ে ৪ লাখ। গত তিন বছরের পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যায়, উদ্বেগ কতটা গুরুতর।
সরকারি হিসাব অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে ১২০ কোটি ৩০ লাখ টাকার ‘ডিজিটাল গ্রেফতার’ হয়েছে। এ ছাড়া ওই একই সময়ের মধ্যে লগ্নির টোপ দিয়ে প্রতারণা হয়েছে ২২২ কোটি ৫৪ লাখ টাকার।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে দেশবাসীকে সতর্ক করেন। বলেন ‘ডিজিটাল গ্রেফতারি’ বলে কিছু হয় না। দেশের কোনও আইনে এই ধরনের গ্রেফতারির কথা বলা নেই। তিনি দেশবাসীকে সাবধান করে বলেছিলেন, “ডিজিটাল গ্রেফতারির জালিয়াতি থেকে সতর্ক থাকুন। আইনে এই ধরনের কোনও কিছুর উল্লেখ নেই। তদন্তের জন্য কোনও সরকারি সংস্থা কখনওই আপনার সঙ্গে ফোনে বা ভিডিয়ো কলে যোগাযোগ করবেন না।”
অযথা ভয় না পেয়ে মাথা ঠান্ডা রেখে ফোনকলটি রেকর্ড করার পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী। সম্ভব হলে ‘স্ক্রিন রেকর্ড’ করার কথাও বলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে জানান, কোনও সরকারি তদন্তকারী সংস্থা অনলাইনে কাউকে ধমক বা হুমকি দেয় না। পাশাপাশি যখনই এই ধরনের কোনও ঘটনা ঘটবে, তা ন্যাশনাল সাইবার হেল্পলাইনে ফোন করে জানানোর পরামর্শ দেন মোদী। হেল্পলাইন নম্বরটি হল ১৯৩০। পাশাপাশি স্থানীয় থানাতেও এ বিষয়ে অভিযোগ জানানোর পরামর্শ দেন তিনি।