গ্রাফিক— আনন্দবাজার অনলাইন
যে স্যালাইন ঘিরে এত বিতর্ক, সেটি আসলে কী? কেনই বা এত আতঙ্ক?
সরকারি হাসপাতালে স্যালাইন থেকে প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনায় হইচই রাজ্য জুড়ে। কলকাতা হাই কোর্টেও এ নিয়ে মামলা দায়ের হয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলি বাতিল করতে শুরু করেছে ‘পশ্চিম বঙ্গ ফার্মাসিউটিক্যালস’-এর তৈরি একটি নির্দিষ্ট ব্যাচের রিঙ্গার্স ল্যাকটেট স্যালাইন। সোমবার সকাল থেকে কলকাতার হাসপাতালগুলির বাইরে বাক্সবন্দি বাতিল স্যালাইনের ‘পাহাড়’ জমতে শুরু করেছে। যা দেখে কিছুটা আতঙ্কিত চিকিৎসা করাতে আসা রোগীরাও। অনেকেরই মনে প্রশ্ন উঠছে, বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা ওই স্যালাইন আসলে কী? তা কাদেরই বা দেওয়া হয়? স্যালাইন থেকেই রোগীর মৃত্যু হচ্ছে কি? সেই সব প্রশ্ন নিয়েই চিকিৎসকদের দ্বারস্থ হয়েছিল আনন্দবাজার অনলাইন। জবাবে তাঁরা সবিস্তার বলেছেন স্যালাইন বিতর্কের নেপথ্যকথা।
রিঙ্গার্স ল্যাকটেট স্যালাইন আদতে কী?
রিঙ্গার্স ল্যাকটেট হল এমন একটি স্যালাইন, যা রোগীর শরীরে ফ্লুইড বা জলের অভাব হলে দেওয়া হয়। পূর্ব বর্ধমানের উপমুখ্য জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিক চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী বলছেন, ‘‘রিঙ্গার্স ল্যাকটেট একটি অত্যন্ত কার্যকর স্যালাইন। এবং ভালও। দীর্ঘ দিন ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যেটি নিয়ে সমস্যা, সেটি একটি বিশেষ সংস্থার তৈরি বিশেষ ব্যাচের ওষুধ।’’ একই কথা বলছেন মধ্য কলকাতার একটি হাসপাতালের ক্রিটিকাল কেয়ারের চিকিৎসক সব্যসাচী সেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘শরীর থেকে ফ্লুইড কমে গেলে রোগীকে সুস্থ করার জন্য যে সব উপাদানের প্রয়োজন হয়, তা সব স্যালাইনে মজুত থাকে না। রিঙ্গার্স ল্যাকটেটে প্রয়োজনীয় উপাদানগুলি থাকে বলে আমরা সেটিই ব্যবহার করি।’’
রিঙ্গার্স ল্যাকটেট কাদের দেওয়া হয়?
সাধারণত ডায়েরিয়ার রোগীদের শরীরেই যে হেতু ফ্লুইড কমে যাওয়ার সমস্যা তৈরি হয়, তাই তাঁদেরই ওই স্যালাইন দেওয়া হয়। এ ছাড়া, প্রসূতিদের বা যে কোনও রোগীরই যদি নিম্ন রক্তচাপের সমস্যা থাকে, শরীরে জলের অভাব হয় বা ট্রমা অথবা অস্ত্রোপচারের জন্য শরীরে ফ্লুইড কমে যায়, তবে তাঁদের রিঙ্গার্স ল্যাকটেট দেওয়া হয়।
স্যালাইন থেকেই কি মৃত্যু?
মেদিনীপুরের মেডিক্যাল কলেজে ছ’জন প্রসূতিকে ‘পশ্চিম বঙ্গ ফার্মাসিউটিকালস’-এর তৈরি একটি বিশেষ ব্যাচ (২৩৯৬) নম্বরের স্যালাইন দেওয়ার পরে তাঁরা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ। তাঁদের মধ্যে এক জনের পরে মৃত্যুও হয়। এর পরেই জানা যায়, স্যালাইনের গুণমান বজায় রাখা এবং জীবাণুমুক্ত করার যে প্রক্রিয়া, তাতে ওই নির্দিষ্ট ব্যাচের স্যালাইনটি উতরোয়নি। সে কথা জানিয়েছিল সেন্ট্রাল ড্রাগ কন্ট্রোল অর্গানাইজ়েশন নামে ওই রাজ্যের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা। তাঁরা ওই সংস্থার ওই ব্যাচের স্যালাইন তৈরির কাজ স্থগিত রাখতেও বলে। কিন্তু তার পরেও সেই স্যালাইন এসে পৌঁছয় মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে। চিকিৎসক সুবর্ণবাবু বলছেন, ‘‘ভেজাল ওষুধ থেকে যে সব সময় মৃত্যু হবে, তা নিশ্চিত নয়। তবে ভেজাল ওষুধ শরীরে প্রবেশ করে প্রতিকূলতা তৈরি করলে, তা থেকে মৃত্যু হতে পারে।’’ মেদিনীপুরের ঘটনায় তেমনটাই হয়েছে বলে মনে করছেন সুবর্ণ। তিনি বলছেন, ‘‘একটি মৃত্যু প্রকাশ্যে এসেছে। কিন্তু এর আগেও অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। হয়তো তখন বোঝা যায়নি সেটা স্যালাইনের জন্য। হয়তো আরও মৃত্যুও হয়ে থাকতে পারে। হিসাব করলে সেটা প্রকাশ্যে আসবে।’’
সতর্ক হবেন কি?
রোগীকে কী স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে, সাধারণ মানুষের পক্ষে তা বোঝা সম্ভব নয় বলেই মনে করেন চিকিৎসক সব্যসাচী। তিনি বলছেন, ‘‘সাধারণ মানুষের কথা তো ছেড়েই দিন, আমরা চিকিৎসকেরাও জানতে পারি না কোনও স্যালাইনের উপর স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছে কি না বা সেটি গুণমানের পরীক্ষায় পাশ করেছে কি না। এটি সম্পূর্ণ ভাবেই হাসপাতালের তরফে যাঁরা ওষুধ কিনছেন, তাঁদের দেখার কথা। আমরা শুধু প্রেসক্রিপশনে লিখি রিঙ্গার্স ল্যাকটেট। বাকিটা দেওয়া হয় হাসপাতালের তরফেই। আমরা চিকিৎসকেরা বড়জোর অ্যান্টি- বায়োটিকের ব্র্যান্ড নিয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকি।’’ চিকিৎসক সুবর্ণও এ ব্যাপারে সহমত। তিনি আরও বলছেন, ‘‘হাসপাতালগুলির পক্ষেও সবটা জানা সম্ভব নয়। কারণ, ওষুধ কেনার পরে হাসপাতালের তরফে সেই ওষুধের নমুনা পরীক্ষা করতে পাঠানো হয়। কিন্তু নমুনা পরীক্ষা হয়ে আসতে সময় লেগে যায় ৩ মাস। সেই সময়ে হাসপাতালের প্রয়োজনের তাগিদে পরীক্ষার রিপোর্ট আসার আগেই স্যালাইনের ব্যবহার শুরু করে দিতে হয়।’’
রোগীরা কী করবেন?
রিঙ্গার্স ল্যাকটেট দেখেই আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই বলে জানাচ্ছেন দুই চিকিৎসকই। চিকিৎসক সব্যসাচী বলছেন, ‘‘যেটা হয়েছে সেটা এক ব্র্যান্ডের একটি বিশেষ ব্যাচের স্যালাইন। রিঙ্গার্স ল্যাকটেট তৈরি করে এমন বহু ব্র্যান্ড আছে। সব ক’টির নাম আমরা জানি না। কিন্তু তারা গুণমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হচ্ছে কি না সেটা হাসপাতালের যে বিভাগ ওষুধ কেনার সঙ্গে জড়িত, তাঁরাই দেখে নেন এবং দায়িত্ব সহকারেই সেই কাজ করে থাকেন।’’ চিকিৎসক সুবর্ণের মতে, রিঙ্গার্স ল্যাকটেটে কোনও সমস্যা নেই। বরং রিঙ্গার্স ল্যাকটেট সলিউশন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এসেনশিয়াল মেডিসিনের তালিকাভুক্ত। চিকিৎসার জন্য জরুরিও। কিন্তু কেউ যদি ওষুধে ভেজাল মেশায়, সেটা নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব তাঁদের, যাঁরা নজরদার। রোগীদের নিরাপত্তার দায়ও সেই নজরদারদেরই। তবে একই সঙ্গে তিনি বলছেন, ‘‘রোগীদের আতঙ্কিত হওয়া অস্বাভাবিকও নয়। যে ওষুধে সমস্যা রয়েছে, তা তাঁদের দেওয়া হচ্ছে কি না, তা নিয়ে ভয় হতে পারে। এখনও পর্যন্ত হাসপাতালগুলি জরুরি পদক্ষেপ করেছে। তবে রোগীরা কোনও বিষয়ে সন্দিহান হলে অবশ্যই প্রশ্ন তুলতে পারেন। সরব হতে পারেন।’’