Children Eye care

চশমার সংখ্যা বাড়ছে শিশুদের চোখে, দোষ পড়ছে ফোন-ল্যাপটপের উপর, কিন্তু উপায় কী?

করোনা ও লকডাউন পরিস্থিতিতে প্রায় দু’বছর অনলাইন ক্লাস চলেছে স্কুলগুলিতে। যার প্রভাব পড়েছে তাদের চোখে। ছোট্ট বয়সে দৃষ্টিশক্তি তাই খারাপ হচ্ছে তাদের। চোখ শুকনো হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যাও দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া, ছোট থেকে মোবাইল দেখার অভ্যাসও চোখের বিপদ ডেকে আনছে।

Advertisement
নবনীতা গুহ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০২৪ ০৯:৩০
Rising screen time leads to more children needing glasses

শিশুদের চোখে কেন চশমা বাড়ছে? ছবি: সংগৃহীত।

‘দ্য নেম অফ মাই স্কুল ইজ়…’ । বোর্ডের সেই লেখা চোখে কেমন ঝাপসা লাগছিল বছর পাঁচের বর্ণার। কোনও ক্রমে দেখে লেখা শুরু করতে করতে দেরি হয়ে গিয়েছে। তত ক্ষণে বোর্ড মুছে ফেলেছেন শিক্ষক। প্রায় রোজই এমনটা হচ্ছে। আজকাল লেখা আর শেষ করতে পারছে না ও।

Advertisement

হাতের লেখা মোটামুটি ভালই ছিল দ্বিতীয় শ্রেণির সৌম্যর। ইদানীং ভাল করে বোর্ড দেখতে না পাওয়ায় কোনও মতে লিখতে গিয়ে হাতের লেখা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে আবার মাথাও ব্যথা হচ্ছে।

বাড়িতে মাকে জানিয়েছে বর্ণা। সৌম্যও। দু’ক্ষেত্রেই মায়েরা প্রথমে ভেবেছিলেন, দুষ্টুমি বা ক্লাসে গল্প করতে গিয়ে লেখা শেষ করতে পারছে না ওরা। তবে তত দিনে ডাক পড়েছে স্কুল থেকে। শিক্ষক বলেন, দ্রুত চক্ষু চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে। আর সেখানে নিয়ে যেতেই দেখা গেল, চোখে ভাল করে দেখতে না পাওয়াতেই যত সমস্যা। জুটল চশমাও।

বর্ণা, সৌম্যের মতো অনেক শিশুই এখন ভুগছে চোখের সমস্যায়। যে কোনও স্কুলের সামনে গেলেই ছোটদের চোখে এখন রংবেরঙের ফ্রেমের চশমা।

চিকিৎসকেরা অবশ্য এ জন্য দায়ী করেছেন প্রায় বছর দুয়েক ধরে চলা করোনা পরিস্থিতি এবং অনেক ছোট বয়স থেকে মোবাইল দেখার অভ্যাসকে। এ ছাড়া, ব্যস্ত এই সময়ে সকাল বা বিকেলে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে খেলতে না পারা (ডে লাইট অ্যাক্টিভিটি), চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি থাকাকেও দায়ী করেছেন তাঁরা।

Rising screen time leads to more children needing glasses

অনেক শিশুই এখন ভুগছে চোখের সমস্যায়। ছবি: সংগৃহীত।

চক্ষু চিকিৎসক সুকান্ত বৈদ্য জানালেন, করোনা ও লকডাউন পরিস্থিতিতে প্রায় দু’বছর অনলাইন ক্লাস চলেছে স্কুলগুলিতে। অনেক শিশুই ওই পরিস্থিতিতে প্রথম স্কুল শুরু করেছেও সেই অনলাইনে। যার প্রভাব পড়েছে তাদের চোখে। ছোট্ট বয়সে দৃষ্টিশক্তি তাই খারাপ হচ্ছে তাদের। চোখ শুকনো হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যাও দেখা যাচ্ছে। তবে শুধু করোনা পরিস্থিতি নয়, ছোট থেকে মোবাইল দেখার অভ্যাসও চোখের বিপদ ডেকে আনছে বলে জানালেন তিনি। চিকিৎসক বললেন, “অনেকটা সময় ধরে স্ক্রিন দেখার ফলে চোখে চাপ পড়ছে। তাতেই সমস্যা বাড়ছে। ছোটরা মোবাইল, ট্যাব, ল্যাপটপে কাছের জিনিস চোখের উপর চাপ দিয়ে দেখছে। চোখের লেন্সও সেই সময়ে তার প্রকৃতি বদলে ফেলে কাছের জিনিস দেখতে বেশি চেষ্টা করছে। যাতে চোখের পেশিগুলি ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। যার জেরে চোখের কাঠামোগত ক্ষতিও হচ্ছে।”

চোখে দেখতে যে সমস্যা হচ্ছে, ছোটরা অনেক সময়েই তা বুঝতে পারে না। চোখ কচলে নিয়ে অনেক সময়ে তারা দেখার চেষ্টা করে। এতে সংক্রমণের ভয়ও থাকছে। আবার কোনও একটা চোখে সমস্যা থাকলে মস্তিষ্ক ওই চোখের বদলে অন্য চোখ দিয়ে দেখার ক্ষেত্রে জোর দেয়। তাতেও চোখের উপর চাপ পড়তে থাকে। এর জেরে আবার অনেক সময় দুই চোখের পেশির সমন্বয়ও বিগড়ে যায়। তখন অনেকের ক্ষেত্রেই মনে হয় চোখ যেন বেঁকে রয়েছে। এ সব কথাও জানালেন চিকিৎসক।

Rising screen time leads to more children needing glasses

চোখে দেখতে যে সমস্যা হচ্ছে, ছোটরা অনেক সময়েই তা বুঝতে পারে না। ছবি: সংগৃহীত।

করোনা এবং করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে শিশুদের মোবাইল ইত্যাদিতে স্ক্রিন দেখার সময় বেড়ে যাওয়াতেই যে চোখের সমস্যা বাড়ছে, তা মেনে নিয়েছেন চক্ষু চিকিৎসক স্মিতা ঘোষ। তিনি বলেন, “এমনিই আজকাল ছোট থেকে শিশুদের, বিশেষত খাওয়ার সময়ে মোবাইল দেখা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কখনও বা শিশুদের চুপ করিয়ে রাখতেও মোবাইল দেওয়া হচ্ছে। তার উপরে কোভিড-কালে অনলাইন ক্লাস চলেছে বহুদিন। আর তার পরে এখনও মাঝেমধ্যে বিভিন্ন কারণে স্কুলে চলে অনলাইন ক্লাস, করোনার পর থেকে বিভিন্ন বিষয়েও অনলাইন ক্লাস করার প্রবণতা বেড়েছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমেছে ছোটদের বাইরে গিয়ে খেলার প্রবণতা বা ‘ডে লাইট অ্যাক্টিভিটি’। যা চোখে ‘পাওয়ার’ আসতে একটু হলেও দেরি করায়।”

স্মিতা জানালেন, ছোটদের মোবাইল দেব কি না, কতটা সময়ের জন্য দেব, সবটাই কিন্তু বড়দের হাতে। এ বিষয়ে তাদেরই একটু কঠোর হতে হবে। মোবাইল নয়, বইয়ের সঙ্গে পরিচয় করাতে হবে ছোটদের। বাড়িতেই খেলতে হবে তাদের সঙ্গে। যাতে, যে কোনও স্ক্রিন দেখা কমানো যায়। সে দায়িত্বও বড়দেরই। তবে বর্তমান সময়ে কোনও শিশুকে একেবারে তো স্ক্রিন থেকে দূরে রাখা সম্ভব নয়, তাই কার্টুন বা কোনও কিছু দেখতে মোবাইলের বদলে টিভিতে দেখাই ভাল। কারণ, টিভির পর্দার আয়তনও বড় এবং চোখের থেকে একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব সে ক্ষেত্রে। তবে তাতেও বেঁধে দিতে হবে সময়। রাতে ঘুমোনোর আগে ও অন্ধকার ঘরে মোবাইল না দেখার মতো নিয়মও মেনে চলতে হবে। আর সঙ্গে দিনে অন্তত এক-দু’ঘণ্টা বাইরে খেলতে যাওয়া জরুরি বলে জানান তিনি।

Rising screen time leads to more children needing glasses

ছোটদের মোবাইল দেওয়ার বিষয়ে বড়দের একটু কঠোর হতে হবে। ছবি: সংগৃহীত।

তবে অনেকের ক্ষেত্রেই অনলাইনে নানা ক্লাস করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে বলে জানাচ্ছেন বহু অভিভাবক। তাঁদের কথায়, অনেক কোচিং ক্লাসে ভাল পড়া হয়, অথচ বাড়ি থেকে দূরে হওয়ায় নিয়ে যাওয়া অনেক সময়ে সম্ভব হয় না। সে ক্ষেত্রে অনলাইনের সুযোগ থাকলে সেটাই বেছে নিই। অনেকে আবার জানালেন, ছোটদের বর্তমানে পড়ার চাপ অনেক। সময় বাঁচাতেও তাই এই অনলাইন কোচিং উপযোগী। সুকান্ত জানালেন, এ ক্ষেত্রে ক্লাসে ১৫-২০ মিনিট পর পর ২০ সেকেন্ডের জন্য স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে একটু দূরের কিছু দেখা দরকার। যাতে চোখের পেশিগুলি একটানা তাকিয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত না হয়ে পড়ে।

চিকিৎসকেরা এর পাশাপাশি জোর দিয়েছেন ছোট থেকে সুষম আহারের দিকে। হলুদ ফল ও সব্জি, যেমন কুমড়ো, পাকা পেঁপে, বেল পেপার, পালং, নটের মতো সবুজ শাক, গাজর, টম্যাটো, মেটে খাওয়ার কথা বলেছেন। জোর দিয়েছেন ভিটামিন এ এবং ডি-তে সমৃদ্ধ খাবারের উপর।

Rising screen time leads to more children needing glasses

চোখের যত্নে চিকিৎসকেরা জোর দিয়েছেন ভিটামিন এ এবং ডি-তে সমৃদ্ধ খাবারের উপর। ছবি: সংগৃহীত।

শিশুর চোখ যত্নে রাখার জন্য, তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে চোখ পরীক্ষা করিয়ে নেওয়ার কথাও বলেছেন চিকিৎসকেরা। তবে তার আগেও যদি কোনও শিশুর চোখে দেখতে সমস্যা হয়, যদি দেখা যায় কেউ চোখ কুঁচকে কোনও কিছু দেখছে, তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এ ছাড়া, সময়ের আগে ভূমিষ্ঠ হওয়া (প্রি-ম্যাচিওর) শিশুদের মধ্যে অনেকের আবার জন্মের পর বা খুব ছোট বয়স থেকেই মায়োপিয়া থাকে। সে দিকেও খেয়াল রাখা উচিত বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা।

চিকিৎসকদের কথায়, চোখ খারাপ হওয়া একেবারে আটকে দেওয়া তো সম্ভব নয়, কিন্তু যাতে ছোট বয়স থেকেই চোখের সমস্যা কম হয়, তা দেখতে হবে। ছোট বয়স থেকে তাই নিতে হবে চোখের যত্ন।

আরও পড়ুন
Advertisement