Prevention Tips for Dengue

শহরে বাড়ছে ডেঙ্গির প্রকোপ, দ্রুত সুস্থ হতে পারেন সঠিক খাওয়াদাওয়ায়

ডেঙ্গি হলে সম্পূর্ণ সুস্থ হতে বেশ সময় লাগে। প্লেটলেট কাউন্ট স্বাভাবিক হওয়ার পরও শরীর কাহিল থাকে বহু দিন। কিন্তু যদি খাওয়াদাওয়া নিয়ম মেনে করা যায়, তা হলে আরও দ্রুত চাঙ্গা হয়ে সম্ভব।

Advertisement
সঙ্গীতা চট্টোপাধ্যায় বিসয়ী
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০২৩ ১৮:৫০
Dietician Sangita Chatterjee Bisoyi advice the best diet for dengue recovery

ডেঙ্গি থেকে সেরে উঠতে কোন কোন খাবার খেতে হবে? ছবি: সংগৃহীত।

শহরে দিন দিন ডেঙ্গির প্রকোপ বেড়েই চলেছে। ডেঙ্গি হলেই সাধারণত সকলে রক্তে প্লেটলেট কাউন্ট বা অনুচক্রিকার সংখ্যা স্বাভাবিক রয়েছে কি না, তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু ডেঙ্গি হলে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে শুধু প্লেটমেন্ট কাউন্ট স্বাভাবিক করাই যথেষ্ট নয়। জ্বর, মাথাব্যথা, পেটের সমস্যা এবং আরও নানা রকম উপসর্গে শরীর একেবারে কাহিল হয়ে পড়ে। তাই দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে শরীরে সব পর্যাপ্ত পুষ্টির প্রয়োজন। সঠিক ডায়েটে ডেঙ্গির নানা উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। আবার এই সময় কিছু খাবার এড়িয়ে না গেলে সুস্থ হতে দ্বিগুণ সময় লেগে যেতে পারে।

Advertisement

তাই প্রথমেই কিছু খাবারের কথা জেনে নিন, যা আপনাকে দ্রুত সুস্থ করে তুলতে পারে।

১। ভাল কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার

যেহেতু এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে আপনার শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে, তাই আপনাকে অবশ্যই এমন খাবার খেতে হবে যাতে ক্যালোরি বেশি এবং শরীরে শক্তি জোগায়। ভাত, আলু, কলা, ওটস, মিষ্টি আলুর মতো খাবার আপনার শরীরে শক্তি জোগাতে সাহায্য করে।

২। জল এবং প্রয়োজনীয় তরল

জল শরীরের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয়, বিশেষ করে যখন আপনি ডেঙ্গি থেকে সেরে উঠছেন। কারণ ডেঙ্গি জ্বরের চিকিত্সার জন্য তরল এবং ইলেক্ট্রোলাইটের, সময় মতো প্রয়োজন। যাতে ডিহাইড্রেশনের মতো জটিলতা এড়ানো যেতে পারে। ডিহাইড্রেশন হলে পালস কলাপ্স, কোমা বা প্লাজমা লিকেজ (যা ডেঙ্গি মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ) হতে পারে। তাই আপনাকে অবশ্যই প্রচুর পরিমাণে জল খেতে হবে (প্রতি দিন ২.৬ থেকে ৩.৫ লিটার)। তা ছাড়া আপনি ডাবের জল, ঘোল, সাদা চালের কাঞ্জি, ইলেক্ট্রোলাইট পানীয় (ORS), আখের রসের মতো বিভিন্ন তরল পান করতে পারেন যা ইলেক্ট্রোলাইটের (যেমন পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেশিয়াম) ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করবে এবং আপনাকে হাইড্রেটেড রাখবে।

৩। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার

ভিটামিন সি সমস্ত ভিটামিনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ডেঙ্গির প্রাকৃতিক চিকিত্সার জন্য অত্যন্ত জরুরি। কারণ, এটি শরীরের অ্যান্টিবডির সংখ্যা বাড়িয়ে তোলে। তাই রোগও সারে চটপট। এই ভিটামিনের অ্যান্টিভাইরাল এবং অ্যান্টিঅক্সিডেটিভ বৈশিষ্ট্যগুলি আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। ভিটামিন সি শরীরের আয়রন শোষণেও সাহায্য করে। তাই ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার রোজ খেলে উপকার পাবেন। যেমন আমলকি, লেবু, কমলালেবু, আনারস, পাকা পেঁপে, স্ট্রবেরি, কিউয়ি, লাল ও হলুদ বেলপেপার, পেয়ারা, টম্যাটো, জাম, ব্রোকলি, কুমড়ো ইত্যাদি।

৪। আয়রন সমৃদ্ধ খাবার

ডেঙ্গির পর হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বজায় রাখতে এবং প্লেটলেট তৈরি করতে আপনার শরীরের প্রচুর আয়রনের প্রয়োজন হয়। প্লেটলেট এবং ভিটামিন কে শরীরের রক্তজমাট বাঁধার প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ। রক্তের ক্ষয় বন্ধ করার জন্যেও প্রয়োজনীয়। যা ডেঙ্গুর সময় হয়েই থাকে। তাই আপনার রোজকার খাবারে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার অবশ্যই রাখুন। পেঁপে পাতার রসে (পেঁপে পাতার তাজা নির্যাস) ভরপুর আয়রন থাকে। দিনে ২-৩ বার খেতে পারেন। তা ছাড়া সবুজ শাক-সব্জি, লেবু, লেবুর কয়েক ফোঁটা-সহ সব্জির রস, ডালিমের মতো ফলগুলি আপনার রোজের ডায়েটে রাখুন। যা পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়রন পেতে সাহায্য করবে।

স্বাস্থ্যকর খাবার খেয়েই দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন।

স্বাস্থ্যকর খাবার খেয়েই দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। ছবি: সংগৃহীত।

৫। ভিটামিন কে সমৃদ্ধ খাবার

ডেঙ্গির চিকিৎসায় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট হল ভিটামিন কে। তাই ভিটামিন কে সমৃদ্ধ খাবার যেমন পালং শাক, বিট, পার্সলে, ব্রোকলি, সবুজ মটরশুটি, সবুজ মটর, বাঁধাকপি, মুরগির মাংস এবং জাম, অ্যাভোকাডো, কিউয়ি, প্রুনসের মতো ফল রোজ খাওয়া প্রয়োজন।

৬। ভেষজ এবং মশলা

অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি, অ্যান্টিফাঙ্গাল, অ্যান্টিভাইরাল, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল, অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলনে পারেন এমন কিছু মশলা এবং ভেষজগুলির রান্নায় দেওয়া জরুরি। যেমন হলুদ, আদা, রসুন, গোলমরিচ, দারুচিনি, এলাচ এবং জায়ফল। এগুলি টি-সেলের মতো ইমিউন সেল নিয়ন্ত্রণ করে, যা শরীরকে ভাইরাস প্রতিরোধে সাহায্য করে। প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে তুলনে অতুলনীয় এই মশলা এবং ভেষজগুলি। স্টার অ্যানিস, এলাচ, দারচিনি মিশিয়ে ভেষজ চা তৈরি করেও পান করতে পারেন ।

৭। প্রিবায়োটিক এবং প্রোবায়োটিক খাবার

ডেঙ্গির পর হজমক্ষমতা বাড়াতে এক জন রোগীকে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোবায়োটিক খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। যা শরীরে সাধারণত উপকারী ব্যাক্টেরিয়া বাড়িতে তুলতে সাহায্য করে। যার ফলে হজম ক্ষমতা ভাল হয়। ডেঙ্গি হলে ডায়রিয়া, বমি ইত্যাদির কারণে শরীরের ভাল ব্যাক্টেরিয়া নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। দই, ঘোল, রাইস কাঞ্জি, কিমচি, কম্বুচার মতো প্রোবায়োটিক এবং ওটস, ফ্ল্যাক্সসিড, রসুন, বার্লি, ছোলা, কালো শিম, কলা (বেশি পাকা নয়), আপেলের মতো প্রিবায়োটিক খাওয়ার চেষ্টা করুন।

দ্রুত সুস্থ হতে যে খাবার গুলি এড়িয়ে চলতে হবে

১। ক্যাফিন

কফি বা যে কোনও ধরনের চায়ে ক্যাফিন থাকে এবং শরীরে অত্যধিক ডিহাইড্রেশন তৈরি করে। ডেঙ্গিতে ভুগলে এই ডিহাইড্রেশন আরও মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। তাই ক্যাফিন দেওয়া খাবার একেবারে এড়িয়ে চলুন। মনে রাখবেন, চা-কফি কিন্তু আদতে শক্তি জোগায় না।

২। প্রক্রিয়াজাত এবং প্রিজ়ারভেটিভ যুক্ত খাবার

ডেঙ্গি হলে অবশ্যই মশলাদার, প্রক্রিয়াজাত এবং প্রিজ়ারভেটিভ যুক্ত খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। যেহেতু এই ধরনের খাবার পাকস্থলিকে আরও অ্যাসিডিক করে তোলে, তাই পেটের মধ্যে জ্বালা ভাব তৈরি করে আরও রক্তপাত ঘটাতে পারে। তাই পাকস্থলী ও অন্ত্রের রক্তপাতের ঝুঁকি এড়াতে তেল-মশলা কম দিয়ে রান্না করা বাড়ির খাবার খান।

৩। অস্বাস্থ্যকর এবং খারাপ ফ্যাট

বেশি ফ্যাট বা খারাপ ফ্যাটযুক্ত খাবার হজম করা পাকস্থলীর পক্ষে খুব কঠিন। কারণ, ডেঙ্গি হলে আমাদের হজমের ক্ষমতা মারাত্মক ভাবে কমে যায়। তাই চিজ়, চর্বিযুক্ত মাংস, মাখন, তেলেভাজার মতো ফ্যাটযুক্ত খাবারগুলি নিয়ম মেনে এড়িয়ে চলুন। এ ছাড়াও হাইড্রোজেনেটেড তেল, উদ্ভিজ্জ তেল, পরিশোধিত তেল, ডালডা, সয়াবিন তেল ইত্যাদিও এড়িয়ে চলুন। তাই ঘি, নারকেল তেল (গন্ধহীন), তিলের তেল (কোল্ড প্রেস্‌ড), সর্ষের তেল (কোল্ড প্রেস্‌ড) এর মতো ভাল ফ্যাট অল্প পরিমাণে খেতে পারেন। মানে রান্নায় এই জাতীয় তেল ব্যবহার করতেই পারেন, কিন্তু পরিমাণে অল্প।

৪। গাঢ় রঙের খাবার

ডেঙ্গু রোগীদের জন্য গাঢ় রঙের খাবার এড়িয়ে চলা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বমি, মল বা প্রস্রাবের রং ডেঙ্গি রোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। কিন্তু গাঢ় রঙের খাবার খেলে সেই স্বাভাবিক রং চাপা দিয়ে চিকিৎসকদের বিভ্রান্ত করতে পারে। তাই ডেঙ্গু ধরা পড়লে, চকোলেট বা চকোলেট পানীয়, লাল বা বেগুনি রঙের ফল বা সব্জির রস এড়িয়ে চলতে হবে।

কী খাবেন আর কী খাবেন না, তার তালিকা পেয়ে গেলেন। তবে এই নির্দেশগুলি যাতে নিয়ম করে মানতে পারেন, সেই জন্য একটি সহজ ডায়েট চার্টও দেওয়া হল। মেনে চললে অবশ্যই দ্রুত চাঙ্গা হয়ে উঠবেন।

ভোরবেলা: ১ গ্লাস জল + কাঁচা রসুন (এটি চিবিয়ে বা থেতো করুন এবং জল দিয়ে গিলে নিন) + ১ গ্লাস জলে এক চিমটি হলুদ, লেবুর রস এবং চিয়া বীজ

৩০ মিনিট পর: ৭-৮টি ভেজানো কাঠবাদাম/ ৩-৪টি আখরোট + ২টি খেজুর + ১টি কলা (বেশি পাকা নয়)/আপেল

জলখাবার (/ - ১ঘণ্টা পর): সেদ্ধ করা নানা রকম স্প্রাউটের চাট / রুটি + ডিমের সাদা অংশের অমলেট বা ডাল দিয়ে সব্জি / বেসন বা ওট্‌স বা রাগি বা সবুজ মুগ স্প্রাউট সঙ্গে পালং শাক দিয়ে চিলা + টক দই পুদিনা চাটনি / দোসা বা ইডলি সম্বর ডাল

. ২ ঘণ্টা পর): ঘোল/ ডাবের জল-সহ শাস/ আমলকির রস/ সব্জির রস/ পেঁপে পাতার রস/ ছোলা বা অ্যাভোকাডো স্যালাড

দুপুরের খাবার (. - ঘণ্টা পর): রুটি + ডাল + সব্জি + টক দই / পনির বা ছাতুর পরোটা + টক দই / ভাত + রাজমা বা কাবলি ছোলা + টক দই / সব্জি-সহ ডিম পোলাও + টক দই

দুপুরের খাবারের - . ঘণ্টা পর: গ্রিন টি + ফল (কিউয়ি, কমলা লেবু, ডালিম, পেয়ারা, পেঁপে, আনারস, স্ট্রবেরি, জাম)

সন্ধ্যার খাবার: ভাজা বাদাম (চিনেবাদাম বা ছোলা বা কাজু বা কাঠবাদাম বা আখরোট) / চিনেবাদাম বা ছোলার চার্ট + ভেষজ চা / সবজি বা মাশরুম বা মুরগি বা ডিমের স্যুপ

রাতের খাবার (. - ঘণ্টা পর): ভাত + চিকেন বা মাছের স্টু বা সব্জির সঙ্গে ডাল / ডাল শাকসব্জি দিয়ে খিচুড়ি / রুটি + সব্জি-সহ পনির ভুর্জি

ঘুমের আগে: হলুদ দুধ/হলুদ + কালো মরিচ + আদা + দারচিনি ফোটানো জল

(লেখক ইউকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন এবং পেশায় পুষ্টিবিদ।)

আরও পড়ুন
Advertisement