ইন্দ্রানী হালদার ও ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে জয়শ্রী মুখোপাধ্যায়
খুব সুন্দর ফুলের মালা গাঁথতে পারতেন জয়শ্রী মুখোপাধ্যায়। আবৃত্তিতেও পারদর্শী ছিলেন। জয়শ্রীর গলায় ‘দেবতার গ্রাস’ শুনে চোখে জল আসত তাঁর ঠাকুরমার। উচ্চারণও স্পষ্ট। এই গল্পটি যত এগোবে, ততই জীবন্ত হয়ে উঠবে রবিঠাকুরের সেই পংক্তি, ‘জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা’। দৈন্যদশা ঘোচাতে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম গুণও আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছিল তাঁর জীবনে। আজ তিনি ধারাবাহিকে ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করেন। বিখ্যাত মুখ বলা যায় না। যে দিন শ্যুট থাকে, সে দিন টাকা। আর নয় তো সেই জমানো টাকা দিয়ে নিজের একার সংসার চালান অভিনেত্রী। দৈন্য কাটেনি। ৭০-এ এসেও লড়াই শেষ হয়নি। কিন্তু নিজের জীবন নিয়ে খুশি জয়শ্রী। অভিনয়ের সুযোগ পেলেই আনন্দে থাকেন। আর এই আন্তর্জাতিক নারী দিবসে অভিনয় জগতের সঙ্গে জড়িয়ে জীবন গড়ার গল্প শোনালেন তিনি।
১৯৫০-এ জন্ম জয়শ্রীর। পাইকপাড়ায় একান্নবর্তী পরিবারে। কিন্তু পারিবারিক সমস্যায় বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হয় জয়শ্রীর পরিবারকে। এক দিন ট্রেনে করে বাড়ি ফেরার সময়ে দুর্ঘটনায় হাত-পা অচল হয়ে পড়ে বাবার। জয়শ্রী তখন ১৩। তাঁর পরে আরও ৪ ভাই-বোন। গোটা সংসারের ভার তাঁর কাঁধে আসে। পড়াশোনা থেমে যায়। কিন্তু কী করে খিদের জ্বালা মেটানো যায়? ফুলের মালা গাঁথতে বসলেন হীরা। জয়শ্রীর ডাকনাম। দমদম ক্যান্টনমেন্টের বাজারে বসে মালা বিক্রি করে যা পেতেন, তা দিয়ে আধপেট খাওয়া হত পরিবারের। এক পাউন্ড পাঁউরুটিতে ৬ জনের রাতের খাওয়া। একটু জল আর চিনি মিশিয়ে নিতেন। মাঝেমাঝে রেশন কার্ডে ভাঙা গমের আধখানা পাওয়া যেত। তা দিয়ে আলু সিদ্ধ করে ভুরিভোজ হত কখনও। আর নয়তো মাঝে মধ্যে শাক তুলে সিদ্ধ করে খাওয়া।
ইতিমধ্যে পাইকপাড়ায় থাকাকালীন টুকটাক আবৃত্তির অনুষ্ঠান করে নাম করেছিলেন ছোট্ট জয়শ্রী। এক দিন এক নাট্য পরিচালক তাঁকে দেখতে পান মালা বিক্রি করতে। বলেন, ‘‘তুমি সেই অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করেছিলে না? রাস্তার ধারে মালা বিক্রি করতে হচ্ছে তোমাকে!’’ তাঁর অবস্থার কথা জানতে পারেন পরিচালক। সুভাষনগরে একটি ক্লাবের অনুষ্ঠানে ‘উত্তরা’ নাটক মঞ্চস্থ হবে বলে জানালেন পরিচালক। নায়িকার চরিত্রের জন্য ডাকা হয় জয়শ্রীকে। তাঁর অভিনয় দেখে পরিচালক বলতেন, ‘তুই এক দিন খুব বড় অভিনেত্রী হবি।’ প্রথম মঞ্চায়নের পরে ১০ টাকা ও এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে খুশি মনে বাড়ি ফিরেছিলেন জয়শ্রী।
এর পর একে একে ‘ইরা’, ‘চোর’— নাটকের তালিকা বাড়তে থাকল। বড়গাছিয়ায় ‘চোর’-এর অভিনয় করতে গিয়ে প্রথম যাত্রা দেখার সুযোগ। প্রস্তাবও আসে। জয়শ্রীর মা মনে করতেন, যাত্রা ভদ্র বাড়ির ছেলেমেয়েদের শিল্প নয়। কিন্তু বাবা পাশে দাঁড়ান। সংসারের আর্থিক অনটনের কথা ভেবে মেয়েকে অনুমতি দেন তিনি। ফের শুরু হয় যাত্রা-পালার দীর্ঘ যাত্রা।
সাড়ে ৩০০ টাকা মাইনে ও ৬০০ টাকা আগাম। শুরু জয়শ্রীর কাজ। পুরো আগাম নিতে চাননি অভিনেত্রী। এক বারে এতগুলো টাকা শেষ হয়ে যাবে যে! তা হলে পুজোর সময়ে ভাইবোনদের জামা কিনে দেবেন কেমন করে? কথাগুলো বলতে বলতে গলা ভারী হয়ে যাচ্ছিল জয়শ্রীর। কাঁপা গলাতেই পরবর্তী কথায় এগিয়ে গেলেন।
শিশির ভাদুড়ির ছাত্রী ফিরোজাবালা তখন যাত্রা ও নাটকের অন্যতম বিখ্যাত অভিনেত্রী। বীণাদেবী ও বন্দনাদেবীও অভিনয় করতেন যাত্রা-পালায়। জয়শ্রীর তখন মাত্র ১৫ বছর বয়স। এই মহিলারাই জয়শ্রীকে আগলে রেখেছিলেন। জয়শ্রী বলেন, ‘‘খারাপ প্রস্তাব এসেছে কত! কিন্তু কখনও ভুল করেও সে পথে পা বাড়াইনি। সাহায্য নিয়েছি ফিরোজাবালা ও বন্দনাদেবীদের কাছ থেকে।’’ এ ভাবেই লড়াই করে নিতেও শিখেছেন।
জানালেন, ফণীভূষণ বিদ্যাবিনোদের পরিচালনাতেও কাজ করেছেন জয়শ্রী। এমনকি, কলকাতা ছেড়ে দিল্লিতে গিয়েও যাত্রা করেছেন। দিল্লি দূরদর্শনের সাংবাদিকেরা এসেছিলেন মঞ্চায়নে। মহিলাদের সাজঘরে ১০ মিনিটের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী এসেছিলেন অভিনেত্রীদের সঙ্গে দেখা করতে। উৎপল দত্তের পরিচালনায় ‘জালিয়ানওয়ালা বাগ’-এ পঞ্জাবি বউয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। সারা রাত মহড়া দিতে হত। কিন্তু কোনও দিন পরিবারের থেকে কোনও বাধা নিষেধ আসেনি।
বিয়ে হয়েছিল জয়শ্রীর। যাত্রা দলেরই এক ম্যানেজারের সঙ্গে। স্বামী চাননি সন্তান হওয়ার পরে স্ত্রী আর অভিনয় করুন। বন্ধ হয়ে যায় নাটক, যাত্রা। কিন্তু ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’। যিনি জীবনে কোনও দিনও আটকে থাকেননি, তাঁকে এক পুরুষ আটকাবে কোন জোরে? ঠিক সুযোগ এল। কিন্তু সংসারের উপরে ঝড় বইয়ে দিয়ে সুযোগ এল। জয়শ্রীর গয়না বন্ধক রেখে তাঁর স্বামী নাটকের দল খুলেছিলেন। কিন্তু বড় বড় অভিনেতারা প্রতারণা করে সে দল বন্ধ করিয়ে দেন। আর্থিক ভাবে ডুবে যান দম্পতি। ছেলেমেয়েদের খাওয়াবে কে? বিয়ের আগে যে ভাবে পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, বিয়ের পরেও তাঁর কাঁধেই দায়িত্ব এল সংসারের রাশ টানার। জয়শ্রী অভিনয় করা শুরু করলেন। সংসারের স্তম্ভ হয়ে দাঁড়ালেন। একার রোজগারে ছেলেমেয়েদের হোস্টেলে পাঠালেন। পড়াশোনা করালেন। ১৯৮৫ সালে মৃত্যু হয় স্বামীর। তার প্রায় ৫-৭ বছর পরে টেলিভিশনে সুযোগ। ছোট ছোট ভূমিকায় অভিনয় করা শুরু।
আজ তিনি ‘খড়কুটো’, ‘ওগো বধূ সুন্দরী’, ‘সাঁঝের বাতি’ ধারাবাহিকে অভিনয় করেন। যখন যখন দরকার পড়ে, তাঁকে ডাকা হয়। মাসমাইনে নেই। যে ক’টা দিন অভিনয়, সে ক'টা দিনের টাকা। তাই জমিয়ে জমিয়ে সংসার চলে। আজও তিনি উত্তর কলকাতায় একটি ছোট্ট বাড়িতে একা থাকেন। নিজের স্বাধীনতায় যাতে বাধা না আসে, তাই ছেলে বা মেয়ে কারও সঙ্গে থাকেন না। কিন্তু মায়ের সঙ্গে সন্তানদের সম্পর্কে কোনও আঁচ পড়েনি। অভিনয়ের সঙ্গেও সমান ভাবে সুসম্পর্ক রেখে চলেছেন জয়শ্রী। পুরনো দিনের কথাগুলো মনে পড়লে কান্না পায়। আবার মন উৎফুল্লও হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, ‘‘আজ যে ভাবে আছি, যা করছি, খুব খুশি আমি। অভিনয় করি। আর কী চাই!’