Bengali films

বাংলা ছবির উন্নতির পথে ‘খলনায়ক’ কে? উত্তরের সন্ধানে আনন্দবাজার অনলাইন

বাংলা ছবির আর্থিক অচলাবস্থার জন্য দায়ী আসল ‘খলনায়ক’টি কে? উত্তরের সন্ধানে টলিপাড়ার বিভিন্ন মহল থেকে তথ্য সংগ্রহ করে আনন্দবাজার অনলাইনের অন্তর্তদন্ত। উঠে এল নানা মত।

Advertisement
অভিনন্দন দত্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০২৪ ০৯:০৭
Who and what are the real villains of current Bengali cinema; industry insiders share their thoughts

বাংলা ছবির উন্নতির পথে কী কী বাধা রয়েছে? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

পুজোর আগে বাংলা ছবি নিয়ে আশায় বুক বাঁধছে টলিপাড়া। জুন মাস থেকেই পর পর বেশ কিছু ছবি মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু, আরজি কর-কাণ্ডের জেরে এই মুহূর্তে আবার বাংলা ছবির মুক্তি পিছোচ্ছে। পাশাপাশি, বাংলা ছবির গুণগত মান এবং বক্স অফিস সাফল্য নিয়েও নিরন্তর কাটাছেঁড়া চলছে। কারও মতে, বাংলা ছবির হারানো গৌরব আর কোনও দিন ফিরবে না। আবার কারও মতে, যে বাংলা ছবি আগে দেশের অন্যান্য আঞ্চলিক ছবিকে পথ দেখাত, সেই ছবিই এখন দৌড়ে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। ২০২৪ সালে বাংলা ছবি কোন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছে? অভাব এবং অভিযোগের পাল্টা যুক্তিতে বাংলা ছবির ক্ষতি করছে কারা বা কোন কোন বিষয়? বাংলা ছবির সেই সব ‘খলনায়ক’-এর সন্ধানে আনন্দবাজার অনলাইন।

Advertisement

আজ থেকে কয়েক দশক আগেও বক্স অফিস ও জাতীয় মানচিত্রে বাংলা ছবির যে অবস্থান ছিল, তা যে আজকে অনেকটাই ‘হৃতগৌরব’-এর সমতুল্য, ইন্ডাস্ট্রির বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষেরা তা মেনে নিচ্ছেন। তবে কোনও সরলরৈখিক পথে এর পিছনে অবস্থানরত মূল ‘খলনায়ক’কে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তা হলে কি ভাবনার দৈন্য? চিত্রনাট্যের আধুনিকীকরণে অনীহা? না কি সিঙ্গল স্ক্রিনের ঝাঁপ বন্ধ হওয়া, পুরনোকে আঁকড়ে ধরে থাকার প্রবণতা? প্রশ্নের পরে প্রশ্ন— ইন্ডাস্ট্রির বিভিন্ন মহলের আলোচনায় উঠে এল নানা মত।

মে মাসে মুক্তি পেয়েছিল অঞ্জন দত্ত পরিচালিত ছবি ‘চালচিত্র এখন’। এই ছবির তিনি প্রযোজকও বটে। বলা হচ্ছে, এই ছবির মাধ্যমে দীর্ঘ দিন পর স্বাধীন ভাবে কেরিয়ারের নতুন স্রোতে আবার সন্তরণ শুরু অঞ্জনের। তাঁর মতে, উন্নত প্রযুক্তি এবং মাধ্যমের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সব সময়েই মানুষের মধ্যে একটা সন্দেহ দানা বাঁধে। অঞ্জনের কথায়, ‘‘কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, এই তর্ক থাকবেই। যে কোনও নতুন জিনিসের ভাল দিকটাই আমাকে আকর্ষণ করে। কিন্তু সন্দেহ থেকে একটা পুরনো চিন্তা আঁকড়ে ধরে এগোনোয় আমার আপত্তি রয়েছে।’’

মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির লাগাতার ‘ব্যর্থতা’ নিয়ে ইন্ডাস্ট্রি সরগরম। তবে এই পতন যে এক দিনে ঘটেনি, তা মনে করিয়ে দিতে চাইলেন অঞ্জন। তাঁর মতে, বাংলা ছবির বর্তমান সমস্যা সকলে মিলে বিশ্লেষণ না করতে পারলে আরও খারাপ দিন দেখতে হবে। তিনি বললেন, ‘‘ওটিটি এসে নাকি সিনেমাহলের ক্ষতি হয়েছে। আমি মানছি। কিন্তু যে ছবি ওটিটিতে মুক্তি পেলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলা ছবির সম্মান বাড়বে, সেই ছবিকে জোর করে প্রেক্ষাগৃহে টেনে আনার তো কোনও দরকার নেই!’’ কথাপ্রসঙ্গেই তিনি মৃণাল সেনের ছবির উদাহরণ দিলেন। বলেলেন, ‘‘ওঁর ছবির স্বত্ব চলচ্চিত্র উৎসবের পর বিদেশি টিভিতে বিক্রি হয়েছে। আমাদের দেশে দূরদর্শন স্বত্ব কিনেছে।’’

Who and what are the real villains of current Bengali cinema; industry insiders share their thoughts

ছবি: সংগৃহীত।

তা হলে প্রেক্ষাগৃহ? তার সম্ভাব্য সমাধান রয়েছে ‘ম্যাডলি বাঙালি’ ছবির পরিচালকের কাছে। অঞ্জন বললেন, ‘‘বাংলা বাণিজ্যিক ছবি কিন্তু এখনও সমকালীন হয়ে উঠতে পারেনি। এখনও যাঁরা ভিড় করে হলে ছবি দেখতে যান, তাঁদের সিংহভাগই বয়স্ক। বয়োজ্যেষ্ঠ দর্শক কোনও দিনই কোনও ইন্ডাস্ট্রির ছবিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন না। ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সিদের হলে টানতেই হবে।’’

বাংলা ছবিতে ভাল লেখক এবং সঙ্গীত পরিচালকের অভাবের কারণেও বাংলা ছবি তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছে না বলেই মনে করছেন অঞ্জন। সব পরিচালককেই যে ভাল চিত্রনাট্যকার হতে হবে, এ রকম কোনও শর্তে বিশ্বাস করেন না অঞ্জন। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘হিট গান কই? ভাল অ্যাকশন দৃশ্য কই? আর পদ্মনাভ (চিত্রনাট্যকার পদ্মনাভ দাশগুপ্ত) কি একা পুরো ইন্ডাস্ট্রির দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেবেন?’’ ভাল ছবির নেপথ্যে সিনেমার বিভিন্ন বিভাগের সুষ্ঠু বণ্টন থাকে বলেই বিশ্বাস করেন অঞ্জন। তাঁর কথায়, ‘‘বুড়ো বয়সে এসে একটা ছবি করে বুঝলাম, আমার জায়গাটা আসলে ওটিটিতে। কিন্তু রাজ চক্রবর্তী বা সৃজিত মুখোপাধ্যায় কেন চুপ করে থাকবেন! তাঁরা তো আমাদের বাণিজ্যিক ছবিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। আসল খলনায়ক আমাদের চিন্তার দৈন্য!’’

পরিবর্তনের বড় শর্ত নিজেকে পরিবর্তন। অঞ্জনের মতে, ইন্ডাস্ট্রির অভিনেতারাও এখন নিজেদের সময়ের দাবি মেনে বদলাতে চাইছেন। অঞ্জনের প্রশ্ন, ‘‘প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় সেই উদাহরণ দিয়েছেন। কিন্তু, তিনি কি আমার বা ধৃতিমানের (ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়) জায়গাটা নিতে পারবেন? তিনি তো বাণিজ্যিক ছবির নায়ক। কিন্তু, তাঁর মতো করে কি ছবি তৈরি হচ্ছে?’’ কথাপ্রসঙ্গেই অঞ্জন জানালেন, ঠিক ভাবে ভাবলে চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তীকে নিয়ে এখনও বাণিজ্যিক ছবি তৈরি সম্ভব। ‘গডফাদার’ যে মূল ধারার এবং ও ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ যে সমান্তরাল ঘরানার ছবি, এই পার্থক্যের উপর বিশেষ করে জোর দিলেন অঞ্জন।

দর্শকের সিনেমা দেখার অভ্যাস, বিশেষ করে মাল্টিপ্লেক্স সংস্কৃতির নেপথ্যে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন অঞ্জন। তিনি মনে করেন, ‘কমিউনিটি ভিউইং’-এর অনেকাংশে ক্ষতিসাধন করছে মাল্টিপ্লেক্স। অঞ্জনের সাফ কথা, ‘‘একে তো টিকিটের দাম আকাশছোঁয়া! ছবির মধ্যে একগাদা বিজ্ঞাপন! তার উপরে প্রেক্ষাগৃহ না কি রেস্তরাঁ, আমি তো বুঝতে পারি না! ছবি দেখতে দেখতে খাবার অর্ডার দেওয়া হচ্ছে, মোবাইল বাজছে! সিনেমা দেখাটাই তো গৌণ হয়ে যাচ্ছে।’’ অঞ্জনের মতে, সিরিয়াস সিনেপ্রেমীদের ফিরিয়ে আনার স্বার্থে মাল্টিপ্লেক্স কর্তাদের বিষয়টা নিয়ে অবিলম্বে ভাবা উচিত।

অন্য দিকে কে বা কোন কোন বিষয় বাংলা ছবির ক্ষতি করছে, সেই প্রসঙ্গে একাধিক সমস্যা নিয়েই আলোচনা করা সম্ভব বলে মনে করেন আর এক পরিচালক অতনু ঘোষ। তবে তিনি মূলত দু’টি বিষয়ের উপরে আলোকপাত করতে চাইলেন। অতনুর মতে, গত কয়েক বছরে বাংলা ছবি ‘অতিসরলীকরণ’ দোষে দুষ্ট। বললেন, ‘‘আমরা নিজেরাই ভেবে নিচ্ছি, দর্শক কঠিন কোনও বিষয় বুঝতে পারবেন না! ফলে সব কিছুকেই ধরে নেওয়া হচ্ছে, আমাদের সহজ-সরল ভাবে তাঁদের সামনে উপস্থাপন করতে হবে।’’ অতনুর মতে, এই প্রবণতা থেকে ছবি তার গভীরতা হারাচ্ছে। পাশাপাশি, কোনও কোনও ফর্মুলা হিট করলে, তা বাকিরাও অনুসরণ করতে চাইছেন। ফলে মৌলিকতাও হারিয়ে যাচ্ছে। অতনু বললেন, ‘‘সাধারণত ছোট পর্দায় কাহিনির গভীরে প্রবেশ করা হয় না। টিআরপি-র খেয়াল রাখতে হয়। অনেক ইস্যুর পুনরাবৃত্তি ঘটানো হয়। আজকাল বাংলা ছবির ক্ষেত্রেও সেটা করা হচ্ছে।’’

Who and what are the real villains of current Bengali cinema; industry insiders share their thoughts

ছবি: সংগৃহীত।

অতনুর মতে, নতুন কিছু করার প্রয়াস শুরু থেকেই বাংলা ছবিতে রয়েছে। কিন্তু ইদানীং সেই অভ্যাস হারিয়ে গিয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিটিও তো শুরুতে দর্শকের আনুকূল্য পায়নি। কিন্তু এই গভীর অন্বেষণ হালের বেশির ভাগ বাংলা ছবিতেই খুঁজে পাই না।’’ ফলে, একটা সময়ের পর দর্শক মুখ ফিরিয়ে নেন বলেই জানালেন অতনু। তাঁর কথায়, ‘‘দর্শক অনুমান করে নিতে পারলে তখন আর তাঁরা হলে যেতে চান না, পরে ওটিটিতে দেখে নিতে চান।’’

এর পর অতনু চিত্রনাট্য প্রসঙ্গে কথা বললেন। তাঁর মতে, চিত্রনাট্য একটা শিল্প এবং তা লিখতে গেলে কৌশল আয়ত্ত করতে হয়। অতনু বললেন, ‘‘আমরা চিত্রনাট্যের খসড়া করতেই তিন থেকে চার মাস সময় নিই। চিত্রনাট্য লেখার ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ প্রসঙ্গে অনেকেই উদাসীন। তার ফল ভুগতে হয় ছবিকে।’’ অতনু জানালেন, সারা পৃথিবী জুড়ে এখন ‘স্ক্রিপ্ট ডক্টরিং’ শুরু হয়েছে। অর্থাৎ একটি চিত্রনাট্য লেখার পর, অভিজ্ঞ কাউকে দিয়ে তা ঘষামাজা করিয়ে নেওয়া। অতনুর কথায়, ‘‘ছ’দিন বা সাত দিনে চিত্রনাট্য লেখা হলে, তখন ছবির মেরুদণ্ডই শক্ত হয় না।’’

মাল্টিপ্লেক্সে বাংলা ছবির টিকিটের দাম যে ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী, সে প্রসঙ্গেও হতাশা ফুটে উঠল অতনুর বক্তব্যে। তাঁর কথায়, ‘‘নন্দনে একাধিক ছবি হাউসফুল হয়। কিন্তু মাল্টিপ্লেক্সে অনেকের পক্ষেই প্রথম সপ্তাহে মাথাপিছু ২৫০-৩০০ টাকা খরচ করে ছবি দেখা সম্ভব হয় না।’’ নন্দনে পর পর হাউসফুল শো প্রসঙ্গেই তাঁর ‘বিনিসুতোয়’ ছবিটির উদাহরণ দিলেন অতনু। তরুণ পরিচালক অভিনন্দন বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম ছবি ‘মানিকবাবুর মেঘ’ যে প্রায় কোনও ধরনের মুক্তি-পূর্ববর্তী প্রচার ছাড়াই নন্দনে টানা হাউসফুল হয়েছে, সে কথাও মনে করিয়ে দিলেন। বললেন, ‘‘হিন্দি ছবির ক্ষেত্রে টিকিটের দাম নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। কিন্তু আঞ্চলিক ছবির ক্ষেত্রে বিষয়টা নিয়ে কেউ ভাবছেন না, এটাই দুর্ভাগ্যের।’’

Who and what are the real villains of current Bengali cinema; industry insiders share their thoughts

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

গত বছর পরিচালক সুমন ঘোষের ‘কাবুলিওয়ালা’ ছবিটি দর্শকের মন জয় করে। সুমন নিজে অর্থনীতির অধ্যাপক। তাই বাংলা ছবির পরিস্থিতি বিচার করতে অর্থনীতির ‘লো লেভেল ইকুইলিব্রিয়াম ট্র্যাপ’ তত্ত্বের সাহায্য নিলেন। বললেন, ‘‘চাহিদা এবং জোগানের পার্থক্য বাড়লে একসময়ে ভারসাম্য নীচে আটকে যায়। সেখান থেকে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন।’’ সুমনের মতে, এই চাহিদার দিকে রয়েছেন দর্শক এবং জোগানের দিকে রয়েছেন ছবির নির্মাতারা। তিনি বললেন, ‘‘সৌমিত্রকাকুর (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) থেকে এক বার শুনেছিলাম যে, সত্যজিৎ রায় তাঁকে বলেছিলেন, একটি ইন্ডাস্ট্রির সার্বিক উন্নয়নের জন্য নির্মাতা এবং দর্শক, দু’জনকেই এক পা করে এগোতে হবে।’’

এই মুহূর্তে দেশে আঞ্চলিক ইন্ডাস্ট্রি হিসাবে মালয়ালম ছবি খুব ভাল সময়ের মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছে। সেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করে সুমন বললেন, ‘‘বাংলায় ‘আরআরআর’-এর মতো ছবির ভিএফএক্সের বাজেট নেই— এই অজুহাত দিয়ে লাভ নেই। ‘মঞ্জুমেল বয়েজ়’-এর মতো ছবিও তো তৈরি করা যেতে পারে।’’ একই সঙ্গে সুমন যোগ করলেন, ‘‘সত্যজিৎ রায়ের কথা মতোই মালয়ালম ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রে যেখানে দর্শক ও নির্মাতারা এক পা করে এগোচ্ছেন, দুঃখের বিষয়, বাংলায় সেখানে তাঁরা এক পা করে পিছিয়ে যাচ্ছেন।’’

Who and what are the real villains of current Bengali cinema; industry insiders share their thoughts

ছবি: সংগৃহীত।

প্রযোজক রানা সরকারের মতে, বাংলা ছবির ক্ষতি করছেন বাঙালি দর্শক। তিনি বললেন, ‘‘সব ইন্ডাস্ট্রিতেই ভাল-খারাপ ছবি থাকে। কিন্তু দর্শকের একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে যে, তাঁরা আর হলে আসবেন না, পরে ওটিটিতে দেখবেন!’’ রানার মতে, দর্শক অভিযোগ করেন, বাংলা ছবির মানের গণহারে পতন হয়েছে। সে কথা তিনি মেনে নিতে রাজি নন। তাঁর পাল্টা যুক্তি, ‘‘ভাল না কি খারাপ, সেটা তো হলে গিয়ে দেখে বিচার করা উচিত। বাড়ি বসেই সমাজমাধ্যমে লিখে দেওয়া হচ্ছে!’’

রানা জানালেন, ভাল হিন্দি এবং দক্ষিণী ছবি এখনও এ রাজ্যে ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকার ব্যবসা করে। কিন্তু, সেখানে বাংলা ছবিকে ১ কোটি টাকার ব্যবসা করতে হলে বেগ পেতে হচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘দর্শক এটা ভুলে যান যে, তাঁরা ছবি না দেখলে টিকিট বিক্রি হবে না। আর প্রযোজক টাকা না পেলে পরের ছবিটা তৈরি হবে না।’’

ইদানীং টলিপাড়ায় অল্প দিনে ছবির শুটিং শেষ করার বিষয়টি বার বার আলোচনায় উঠে আসছে। রানার মতে, ছবির গুণমান ধরে রাখতে হলে, এই ধরনের ‘ঝাপসা ছবি’ তৈরি বন্ধ করতে হবে। রানা বললেন, ‘‘অল্প বাজেট বলে ৭-১০ দিনে কেউ কেউ ছবি করছেন। একজন অভিনেতা টাকার জন্যই সেই ছবিতে অভিনয়ও করছেন। স্বাভাবিক ভাবেই সেই সব ছবি অনেক সময়েই দর্শকমনে দাগ কাটছে না।’’ ইন্ডাস্ট্রিতে একাধিক অভিনেতা কোনও প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ থাকেন। এই প্রবণতা বাংলা ছবির ক্ষতি করছে বলেই মনে করেন রানা। কারণ, চুক্তির অধীনে থাকাকালীন সেই অভিনেতাকে অন্য কোনও নির্মাতা ব্যবহার করতে পারেন না। রানার কথায়, ‘‘বাইরে সেই অভিনেতাকে নিয়ে তিন-চারটে ছবি তৈরি হলে, তার মধ্যে দুটো ছবি তো আশা করাই যায় ভাল হবে।’’

Who and what are the real villains of current Bengali cinema; industry insiders share their thoughts

ছবি: সংগৃহীত।

এই সূত্রে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করলেন রানা। তাঁর মতে, শুধু উপার্জনের মাধ্যম হিসাবে সিনেমাকে বিচার করলে সমস্যা। বরং, অভিনেতাদের চিত্রনাট্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক থাকা উচিত। রানা বললেন, ‘‘আমাদের ছোট ইন্ডাস্ট্রি। উপার্জন করতে হবে। যা পাচ্ছি, আমি তাতেই রাজি হয়ে যাচ্ছি— এই ধরনের মানসিকতা বাংলা ছবির ক্ষতি করছে।’’ ইন্ডাস্ট্রির বাজারকে ঠিক রাখতে মাসে অন্তত একটা ‘হিট’ বাংলা ছবি চাই বলেই মনে করেন রানা।

ছবি তৈরি হলেই হল না, সেই ছবি দর্শকের কাছে কী ভাবে পৌঁছে দেওয়া যায়, তা-ও বিচার্য বিষয়। নবীনা সিনেমার কর্ণধার নবীন চৌখানির মতে, বাংলা ছবির নির্মাতারা দর্শকের বুঝতে পারছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘তবুও ইন্ডাস্ট্রির প্রযোজক, পরিচালক এবং শিল্পীরা তো চেষ্টা করছেন।’’ তাই কিছু ছবি সফল হচ্ছে। বাংলা ছবির একাধিক ‘ভিলেন’-এর মধ্যে নবীন আলাদা করে উল্লেখ করলেন উৎসবকেন্দ্রিক ছবিমুক্তির প্রবণতাকে। বললেন, ‘‘বাংলা নববর্ষ, পুজো বা বড়দিনের মতো উৎসবকে কেন্দ্র করে সবাই ছবি রিলিজ় করেন। ফলে, হল পেতে সমস্যা হয়। তখন কোনও হিন্দি ছবিকে জায়গা দিলে, আমাদের বলা হবে, বাংলা ছবিকে জায়গা দিচ্ছি না!’’

নবীনের মতে, প্রযোজকেরা নিজেদের উপর বিশ্বাস হারাচ্ছেন বলেই উৎসবকে কেন্দ্র করে ছবি আনতে চান। তাঁর কথায়, ‘‘সে ক্ষেত্রে বিক্রি ভাল হয়। কিন্তু, ওই লোভে অপ্রয়োজনীয় ছবিকেও নিয়ে আসা হয়। যোগ্য হিন্দি ছবির পরিবর্তে তথাকথিত অযোগ্য বাংলা ছবি চালানোয় আমি বিশ্বাস করি না।’’ নবীনের মতে, বাংলা ছবির প্রযোজকদের মধ্যে আরও ঐক্য প্রয়োজন। তা হলে ছবিমুক্তি সংক্রান্ত অনেক জটিলতা কাটানো সম্ভব, যা আখেরে বাংলা ছবিরই উন্নতিতে সুফল দিতে পারে।

সব শেষে আলোচনায় বাংলা ছবির আরও এক ‘খলনায়ক’কে চিহ্নিত করতে চাইছে ইন্ডাস্ট্রির এক বড় অংশ। সেই ভিলেন হল টলিপাড়ার ফেডারেশন (ফেডারেশন অফ সিনে টেকনিশিয়ান্স অ্যান্ড ওয়ার্কার্স অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়া)। সম্প্রতি, ফেডারেশনের সঙ্গে পরিচালকদের মতানৈক্য ইন্ডাস্ট্রির আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল। পাশাপাশি, ফেডারেশনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে। প্রতিবাদে কর্মবিরতিতেও গিয়েছিলেন পরিচালকেরা। শুটিং আবার শুরুও হয়েছে। কিন্তু ফেডারেশন কি সত্যিই ইন্ডাস্ট্রিতে খলনায়কের ভূমিকা পালন করে? ফেডারেশন সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাস কিন্তু পাল্টা যুক্তি ছুড়লেন। তাঁর নিশানায় ইন্ডাস্ট্রির প্রযোজকেরা। বললেন, ‘‘বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে হাতেগোনা কয়েক জন প্রযোজক রয়েছেন। আমি এখনও হিসেব দিতে পারি, তাঁদের কাছে ফেডারেশনের কী বিশাল অঙ্কের টাকা বকেয়া রয়েছে! অনেক সময়ে তো শিল্পীদেরও প্রচুর টাকা প্রযোজকদের কাছে বকেয়া থাকে।’’

Who and what are the real villains of current Bengali cinema; industry insiders share their thoughts

ছবি: সংগৃহীত।

শুধু বকেয়া টাকা নয়, শুটিং ফ্লোরে ‘ভূতুড়ে’ টেকনিশিয়ানদের কথাও উল্লেখ করলেন তিনি। বললেন, ‘‘একটা ছবির শুটিংয়ে সাধারণত ৩৮-৪০ জন টেকনিশিয়ান লাগে। সেখানে ফ্লোরে দেখা যাচ্ছে ১০০-১২০ জন! তা হলে বাকিরা কারা? প্রযোজককে তো তাঁদেরও পারিশ্রমিক দিতে হচ্ছে। আর দোষের ভাগীদার হচ্ছি আমরা!’’

ফলে বোঝাই যাচ্ছে,বাংলা ছবির সার্বিক পরিস্থিতির নেপথ্যে একাধিক‘খলনায়ক’রয়েছে। কখনও তা চিত্রনাট্য, আবার কখনও নির্মাণের দৈন্য। শুধু হাতেগোনা ছবি নয়,ইন্ডাস্ট্রির সার্বিক মানোন্নয়নের জন্য এক দিকে যেমন আরও বেশি বাণিজ্যসফল ছবি চাই,তেমনই চাই নতুন ভাবনা, গণমানসে ছাপ ফেলতে পারে এমন ছবি।এক্সপেরিমেন্ট থামালে যেমন চলবে না,তেমনই প্রয়োজন ছবির টিকিটের মূল্য নির্ধারণের মতো সংস্কার। বিশেষত মাল্টিপ্লেক্সে।সে লক্ষ্যেও খানিক পদক্ষেপ করা গিয়েছে সাম্প্রতিক কালে মাল্টিপ্লেক্সে ছবির প্রদর্শন খরচ খানিক কমার ফলে।আশা করা যায়,এ ভাবেই সময়ের সঙ্গে এই সব খলনায়কের নিধনে বাংলা ছবি ফের সুদিনের মুখ দেখতে পাবে।

আরও পড়ুন
Advertisement