আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে বুধবার শহরে বিবেক অগ্নিহোত্রী। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
আরজি কর-কাণ্ডের জেরে কলকাতা এখন আক্ষরিক অর্থেই মিছিলের শহর। তারই মধ্যে বুধবার শহরে প্রতিবাদ মিছিলে হাঁটলেন ‘দ্য কাশ্মীর ফাইল্স’ খ্যাত পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী। রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর ভাবনাও ব্যক্ত করলেন আনন্দবাজার অনলাইনের সামনে।
আরজি কর-কাণ্ডে দেশ জুড়ে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। কিন্তু মুম্বই নয়, প্রতিবাদ করতে কলকাতায় এলেন বিবেক। বললেন, ‘‘আমি আগে কিছু ভাবিনি। অপেক্ষা করে দেখলাম, আরজি করের ঘটনা নিয়ে অনেকেই কথা বলেছেন। কিন্তু, মন থেকে নয়। সেখানে আবেগ কম। তাই আমার মনে হয়েছে, কথা বলতে হলে আমার বাংলায় এসে বলা উচিত।’’
আরজি করের ঘটনায় ‘ষড়যন্ত্র’ তত্ত্বের প্রসঙ্গ উঠেছে। বিবেকও তা জানেন। তাঁর যুক্তি, ‘‘কোনও অপরাধ ঘটলে, তা চাপা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা কোথায়, সেটা বুঝতে পারছি না। কিন্তু কে কী করছেন, আমি তার মধ্যে প্রবেশ করতে চাই না। কারণ, রাজনীতিতে প্রত্যেকেই কোনও না কোনও কারণে দোষী। কেউ একশো শতাংশ সৎ নন!’’ একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেই ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় রয়েছেন বিবেক।
তবে প্রতিবাদের পাশাপাশি বাংলায় আসার নেপথ্যে অন্য ভাবনাও কাজ করছে বিবেকের মনে। বললেন, ‘‘বাংলার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সকলেই জানেন। দুর্গা এবং মা কালীকে বাংলার মানুষ পুজো করেন। সেখানেই আজকে মেয়েরা সুরক্ষিত নন। বাংলার যুব সম্প্রদায়কে আমি উদ্বুদ্ধ করতে চাই।’’ বিবেকের মতে, অতীতে বিভিন্ন সময়ে ধর্ষণকে ‘রাজনৈতিক অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে, নোয়াখালি দাঙ্গা, বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের আমল— উদাহারণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। কিন্তু, এ বার এটা বন্ধ করতেই হবে।’’
বাংলার সঙ্গে বিবেকের দীর্ঘ দিনের যোগসূত্র। বললেন, ‘‘আমার মা-বাবা বিয়ের পর কলকাতায় থাকতেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে তাঁরা জেলেও গিয়েছিলেন।’’ বিবেক জানালেন, বাংলার তরুণ সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশের সঙ্গে কথা বলে তিনি জেনেছেন যে, রাজ্যের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অনেকটাই তাঁরা জানে না। তাঁর কথায়, ‘‘ঋষি অরবিন্দ, শরৎচন্দ্র থেকে শুরু করে বাউল গানের বাংলা এক সময়ে শ্রেষ্ঠ জায়গা থেকে এখন অন্যতম খারাপ জায়গায় পরিণত হয়েছে। এটা দুঃখজনক!’’
আরজি কর-কাণ্ডে সমাজমাধ্যম ‘ভুয়ো’ খবরে জর্জরিত। এই পরিস্থিতিতে তরুণ সমাজকে বিচক্ষণতার সঙ্গেই পদক্ষেপ করতে অনুরোধ করলেন বিবেক। বললেন, ‘‘রাজনৈতিক ফাঁদ থেকে দূরে থাকা উচিত। নয়তো শেষমেশ অন্য কারও স্বপ্নপূরণের জন্য নিজের সময় ব্যয় করতে হবে!’’ স্বামী বিবেকানন্দকে মনে রেখেই বিবেক বাংলার তরুণ সম্প্রদায়কে রাজনীতি থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিতে চাইছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, যুবসমাজ বাংলাকে হৃতগৌরব ফিরিয়ে দিতে পারে।
বিগত কয়েক বছরে সমাজমাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত পরিসরেও সমালোচনা এবং ট্রোলিংয়ের শিকার হয়েছেন বিবেক। কী ভাবে মনের জোর বজায় রাখেন তিনি? হেসে বললেন, ‘‘যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তো আমি কাঁধে চোট পেয়েছিলাম! আমি রবীন্দ্রনাথের অনুসারী। তাঁর ‘একলা চলো রে’ মন্ত্রই আমাকে শক্তি জোগায়।’’
ইদানীং যে কোনও বিষয়ে তারকাদের তরফে বক্তব্য না পাওয়া গেলে তাঁদের লক্ষ্যবস্তু করার প্রবণতা বেড়েছে। বিবেকের মতে, কথা বলা বা না বলাটা ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। বললেন, ‘‘তারকারা এখন কথা বলতে চান না। কারণ যা-ই বলুন না কেন, তাঁদের ট্রোল করা হবে। তবে, চুপ করে থাকা মানেই নারী নির্যাতনকে তিনি সমর্থন করছেন বলে মনে করি না।’’ কিন্তু, আরজি করের ঘটনায় এখনও প্রধানমন্ত্রী কোনও প্রতিক্রিয়া জানাননি। প্রসঙ্গ উঠতেই কিছুটা সাবধানী বিবেক। বললেন, ‘‘সেটা প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত। আমি কারও হয়ে কথা বলতে চাই না। আমার ছবি, বই, বক্তৃতার মাধ্যমে যা যা করা সম্ভব, আমি সেটাই করতে চাই।’’
বিবেক জানালেন, আরজি কর-কাণ্ডের প্রেক্ষাপটে ছবির তৈরির কোনও পরিকল্পনা এই মুহূর্তে তাঁর নেই। কারণ, তিনি আগামী ছবি ‘দ্য দিল্লি ফাইল্স’-এর শুটিং শুরু করছেন। বললেন, ‘‘এই ছবিতে বাংলার একাধিক সমস্যাকে তুলে ধরার চেষ্টা করব। সেখানে বাংলার রাজনৈতিক হিংসাও রয়েছে।’’ তবে এই ছবিতে কোনও বড় অভিনেতাকে তিনি নির্বাচন করতে নারাজ। বিবেকের মতে, ছবির ‘কনটেন্ট’ই শেষ কথা বলবে। পাওলি দাম, বিপাশা বসু এবং হালে রাইমা সেনের মতো বাঙালি অভিনেত্রীদের সঙ্গে তিনি ছবি করেছেন। জানালেন, বাংলা থেকে তরুণ অভিনেত্রীর সন্ধানে রয়েছেন তিনি।
কলকাতায় এক দিন মিছিলে হেঁটেই তাঁর দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে না বলেই মনে করছেন বিবেক। বললেন, ‘‘দিল্লির নির্যাতিতার ঘটনার সময়েও আমি দীর্ঘ দিন সেখানে ছিলাম। প্রয়োজন হলে আমি একশো বার কলকাতায় আসব। আর সেটা শুধু আরজি কর নয়, অন্য যে কোনও সমস্যায় আমি পাশে আছি।’’