চেহারা নিয়ে কটূক্তি থেকে অন্যান্য বিষয়ে অপমান। আত্মবিশ্বাস ভেঙে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট একাধিক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। কিন্তু হাল ছাড়েননি। সব প্রতিকূলতাকে জয় করে ইন্ডাস্ট্রিতে আজ বিদ্যা বালন নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান।
তামিল ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান বিদ্যা এবং তাঁর দিদি প্রিয়ার শৈশব কেটেছে মুম্বইয়ের চেম্বুরে। তাঁর বাবা ছিলেন একটি নামী চ্যানেলের উচ্চপদস্থ কর্তা। মা ব্যস্ত থাকতেন ঘর সংসার নিয়েই।
ছোট থেকেই বিদ্যার ইচ্ছে ছিল বলিউডের অভিনেত্রী হওয়ার। তাঁর এক তুতো বোন প্রিয়মণি দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রির বড় তারকা। কিন্তু রক্ষণশীল পরিবারের নিয়ম ছিল, লেখাপড়ায় মন দিতে হবে।
স্কুলের পরে কলেজে পৌঁছে ধীরে ধীরে বিদ্যা নিজের স্বপ্ন পূরণের পথে পা রাখেন। সময় পেলেই পৃথ্বী থিয়েটারে অভিনয়ের ওয়ার্কশপে যেতেন। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়তে পড়তেই তিনি অডিশনে নির্বাচিত হন। কিন্তু তাঁর জীবনের প্রথম ধারাবাহিকের কয়েক পর্বের শ্যুটিংয়ের পরেই সেটা বন্ধ হয়ে যায়।
বিদ্যা কিন্তু দমে গেলেন না। যেখানেই অডিশনের সুযোগ পেতেন, তিনি যেতেন। কলেজে পড়ার সময়েই একতা কপূরের ‘হম পানচ’-এ তিনি কাজ করেন। রাধিকা মাথুরের ভূমিকায় যিনি অভিনয় করছিলেন সেই অমিতা নাঙ্গিয়া ধারাবাহিক থেকে সরে দাঁড়ালে বিদ্যা জীবনের প্রথম অভিনয়ের সুযোগ পান।
সেটা ছিল একতা কপূরেরও কেরিয়ারের প্রথম দিক। একতা-বিদ্যা সম্পর্কও ছিল খুব ভাল। শোনা যায়, একতা চেয়েছিলেন বিদ্যা তাঁর ভাই তুষারকে বিয়ে করুক। কিন্তু শেষ অবধি সেটা বাস্তবায়িত হয়নি।
কলেজে পড়ার চাপের জন্য বিদ্যা ‘হম পানচ’ ধরাবাহিকও বেশিদিন করতে পারেননি। তিনি সে সময় জোর দিয়েছিলেন বিজ্ঞাপনী ছবির উপর। বিজ্ঞাপনে অভিনয় করেই সে সময় হাতখরচ জোগাড় করতেন তিনি। মডেলিং আর পড়াশোনার মধ্যে সামঞ্জস্য রাখতে রাখতেই মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সোশ্যিয়োলজিতে স্নাতকোত্তর সম্পূর্ণ করেন বিদ্যা।
এর পর অডিশন দিয়ে বিদ্যা মনোনীত হন দক্ষিণের সুপারস্টার মোহনলালের বিপরীতে ‘চক্রম’ ছবিতে। প্রথম পর্বের শ্যুটিং সম্পূর্ণ করেন তিনি। কিন্তু তার পর কোনও কারণ ছাড়াই ছবি থেকে বাদ পড়ে যান। তাঁর বদলে নেওয়া হয় অন্য নায়িকাকে।
শেষ অবধি ‘চক্রম’-এর কাজ মাঝপথে বন্ধই হয়ে যায়। এই প্রথম মোহনলালের কোনও ছবি অর্ধসমাপ্ত থেকে যায়। এর দায়ভার গিয়ে পড়ে নবাগতা বিদ্যার উপর। তাঁর নামের পাশে ‘অপয়া’ পরিচয় বসে যায়। ‘চক্রম’-এর সুবাদে বারোটি ছবিতে তিনি সুযোগ পেয়েছিলেন। সেগুলিও একে একে হাতছাড়া হয়।
চেন্নাইয়ের এক প্রযোজকও ছবির মাঝপথে বিদ্যাকে বাদ দিয়ে অন্য নায়িকাকে নিয়ে আসেন। কারণ জানতে চাইলে তিনি মুখের উপর বলে দেন, বিদ্যার মতো কোনও কুৎসিত নায়িকা হতে পারেন না!
এর পর বিদ্যা হতাশা এবং অবসাদের গ্রাসে চলে যান। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সারাক্ষণ তিনি নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্দি করে রাখতেন। আয়নাতেও মুখ দেখতেন না। হতাশার পর্ব কাটিয়ে বিদ্যা যখন কাজ শুরু করলেন, তিনি বেছে নিলেন বাংলা ভাষাকে।
২০০৩ সালে মুক্তি পেল তাঁর প্রথম ছবি ‘ভাল থেকো’। গৌতম হালদারের পরিচালনায় ছবিতে তাঁর বিপরীতে নায়ক ছিলেন জয় সেনগুপ্ত। অন্যান্য কুশীলবদের মধ্যে অন্যতম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, দেবশঙ্কর হালদার এবং পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। এর পরেও বিদ্যার কেরিয়ারে বং কানেকশন আরও জোরদার হয়।
‘ভাল থেকো’-তে বিদ্যার অভিনয় প্রশংসিত হয় সমালোচকদের কলমে। এর পর তিনি সুযোগ পান প্রদীপ সরকারের ছবি ‘পরিণীতা’-য়। প্রদীপের সঙ্গে এর আগেও বিজ্ঞাপনে কাজ করেছিলেন বিদ্যা। প্রথম ছবিই সুপারডুপার হিট হওয়ার সুবাদে বিদ্যাকে আর বলিউডে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
তবে ‘পরিণীতা’-য় সুযোগ খুব সহজে আসেনি। প্রযোজক বিধুবিনোদ চোপড়া চেয়েছিলেন ললিতা-র চরিত্রে ঐশ্বর্যা রাইকে। কিন্তু প্রদীপ সরকারের কথায় বিধুবিনোদ শেষ অবধি বিদ্যাকে নিতে রাজি হন। ৬ মাস ধরে ৪০ বার স্ক্রিন টেস্ট দেওয়ার পরে বিদ্যা চূড়ান্ত পর্যায়ে মনোনীত হন।
এর পর বিদ্যার অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে যান বিধুবিনোদই। তিনি তাঁকে সুযোগ দেন ‘লগে রহো মুন্নাভাই’ এবং ‘একলব্য’ ছবিতে। এর পর ‘ওমকারা’ ছবিতেও তিনি অডিশন দেন। তবে এ বার তিনি ব্যর্থ হন। এই প্রজেক্ট তখনকার জন্য মুলতুবি রাখেন বিশাল।
তবে বলিউডে বিদ্যার বিজয়রথ থামানো যাচ্ছিল না। মণিরত্নমের ‘গুরু’ ছবিতেও তাঁর অভিনয় দর্শকদের নজর কাড়ে। অভিনয়ে কোনও দুর্বলতা না পেয়ে এ বার বলাবলি হতে লাগল তাঁর সাজপোশাক নিয়ে। বিদ্যার ড্রেসিং সেন্স নিয়ে তির্যক মন্তব্য প্রায়ই শোনা যেত।
নিজেকে টাইপকাস্ট হতে দেবেন না বলে বিদ্যা সে সময় ‘হে বেবি’ এবং ‘কিসমত কানেকশন’-এর মতো ছবিতেও কাজ করেন। কিন্তু এই ছবিতেও তাঁর ভারী চেহারা ও ফ্যাশন নিয়ে কটূক্তি করা হয়। সে সময় শাহিদ কপূরের সঙ্গে কিছু সময়ের জন্য প্রেমের সম্পর্কে ছিলেন বিদ্যা। তবে পরে তাঁদের সম্পর্ক ভেঙে যায়।
শাহিদের নাম না করে বিদ্যা বলেছিলেন, সে সময় তাঁর বয়ফ্রেন্ড ক্রমাগত তাঁর চেহারা ও পোশাক নিয়ে হাসিঠাট্টা করতেন। তাঁর প্রতি কথায় বুল খুঁজে বার করতেন। প্রেমিকের এই ছিদ্রান্বেষী মনোভাব বিদ্যার ভাল লাগেনি। তিনি সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসেন।
পরে নিজের ভাবমূর্তি পরিবর্তন করার জন্য বিদ্যা খুব বেশি উৎসাহী হননি। তিনি বলিউডে নিজের জায়গা তৈরি করে নিয়েছিলেন। এ বার সাজপোশাক ঠিক করার জন্য তিনি বেছে নিলেন শাড়িকে। সব জায়গায় তাঁকে শাড়ি পরেই দেখা যেতে লাগল।
এ বার সব্যসাচীর শাড়িতে সজ্জিত বিদ্যার তুলনা হতে থাকল রেখার সঙ্গে। বলা হল, রেখার পরে বিদ্যাকেই শাড়িতে এত সুন্দর লাগে। কিন্তু সেই ইমেজও বিদ্যা ভেঙে ফেললেন ‘দ্য ডার্টি পিকচার’ ছবিতে। সিল্ক স্মিতার ভূমিকায় তিনি ধরা দিলেন ছকভাঙা অভিনয়ে। এই ছবির জন্য তিনি ১০ কেজি ওজন বাড়িয়েছিলেন। বক্স অফিসে ব্লকবাস্টার এই ছবির জন্য তিনি সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার পান।
ছবি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিদ্যা সবসময় গুরুত্ব দেন চিত্রনাট্যের উপরে। চিত্রনাট্য ভাল লেগেছিল বলেই তিনি কম বাজেটের ছবি ‘কহানি’-তে অভিনয় করেছিলেন। ছবি মুক্তির আগে অবধি ভাবা যায়নি বক্স অফিসে এই ছবি এত ভাল বাণিজ্য করবে।
খ্যাতির মধ্য গগনে থাকার সময়েই কর্ণ জোহরের বাড়িতে এক পার্টিতে প্রযোজক সিদ্ধার্থ রায় কপূরের সঙ্গে আলাপ হয় বিদ্যার। ক্রমে সেই আলাপ গড়ায় প্রেম অবধি। ২০১২ সালে বিদ্যাকে বিয়ে করেন সিদ্ধার্থ। এটা ছিল তাঁর তৃতীয় বিয়ে। এর আগে দু’বার বিয়ে করে ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল তাঁর। কিন্তু ব্যক্তি সিদ্ধার্থকে চেনার পরে তাঁর তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী হওয়া নিয়ে কোনও দ্বিধা ছিল না বিদ্যার। পরে বিদ্যা জেনেছিলেন এই পার্টি ছিল তাঁদের আলাপ করানোর জন্যই। কারণ বিদ্যার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন সিদ্ধার্থ।
বিয়ের পরে কাজ কমিয়ে দেন বিদ্যা। তাঁর যুক্তি ছিল, দীর্ঘ দিন পরিশ্রমের পরে এ বার তিনি একটু ব্রেক নিতেই পারেন। প্রথমে ‘কহানি টু’-তেও অভিনয় করতে রাজি হননি তিনি। শোনা গিয়েছিল, সে সময় অন্তঃস্বত্ত্বা ছিলেন তিনি। কিন্তু পরে বিদ্যা জানান, তিনি অসুস্থ ছিলেন, সন্তানসম্ভবা ছিলেন না।
এই ছবির জন্য কঙ্গনা রানাউত, করিনা কপূর খানকেও প্রস্তাব দিয়েছিলেন পরিচালক সুজয়। কিন্তু তাঁরা রাজি হননি। শেষ অবধি ২০১৬ সালে বিদ্যাই অভিনয় করে ‘কহানি টু’-এ। যদিও এই ছবি বক্স অফিসে ব্যর্থ হয়।
ইন্ডাস্ট্রিতে বিদ্যাকে ক্রমশ নায়কের মর্যাদা দেওয়া হতে থাকে। এক বার একতা বলেছিলেন বিদ্যার পদবি পাল্টে ‘খান’ করে নেওয়া উচিত। শুনে বিদ্যা বলেছিলেন তিনি কেন পদবি পাল্টাবেন? বরং, বলিউডের তিন খানই পদবি পাল্টে ‘বালন’ করে নিক!
‘তুমহারি সুলু’, ‘মিশন মঙ্গল’, ‘শকুন্তলা দেবী’-র মতো ছবিতে বিদ্যা আরও একবার প্রমাণ করেছেন, তিনি নিছক নায়িকা বা অভিনেত্রী নন। বরং, তাঁকে ভেবেই গল্প লেখা হয়। তিনি-ই কাহিনির চুম্বক।