আতঙ্কিত রূপঙ্কর।
ফের লাফিয়ে বাড়ছে অতিমারির সংক্রমণ। ফের বন্ধ মাচা, মঞ্চানুষ্ঠান। একের পর এক বাতিল অনুষ্ঠান। ‘‘আমরা খাব কী?’’ ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছেন মনোময় ভট্টাচার্য। শিল্পীদের ভবিষৎ নিয়ে আতঙ্কে রূপঙ্কর বাগচী, রূপম ইসলাম, অনুপম রায়ের মতো প্রথম সারির শিল্পী। তাঁরাও কি ৫০ শতাংশ দর্শক-শ্রোতা নিয়ে অনুষ্ঠান করার আবেদন জানাবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে?
আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে কথার শুরুতেই মনোময়ের স্পষ্ট দাবি, ‘‘আমি কার্যত হতাশ। জানি না, আর কত অনিশ্চয়তার দিকে মঞ্চশিল্পী এবং বাদ্যযন্ত্রীদের ঠেলে দেবে এই অতিমারি।’’ তাঁর অভিযোগ, যখনই নিয়ম কড়া, তখন রোগ বশে। নিয়ম শিথিল হলেই সবাই বেপরোয়া। বড়দিন, বর্ষশেষে চড়ুইভাতি, পার্ক স্ট্রিটে জমায়েত। নববর্ষে চিড়িয়াখানায় ভিড়। রে রে তেড়ে আসছে ওমিক্রন!
শুধুই সাধারণ মানুষ নয়, মনোময় দুষেছেন রাজনীতিবিদদেরও। তাঁর কথায়, সভা, সমাবেশ, জমায়েত, মিছিলে যদি রাশ টানা যেত তা হলে হয়তো ছবিটা একটু আলাদা হত। সেটা হচ্ছে না। ফলে, কোপ এসে পড়ছে বিনোদন দুনিয়ায়। সেই জায়গা থেকেই শিল্পীর গভীর উদ্বেগ, ‘‘ইতিমধ্যেই আমার একাধিক শো বাতিল হয়েছে। এ ভাবে কত দিন পুঁজি ভাঙিয়ে খাব? কত সঞ্চয় থাকতে পারে এক জন মানুষের?’’
হতাশা, আশঙ্কা, ক্ষোভ— সব মিলিয়ে তিতিবিরক্ত রূপঙ্কর বাগচী। ফোনে প্রথম কথাই ছিল, ‘‘আমার পর পর কয়েকটি শো বাতিল। আর কিচ্ছু ভাবতে পারছি না। বিরক্ত লাগছে।’’ অতিমারির প্রত্যাবর্তনের জন্য কেউ দায়ী করছেন জনসাধারণকে। কেউ রাজনীতিবিদদের। রূপঙ্করের চোখে দোষী কারা? ‘‘আমাদের দেশের সমাজ এবং শাসনব্যবস্থা। যার জেরে আমরা অনেক কিছুই দেখেও দেখি না। বুঝেও যেন বুঝি না। এটাই আমাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে।’’ রূপঙ্করের মতে, রোগের প্রকোপ একটু কমতেই সবাই মাস্ক মুখ থেকে সরিয়ে ফেলেছেন। এটাই কি কাম্য? তার পরেই তাঁর আক্ষেপ, এ ভাবে যদি নাগাড়ে চলতে থাকে তা হলে গান-বাজনা ছেড়ে শিল্পীরা অন্য পেশায় চলে যেতে শুরু করবেন। যাঁরা নতুন পেশার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবেন তাঁরা টিকে গেলেন। যাঁরা পারবেন না বা কাজ খুঁজে পাবেন না, তাঁরা আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হবেন!
সপ্তাহের শুরুতেই অর্থাৎ, সোমবার একটি শো ছিল অনুপম রায়ের। বাতিল হয়ে গিয়েছে কোভিডের দাপটে। আফশোসের সুরে জানালেন গীতিকার-সুরকার-শিল্পী, ‘‘কী বলব? কাকে দোষ দেব? মনে করছি, সবই আমার কপাল! ডিসেম্বর থেকে সব কিছুই আবার ছন্দে ফিরছিল। বেশ কিছু শো-ও করলাম। ফের যে-কে-সেই অবস্থা।’’ তবে তার মধ্যেও তাঁর আশার আলো—শুনেছেন ওমিক্রন ততটাও ভয়াবহ নয়। হয়তো মার্চ মাস নাগাদ আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। সেই আশাতেই আপাতত বুক বাঁধছেন শিল্পী।
প্রেক্ষাগৃহের মতো ৫০ শতাংশ দর্শক-শ্রোতা নিয়ে অনুষ্ঠানের জন্য কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আর্জি জানানোর কথা ভাবছেন অনুপম? শিল্পী সঙ্গে সঙ্গে বাতিল করে দিয়েছেন সেই সম্ভাবনা। তাঁর সাফ জবাব, ‘‘আমরা ২০-৩০ হাজার শ্রোতাদের সামনে গান গাই। সভাগৃহে সেই সংখ্যা বড় জোর হাজার খানেক হবে! এতে আমাদের কী হবে?’’
নতুন বছরের গোড়াতেই সারা বাংলা জুড়ে ‘ফসিলস’-এর শো ছিল পাঁচটি। ইতিমধ্যেই সব ক’টি বাতিল। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে কী বক্তব্য রূপম ইসলামের? তাঁর কথায়, ‘‘আমরা পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে সব শো-এ রাজি হইনি। যে ক’টি নিয়েছিলাম, সে ক’টিও বাতিল করতে হয়েছে। কালনা বা কল্যাণীতে গেলে সেখানে শ্রোতার সংখ্যা কমপক্ষে হত ২০ হাজার। কলকাতার প্রথম সারির একটি বিনোদন পার্কেও অনুষ্ঠান ছিল। এগুলো হলে ভুগতেন জনসাধারণ। এবং আমরাও বিরাট ঝুঁকির সম্মুখীন হতাম। ফলে শো বন্ধ করা ছাড়া অন্য রাস্তা নেই।’’ আপাতত তাই অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছেন না রূপম। এর জন্য আমজনতাকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কড়া হাতে জনজোয়ার নিয়ন্ত্রণের অনুরোধ জানিয়েছেন রাজ্য সরকারকে। তাঁর যুক্তি, উৎসবের আগে এ ভাবে সবাই পথে না নামলে আজকের এই দিন দেখতে হত না। একটি করে উদযাপন আসবে আর মানুষ বেলাগাম হবেন। তার পরেই লকডাউনের চেনা ছবি। যার ছায়া পড়বে সাধারণের উপার্জনে। শিল্পীদের টিকে থাকার অস্তিত্বে।