‘মিশন: ইমপসিবল ডেড রেকনিং পার্ট ওয়ান’-এর পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত।
অতিমারি ও লকডাউনের প্রভাবে বেশ কিছুটা বদল এসেছিল বিনোদন জগতে। তারকা নয়, মুখ্য চরিত্র হিসাবে আলোয় উঠে এসেছিল সিনেমার (ও সিরিজ়ের) বিষয়বস্তুই। তৈরি হয়েছিল এক নতুন ধারা। অতিমারি পরবর্তী সময়ে সেই ধারাই বজায় রাখার চেষ্টা জারি রেখেছেন সিনেনির্মাতারা। তবে চলতি বছরে উল্লেখযোগ্য ভাবে সেই ধারায় পরিবর্তন ঘটেছে। ফের চর্চায় ফিরেছেন তারকারা। বক্স অফিসে রমরমিয়ে ব্যবসা করছে তাঁদের ছবি। বলিউডে শাহরুখ খান হলে, হলিউডে রয়েছেন টম ক্রুজ়ের মতো সুপারস্টার। অতিমারির প্রভাব কাটিয়ে গত বছরই ‘টপ গান: ম্যাভেরিক’-এর মাধ্যমে প্রেক্ষাগৃহে সদর্পে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন হলিউডের অন্যতম এই জনপ্রিয় নায়ক। তার প্রায় এক বছর পরে প্রেক্ষাগৃহে ফের আবির্ভাব টম ক্রুজ়ের। এ বার তাঁর পরিবেশনা, ‘মিশন: ইমপসিবল— ডেড রেকনিং পার্ট ওয়ান’।
সিআইএ-এর মতো সংস্থা যে সব রহস্য ভেদ করতে পারে না, ‘এমআই ৬’ যে সন্ত্রাসবাদীদের বাগে আনতে পারে না— সেই সব ‘মিশন’ নির্বিকারে গ্রহণ করে ‘আইএমএফ’, তথা ‘ইমপসিবল মিশন ফোর্স’। আইএমএফ-এর অন্যতম প্রধান এজেন্ট ইথান ম্যাথু হান্ট। কোডের ভাষায় বললে যার নাম ‘ব্র্যাভো একো ওয়ান ওয়ান’। হান্ট আইএমএফের সেই ওস্তাদ, যার কোনও মার নেই। সে চলন্ত বিমানের ডানায় চেপে উদ্ধার করতে পারে বিস্ফোরক ভর্তি ক্যুরিয়ার, আবার মাথায় তেজস্ক্রিয় ক্যাপসুল ফেটে গেলেও মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসতে পারে সে। তিন মিনিটের বেশি সময় জলের তলায় শ্বাস বন্ধ করে থেকে বদলে দিতে পারে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মেমোরি চিপ। আবার হেলিকপ্টারের রুদ্ধশ্বাস লড়াই শেষে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়েও প্লুটোনিয়ামের বোমা নিষ্ক্রিয় করার ক্ষমতা রাখে সে। যে মিশন সফল হওয়ার কোনও আশা নেই, সেই মিশনে সহকর্মী ও বন্ধুরা ভরসা রাখে ইথান হান্টের উপরে.. অনেকটা ‘‘হান্ট হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’’-এর আদলে! এই ভরসার জায়গা স্রেফ ইথান, না কি তার নেপথ্যে ভূমিকা রয়েছে টম ক্রুজ়েরও? ‘মিশন: ইমপসিবল’ দেখতে বসে একাধিক বার মাথার মধ্যে এই প্রশ্ন ঘুরপাক খায়।
১৯৯৬ সাল থেকে শুরু ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির। চলতি বছরে ২৭-এ পা দিল টম ক্রুজ়ের এই ‘অ্যাকশন সাগা’। টম ক্রুজ় নিজে পা দিলেন ৬১-তে, চলতি মাসেই। আমেরিকান এই তারকা অভিনেতার বয়সের বিষয়ে আগে থেকে না জানলে পর্দায় দেখে তাঁর বয়স ঠাহর করতে পারলে বুঝতে হবে, আপনি নিজেই এক অসাধ্যসাধন করে ফেলেছেন! ৬১-তেও তাঁর গতির সঙ্গে পাল্লা দেওয়া ‘ইমপসিবল’ বললে ভুল বলা হয় না। সেই গতির ছাপ রয়েছে ‘মিশন: ইমপসিবল’ ফ্র্যাঞ্চাইজ়িতেও। একের পর এক ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির পাকে পড়ে অন্যান্য হলিউডের ছবির মতো জোলো হয়ে যায়নি ‘মিশন: ইমপসিবল’ সিরিজ়। তার অন্যতম কারণ টম ক্রুজ় নিজে। বা হয়তো ইথান হান্ট। আসলে ‘মিশন: ইমপসিবল’-এর কোথায় টম ক্রুজ়ের শেষ আর কোথায় ইথান হান্টের শুরু, তা খুঁজে বার করা বেশ দুরূহ কাজ। প্রায় তিন দশক ধরে এই চরিত্রেই অপ্রতিরোধ্য তিনি। সিনেমার জগতে সেই যাপন আর সাফল্য কোথাও গিয়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়াটাই বোধহয় স্বাভাবিক।
গত ছ’টি ছবিতে একাধিক মিশনের মুখোমুখি হয়েছে ইথান। কখনও সম্ভাব্য অতিমারির হাত থেকে গোটা বিশ্বকে বাঁচিয়েছে সে, কখনও আবার ভয়াবহ সন্ত্রাসবাদী সংস্থার পরিকল্পনা বানচাল করে দিয়েছে নিজের দক্ষতায়। কখনও আবার পরমাণু হামলার মতো ঘটনাও রুখে দিয়েছে নিজের জীবন বাজি রেখে। ‘মিশন: ইমপসিবল— ডেড রেকনিং পার্ট ওয়ান’ ছবিতে এ বার কোনও ব্যক্তি শত্রুর মুখোমুখি নয় সে। বরং এ বার এক অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে লড়াইয়ের ময়দানে নেমেছে হান্ট। মনুষ্যদুনিয়ায় তার কোনও অস্তিত্ব নেই, অথচ ডিজিটাল দুনিয়ার চাবিকাঠি তার হাতে। ‘দ্য এনটিটি’ নামক এই কৃত্রিম মেধার উপরে কব্জা করতে পারলে পায়ের তলায় থাকবে গোটা দুনিয়া। ‘গ্লোবাল ডমিনেশন’ তখন আর স্রেফ মুখের কথা নয়, গোটার দুনিয়ার উপর খবরদারি তখন বাঁ হাতের খেলা। এমন আধুনিক, শক্তিশালী ও তুখোড় বুদ্ধিদীপ্ত শত্রুকে কী ভাবে বাগে আনবে ইথান? এই অসম লড়াই লড়তে গিয়ে কোন বাজি হারবে সে? সেই গল্পের উপর ভিত্তি করেই বাঁধা হয়েছে ‘মিশন: ইমপসিবল— ডেড রেকনিং পার্ট ওয়ান’-এর চিত্রনাট্য। অ্যাকশনে ভরপুর তো বটেই, তবে উল্লেখযোগ্য ভাবে, ‘মিশন: ইমপসিবল’ সিরিজ়ের অন্যান্য ছবির থেকে এই ছবির চিত্রনাট্যের বাঁধুনি অনেক মজবুত, এবং আরও বেশি বাস্তবসম্মত। আধুনিকতার যুগে দাঁড়িয়ে যে ভাবে কৃত্রিম মেধার দৌরাত্ম্যে সঙ্কুচিত হয়ে আসছে মানুষের প্রতিভা ও পারদর্শিতার বৃত্ত, তাতে ‘মিশন: ইমপসিবল’-এর মতো আগাগোড়া মূলধারার বাণিজ্যিক ছবিতে এই ভাবনা প্রশংসার দাবি রাখে।
প্রথম থেকেই কল্পবিজ্ঞান ও অ্যাকশন ঘরানা মিশেছে ‘মিশন: ইমপসিবল’ সিরিজ়ে। ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির প্রথম দু’টি ছবি বাদ দিলে ‘এমআই থ্রি’ থেকে সেই ঘরানায় যুক্ত হয়েছে চরিত্রদের আবেগও। এক জন গুপ্তচরের বা গোপন কোনও সংস্থার এজেন্টের জীবনে বন্ধুত্ব বা প্রেমের জন্য বরাদ্দ কতটা, সেই প্রসঙ্গ বার বার উঠে এসেছে ইথান হান্টের গল্পে। ‘গোস্ট প্রোটোকল’, ‘রোগ নেশন’, ‘ফলআউট’-এর পরে ‘ডেড রেকনিং পার্ট ওয়ান’-এও সেই অ্যাকশন ও ইমোশনের ভারসাম্যের দিকে নজর রেখেছেন চিত্রনাট্যকর ও পরিচালক ক্রিস্টোফার ম্যাককোয়্যারি। টম ক্রুজ় ও তাঁর যুগলবন্দি যে অব্যর্থ, তার প্রমাণ আগেই মিলেছে ‘টম গান: ম্যাভেরিক’-এর মতো ছবিতে। ‘ডেড রেকনিং পার্ট ওয়ান’-এর আগের দু’টি ‘মিশন: ইমপসিবল’ ছবিও পরিচালনা করেছেন ম্যাককোয়্যারিই। তবে আগের দুই ছবিকে যে ‘ডেড রেকনিং পার্ট ওয়ান’ ছাপিয়ে গিয়েছে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। প্রায় ঘণ্টা তিনেকের ছবিতে গল্প আর গতির যে ভারসাম্য এনেছেন পরিচালক, তার তারিফ না করে পারা যায় না। সময়ে সময়ে শ্লথ হয়ে গেলেও আবহসঙ্গীত কখনও ছবিকে ঝিমিয়ে পড়তে দেয়নি। সেই ষাটের দশক থেকে যে ‘থিম’-এর আওয়াজে সজাগ হয়েছেন দর্শক, লালো শ্রিফিনের বাঁধা সেই বৈগ্রহিক সুরে আজও প্রেক্ষাগৃহে বসা দর্শকের রোমাঞ্চ জাগতে বাধ্য।
‘মিশন: ইমপসিবল– ডেড রেকনিং পার্ট ওয়ান’-এর অন্যতম ইউএসপি হল ছবির চরিত্রায়ণ। টম ক্রুজ়ের মতো পোড় খাওয়া তারকা ও অভিনেতার উপর থেকে চোখ সরার নিশ্চয়তা দিতে না পারলেও এ কথা হলফ করে বলা যায় যে, হেইলি অ্যাটওয়েল, রেবেকা ফার্গুসন, ভিং র্যামেস, সাইমন পেগ, ইসাই মরালেস, ভ্যানেসা কার্বির মতো অভিনেতারা আপনার নজর কাড়বেন। বিশেষ করে, হেইলি অ্যাটওয়েল তো বটেই। এর আগে ‘ক্যাপ্টেন আমেরিকা’র পেগি কার্টারের চরিত্রে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। ‘ডেড রেকনিং পার্ট ওয়ান’-এ টম ক্রুজ়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন হেইলি। শুধু তা-ই নয়, অ্যাকশনের দৃশ্যে তাঁর সাবলীল অভিনয় দুরন্ত। ইলসা ফস্ট কেন ‘মিশন: ইমপসিবল’ ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির অন্যতম সেরা চরিত্র, এই ছবিতে আবারও তার প্রমাণ রেখেছেন রেবেকা ফার্গুসন। সিরিজ়ের শেষ তিনটি ছবিতে লুথার (ভিং র্যামেস) ও বেনজি-র (সাইমন পেগ) সঙ্গে টম ক্রুজ়ের রসায়ন দেখে ইতিমধ্যেই অভ্যস্ত দর্শক। এই ছবিতেও সেই সমীকরণে খামতি নেই। তবে কিছুটা হতাশ করবে আলানা মিতসোপলিস-র (ভ্যানেসা কার্বি) চরিত্র। ভ্যানেসার মতো অভিনেত্রীকে সিরিজ়ের একাধিক ছবিতে পেয়েও তেমন ভাবে কাজে লাগাতে পারেননি নির্মাতারা। গোটা ছবিতে একটি শব্দ খরচ না করেও নজর কেড়েছেন অভিনেত্রী পম ক্লেমেনটিফ ওরফে প্যারিস। সিরিজ়ে নবাগত হিসাবে ইসাই মরালেসের পরিমিত অভিনয় বেশ নজরকাড়া। আগামী বছর ‘ডেড রেকনিং পার্ট টু’-এ যে তাঁকে দেখতে মুখিয়ে থাকবেন দর্শক, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
‘অ্যাভেঞ্জার্স’, ‘জেমস বন্ড’, ‘ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস’, ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স’-এর মতো ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির ভিড়ে সিরিজ়ের নিজস্বতা বজায় রাখা খুব একটা সহজ কাজ নয়। বিশেষ করে সেই ছবি অ্যাকশন ঘরানার হলে তো প্রতিযোগিতা আরও বেশি। তার পরেও আর পাঁচটা অ্যাকশন এন্টারটেইনার সিরিজ়কে বলে বলে গোল দিচ্ছে ‘মিশন: ইমপসিবল’। তার অন্যতম কারণ, ছবির গল্পের প্রাসঙ্গিকতা। সেখানে অ্যাকশনের প্রাচুর্য আছে, অবিশ্বাস্য কিছু লক্ষ্যপূরণ আছে। তবে মাদক চক্র বা মাফিয়ার মতো মরীচিকার পিছনে অকারণ ছুটে বেড়ানো নেই। এই অসম্ভবের দুনিয়ায় ইথান হান্ট অব্যর্থ নয়, আবেগহীন নয়। বরং তার মানবিকতা তাকে আরও বেশি বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। সেই রক্ত-মাংসের আবেগের রেশই থেকে যায় শেষ পর্যন্ত।