‘ইন্ডিয়ানা জোন্স অ্যান্ড দ্য ডায়াল অফ ডেস্টিনি’ ছবিতে হ্যারিসন ফোর্ড। ছবি: সংগৃহীত।
আর মাত্র নয় দিন। তার পরেই ৮১-এ পা দেবেন হলিউড অভিনেতা হ্যারিসন ফোর্ড। চোখমুখের কুঁচকে যাওয়া চামড়া, এক মাথা সাদা চুল দেখে তাঁর বয়স ঠাহর করা খুব একটা কঠিন কাজ নয়। নিজের বয়স অবশ্য লুকোতেও চাননি ৮০-র ‘তরুণ’। তবে পর্দায় এলে হ্যারিসন ফোর্ডের কাণ্ডকারখানা দেখে তাঁর বয়সের ভার বিশ্বাস করতে বেশ অসুবিধাই হয়। আশিতেও তাঁর সেই চনমনে তারুণ্যই ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স অ্যান্ড দ্য ডায়াল অফ ডেস্টিনি’ ছবির সব থেকে দামি ইউএসপি।
১৯৮১, ১৯৮৪, ১৯৮৯, ২০০৮। তার ১৫ বছর পরে ২০২৩। চার খণ্ডের অ্যাডভেঞ্চারের পর অবশেষে ভবিতব্যের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছেন হ্যারিসন ফোর্ড তথা ইন্ডিয়ানা জোন্স, ওরফে ইন্ডি। উনিশ শতকের ষাটের দশকের শেষে এসে ইন্ডি আমেরিকার এক কলেজের প্রত্নতত্ত্ববিদ্যার অধ্যাপক। সদ্য অবসর গ্রহণ করেছে। কলেজ থেকে ছুটি পেয়ে সবে স্কচ হুইস্কি নিয়ে বসেছে। সেখানেই আবির্ভাব ফিবি ওয়ালার-ব্রিজ তথা হেলেনা শয়ের। ইন্ডির প্রিয় বন্ধু এবং এক সময়ের সহযোগী বেসিল শয়ের মেয়ে হেলেনা। বাবা প্রয়াত হয়েছে বটে, তবে প্রত্নতত্ত্ববিদ্যা নিয়ে মেয়ের উদ্দীপনা বাবার চেয়ে কিছু কম নয়। ইন্ডি আবার সম্পর্কে হেলেনার ‘গডফাদার’। দুইয়ে মিলে যে নতুন অ্যাডভেঞ্চারে বেরোবে তারা, তা বুঝতে পারার জন্য আহামরি কোনও বুদ্ধিমত্তা লাগে না।
কী সেই অ্যাডভেঞ্চার? সেই উত্তর পেতে হলে আরও একটু পিছিয়ে যেতে হবে ১৯৪৪ সালে। হিটলার-রাজের একেবারে শেষের দিকে। প্রাচীন দ্রব্যাদি বোঝাই ট্রেনে জার্মানি ফিরছে হিটলারের অনুগত সেনা। তার মধ্যে রয়েছে ‘ল্যান্স অফ লনজিনাস’, ‘অ্যান্টিকাইথেরা’র মতো একাধিক জিনিস। ‘ল্যান্স অফ লনজিনাস’ নিয়ে ফুয়েরার হিটলারের উৎসাহ অপরিসীম। তবে, ট্রেনে উপস্থিত হিউরগেন ভলারের কৌতূহল ‘অ্যান্টিকাইথেরা’ নিয়ে। গ্রিক গণিতজ্ঞ আর্কিমিডিস আবিষ্কৃত এই যন্ত্র নাকি সময়কে গাঁথতে পারে এক সুতোয়। এই যন্ত্রের সাহায্যে নাকি সম্ভব অতীতে পৌঁছে যাওয়া। হিটলারের মতো স্বৈরতন্ত্রীর হাতে এমন যন্ত্র গেলে যে দুর্দশার শেষ থাকবে না, তা জানত ইন্ডি। জার্মান সেনায় ভরা ট্রেন থেকে সহযোগী বেসিলের সাহায্যে সেই ‘অ্যান্টিকাইথেরা’ উদ্ধার করে সে।
তার পরে কেটে গিয়েছে প্রায় ২৫ বছর। প্রয়াত হয়েছে বেসিল। ইন্ডির একমাত্র ছেলে মারা গিয়েছে ভিয়েতনাম যুদ্ধে। স্ত্রী ম্যারিয়নও ছেড়ে চলে গিয়েছে তাকে। এখন একেবারেই একাকী ইন্ডি। এর মধ্যেই আবির্ভাব হেলেনার। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, চোখেমুখে কৌতূহলের ছাপ স্পষ্ট। অ্যান্টিকাইথেরার অর্ধেক অংশ রয়েছে ইন্ডির কাছে। বাকি অর্ধেক খুঁজে বার করতেই হবে তাকে। অন্য দিকে তাদের পিছু নিয়েছে ভলার ও তার দলবল। হিটলার জমানা শেষ হয়েও যাওয়ার পরে নামবদল করে এখন যে স্মিড্ট, আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। নাম বদলে নিলেও এখনও ভলারের লক্ষ্য এক— যেনতেনপ্রকারেণ অ্যান্টিকাইথেরা হাতে পাওয়া।
কী ভাবে ইন্ডি আর হেলেনা উদ্ধার করবে অ্যান্টিকাইথেরার দু’টি ভাগ, কী ভাবেই বা ভলারের গ্রাস থেকে দূরে রাখবে আর্কিমিডিস-আবিষ্কৃত এই অভিনব যন্ত্র— সেই উত্তর মিলবে ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স অ্যান্ড দ্য ডায়াল অফ ডেস্টিনি’ ছবিতে। তবে এই উত্তর চটজলদি বানিয়ে ফেলা ইনস্ট্যান্ট নুড্লস নয়, প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে অল্প আঁচে রান্না করা পদ। নুন, ঝাল ও মশলার ভারসাম্য রাখতে গিয়ে যা রান্না করতে কিছুটা সময় লেগেছে বটে, তবে শেষ পর্যন্ত পরিবেশন করা পদ বেশ সুস্বাদু।
আশির কোঠায় এসে ছবির দায়িত্বের প্রায় ৭০ শতাংশই নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন হ্যারিসন ফোর্ড। বার নয়েক গুলি খেয়েছেন ইন্ডি হিসাবেই। কাঁধেও যথেষ্ট চোট আছে। দুই পায়ের একটায় বসানো প্লেট, আর একটায় একাধিক স্ক্রু। তার পরেও ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স’ ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির পঞ্চম ছবিকে হোঁচট খেতে দেননি আশির তরুণ। একের পর এক অ্যাকশন দৃশ্যে অভিনয় করেছেন নিজের বয়সের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে। বয়স বাড়ায় গতি কমেছে বটে, তবে শ্লথ হয়ে যাননি অভিনেতা। গুহার গা বেয়ে ওঠার সময় তাঁকে বেশ কয়েক বার দম নিতে হয়েছে বটে, পিছিয়েও পড়েছেন মাঝেমধ্যে। তবে থামেননি তিনি। ঠিক যেমন, অবসরের দোরগোড়ায় এসেও অ্যাডভেঞ্চারের হাতছানিকে এড়িয়ে যায়নি ইন্ডিয়ানা জোন্স নিজে।
হেলেনা শয়ের চরিত্রে ফিবি ওয়ালার-ব্রিজ নিখুঁত। প্রায় নিখুঁত নন, তিনি সত্যিই নিখুঁত। ‘ফ্লিব্যাগ’, ‘ক্র্যাশিং’-এর মতো মিনি সিরিজ়ে নজর কাড়ার পরে ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স’-এর মতো ফ্র্যাঞ্চাইজ়িতে সুযোগ পাওয়া ফিবির যোগ্য উত্তরণ। এত দিন চিত্রনাট্য লেখা, নাটক পরিচালনা করাতেই বেশি মন দিয়েছেন ফিবি। এ বার চুটিয়ে অভিনয়ও করছেন তিনি। হ্যারিসন ফোর্ডের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নজর কেড়েছেন হেলেনার চরিত্রে। ছবিতে হেলেনার সংলাপও যথেষ্ট শক্তিশালী। ইন্ডির মুখে মুখে কথা বলার সময় মশকরা করতেও ছাড়েনি তার ‘গ়ডডটার’। তবে ইন্ডি আর হেলেনার এই যুগলবন্দি বাঙালিদের দেখা চিরাচরিত যুগলবন্দির থেকে বেশ আলাদা। ফেলুদা-তোপসে বা শার্লক-ওয়াটসনকে বাদ দিলে কাকাবাবু-সন্তু, সোনাদা-আবিরের জুটির মধ্যে পারিপার্শ্বিক জ্ঞানে যে অসামঞ্জস্য আছে— তা ইন্ডি আর হেলেনার জুটির মধ্যে প্রায় নেই বললেই চলে। বয়স ও অভিজ্ঞতার দিক থেকে হেলেনা ইন্ডির থেকে অনেক ছোট। তবে প্রত্নতত্ত্ববিদ্যা, বিভিন্ন ধরনের ভাষা ও সঙ্কেত নিয়ে হেলেনার যা পড়াশোনা, তা নিয়ে ইন্ডিকে টেক্কাও দিতে পারে সে। ইন্ডি নিজের এত বছর ধরে আহরণ করা জ্ঞান বিতরণ করছেন আর হেলেনা নিষ্পলক দৃষ্টিতে তা শুনছে, এমন দৃশ্য ছবিতে নেই বললেই চলে। দুই অসমবয়সি চরিত্রের মধ্যে এই সামঞ্জস্য বেশ নতুন। তাই আড়াই ঘণ্টার ছবিতেও ক্লান্ত হওয়ার সময় বিশেষ মেলেনি।
ছবির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘুঁটি টেডি, হেলেনার নিত্যসঙ্গী। বয়স তার ১৫-১৬-র বেশি নয়, কিন্তু বুদ্ধির দিক থেকে তুখোড়। তার চরিত্রে ভীষণ মানিয়েছে ইথান ইসিডোরকে। তবে ছবির খলনায়ক তথা ভলারের ভূমিকায় ম্যাডস মিকেলসন একেবারেই ফ্যাকাশে। বা বলা ভাল, তাঁর অভিনয় বড়ই একঘেয়ে। না হলে ভলারের মতো জাত্যান্ধ ও ক্রূর চরিত্রকে আরও রসিয়ে পরিবেশন করার সুযোগ ছিল। নতুন ভাবে সেই চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার পথে না হেঁটে বরাবরের গোমড়ামুখো খল চরিত্রকেই আরও এক বার তুলে এনেছেন ম্যাডস মিকেলসন।
তবে ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স অ্যান্ড দ্য ডায়াল অফ ডেস্টিনি’র সবথেকে বড় পাওনা বোধহয় ছবির উত্তরাধিকার। জর্জ লুকাস সৃষ্ট এক চরিত্রের উপর ভিত্তি করে যে পরম্পরার অবতারণা করেছিলেন স্টিভেন স্পিলবার্গ, সেই সুতো আলগা হতে দেননি পরিচালক জেমস ম্যানগোল্ড। এর আগে ‘লোগান’, ‘দ্য উলভরাইন’, ‘ফোর্ড ভার্সেস ফেরারি’র মতো ছবিতে নিজের যোগ্যতার উদাহরণ দিয়েছেন ম্যানগোল্ড। যন্ত্রের সঙ্গে আবেগের মিশেলে তৈরি করেছেন নিজস্ব শৈলি। ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স’ ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির পঞ্চম ছবির মাধ্যমেও ফের সেই ঘরানাকেই আলোয় এনেছেন ম্যানগোল্ড। নেপথ্যে থেকেও সজাগ দৃষ্টি রেখেছেন প্রযোজক স্টিভেন স্পিলবার্গ। ছবির একাধিক অ্যাকশন দৃশ্যেই মিলেছে তার প্রমাণ। অ্যাকশনে ভরপুর ছবি হওয়া সত্ত্বেও ‘মার্ভেল’ বা ‘মিশন: ইমপসিবল’ ঘরানার ছাপ নেই ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স অ্যান্ড দ্য ডায়াল অফ ডেস্টিনি’তে। গুরুগম্ভীর মারামারি থেকে সরে অ্যাকশনের মধ্যে বাৎসল্য এনেছেন পরিচালক। বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই অ্যাকশন দৃশ্যে হ্যারিসন ফোর্ড তথা ইন্ডিয়ানা জোন্সকে ক্যামেরায় ধরেছেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, একের পর এক ছাদ টপকে পালিয়ে যাওয়ার সময় ফিবি তথা হেলেনাকে দেখেও মনে হয়, চেষ্টা করলে এমন অ্যাকশন তো আর পাঁচজন সাধারণ মানুষও করতেই পারেন। আলাদা করে উল্লেখ করতে হয় ছবির আবহ সঙ্গীতের কথা। ৯১-এর জন উইলিয়ামসের সুরের ছোঁয়ায় আরও ধারালো হয়ে উঠেছে ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স অ্যান্ড দ্য ডায়াল অফ ডেস্টিনি’র প্রতিটি দৃশ্য।
তবে ছবিতে যে আকাশকুসুম কল্পনার উড়ান একেবারে নেই, তা বলা যায় না। ‘ওয়ান্টেড’-এর তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও বিমানে করে দিব্যি দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া দেখেও কপালে ভাঁজ পড়তে বাধ্য। অ্যান্টিকাইথেরার সাহায্যে সময়ের চাকা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার বিষয়টা একেবারেই অলীক। বুকের বাঁ দিকে গুলি খেয়েও ইন্ডির সুস্থ-সবল হয়ে ওঠা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই সঙ্গত। তবে ওই যে... ইন্ডিয়ানা জোন্স ছবিতে নিজেই বলেছে, ‘‘তুমি কিসে বিশ্বাস রাখো, সেটা বড় ব্যাপার নয়। তুমি কতটা বিশ্বাস রাখো, সেটাই আসল।’’ ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স’ ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির শেষ ছবি দেখে বেরোনোর সময় এই সংলাপেরই রেশ থেকে যায়।