ওয়েব সিরিজ ‘কাঁটায় কাঁটায়’। ছবি: সংগৃহীত।
সত্যান্বেষী ব্যোমকেশের পর বাংলায় গোয়েন্দার অভাব তাঁকে পীড়িত করেছিল, খানিক এই খেদই ব্যক্ত করেছিলেন নারায়ণ সান্যাল তাঁর ‘কাঁটায় কাঁটায়’ যখন খণ্ডবন্দি হয়ে প্রকাশিত হতে শুরু করে, তার প্রথম খণ্ডের ভূমিকায়। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদাহরণ রেখেই সেখানে লিখেছিলেন প্রখ্যাত বিশ্বসাহিত্যকর্মের বঙ্গীকরণে তিনি আগ্রহী। অ্যান্টনি হোপের ‘প্রিজ়নার অফ জ়েন্ডা’ থেকে ‘ঝিন্দের বন্দি’র রূপান্তরণে তিনি আনন্দিত ছিলেন। খানিকটা সেই প্রেরণাতেই আর্লে স্ট্যানলি গার্ডনারের প্রেই ম্যাসন আর আগাথা ক্রিস্টির এরকুল পোয়ারোর মিশ্রণেই সৃষ্টি করেন ব্যারিস্টার পিকে বাসু চরিত্রটি। প্রথম উপন্যাস ‘নাগচম্পা’ লেখার সময় তিনি ভাবেননি যে, একের পর এক পিকে বাসু-কাহিনি তাঁকে লিখে যেতে হবে। আর সেই সিরিজ়টির নাম হবে ‘কাঁটায় কাঁটায়’। এখানেও কি শরদিন্দু ছায়া ফেলেছিলেন? কারণ, শরদিন্দুর লেখা প্রথম ব্যোমকেশ- কাহিনির নাম ‘পথের কাঁটা’ (‘সত্যান্বেষী’ লেখেন পরে)। ‘নাগচম্পা’ যাত্রিক গোষ্ঠির পরিচালনায় চলচ্চিত্রায়িত হয় ‘যদি জানতেম’ নামে ১৯৭৪ সালে। পিকে বাসুর ভূমিকায় ছিলেন উত্তমকুমার। সেই বছরই নারায়ণ সান্যাল ‘কাঁটা সিরিজ়’-এর জন্ম দেন। ‘নাগচম্পা’র সিকুয়েল হিসাবে প্রকাশিত হয় ‘সোনার কাঁটা’।
একটি ওয়েব সিরিজ়ের সমালোচনা লিখতে বসে উপরের তথ্যগুলিকে ধান ভানার সময় শিবের গীত গাওয়া বলে ধরলে খানিক ভুল হবে। কারণ, জয়দীপ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘কাঁটায় কাঁটায়’ দেখতে শুরু করতেই এই সব তথ্য যাঁরা জানেন, তাঁরা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়তেই পারেন। ‘যদি জানতেম’ ছবিটি শেষ হয়েছিল একটি খুনের মামলার বিচার দিয়ে। সেখানে পিকে বাসুর সওয়ালে ধরা পড়ছে খুনি, মুক্তি পাচ্ছে অভিযুক্ত সুজাতা। ‘কাঁটায় কাঁটায়’ সিরিজ়টিও শুরু হচ্ছে সেই বিচার দিয়েই। তবে এখানে বহু কিছুই পরিবর্তিত। পিকে বাসু এখানে ব্যারিস্টার নন, অ্যাডভোকেট। অভিযুক্ত সুজাতার প্রেমিক কৌশিক। পিকে বাসুর সওয়ালেই ধরা পড়ে নয়ন সামন্ত নামে এক ব্যক্তি, যে কিনা প্রকৃত হত্যাকারী। পরিচালক যখন ‘কাঁটা সিরিজ়’-এর মতো একটি টেক্সটে হাত দিলেন, তখন ১৯৭৪-এর পরিমণ্ডল থেকে কাহিনিকে বার করে নিয়ে এসে ২০২৪-এর পটভূমিকায় ফেলার জন্য বেশ গুরুভার দায় যে তিনি কাঁধে নিয়েছিলেন, সন্দেহ নেই। তার উপর পিকে বাসুকে দ্বিতীয় বার পর্দায় হাজির করার জন্য যে অভিনেতাকে তিনি বেছেছেন, তাঁর উপরে আরও বড় দায় ছিল উত্তমকুমার নামের এক ‘ধারণা’র দীর্ঘ ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে চরিত্রটিকে নবকলেবরে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার। শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় সেই কাজটি যে বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে করতে পেরেছেন, সন্দেহ নেই।
পরিচালকের আরও বড় দায় ছিল কাহিনি নিয়ে। নারায়ণ সান্যালের ‘সোনার কাঁটা’ আগাথা ক্রিস্টির ‘মাউসট্র্যাপ’ নাটকের বঙ্গীকরণ। এর আগে একই কাহিনিকে বাংলায় চলচ্চিত্রায়িত করেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র ‘চুপি চুপি আসে’ নামে। বাংলার নামী নাট্যদল ‘মাউসট্র্যাপ’ প্রযোজনা করেছে ইন্দ্রাশিস লাহিড়ির অনুবাদে ‘মরবে ইঁদুর বেচারা’। সুতরাং সেই ‘জানা’ গল্পটিকে, সেই অতিপরিচিত ‘হুডানইট’কে আবার পর্দাসই করতে বিশেষ মুনশিয়ানার দরকার ছিল। উল্লেখ্য, জয়দীপও সেই কাজটি দক্ষতার সঙ্গেই করতে পেরেছেন। ‘নাগচম্পা’ থেকে ‘সোনার কাঁটা’— এই যাত্রাপথটিকে নির্মাণ করতে গিয়ে তিনি এই সিরিজ়ে যুক্ত করেছেন পিকে ও তার স্ত্রী রানি বাসুর জীবনের ট্র্যাজেডি, তাদের একমাত্র সন্তান মিঠুর মৃত্যু। যাকে মূল কাহিনিতে দুর্ঘটনা হিসাবে দেখানো হলেও, তা ছিল এক পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয় একের পর এক হত্যা, যা গিয়ে ঠেকে দার্জিলিং শহরের নিকটবর্তী এক নির্জন ‘হোম স্টে’তে।
নারায়ণ সান্যালের উপন্যাসে মূল কাহিনির প্রতি ঋণস্বীকার করতে এক চরিত্রের হাতে ক্রিস্টির ‘মাউসট্র্যাপ’ দেখানো হয়েছিল। অতীতের টেক্সটগুলিকে মাথায় রেখে জয়দীপও তাঁর সিরিজ়ের বিভিন্ন পর্বের নামে উল্লেখ রেখেছেন সেই সব সূত্রের। কখনও পর্বের নাম ‘হারানো সুর’, কখনও ‘যদি জানতেম’, কখনও বা ‘থানা থেকে আসছি’। সুতরাং, পরিচালক যে নারায়ণ সান্যাল এবং উত্তমকুমারকে মনে রেখেই তাঁর সিরিজ় সাজিয়েছেন, তা স্পষ্ট। পর্বনামগুলি চোখে পড়তেই মনে আশা জাগে, সিরিজ়ের বাজারে যখন থ্রিলার তথা রহস্য-রোমাঞ্চের ঢল, তখন গতানুগতিকতার বাইরে কোনও স্বাদ পেলেও পাওয়া যেতে পারে। উত্তমের প্রলম্বিত ছায়া থেকে একেবারেই সরে আসা শ্বাশ্বত বা রানি বসুর ভূমিকায় অনন্য চট্টোপাধ্যায় পর্দায় দেখানো ব্যোমকেশ ও সত্যবতীর পুনরাবৃত্তি নয়। ‘যদি জানতেম’-এর হুইলচেয়ারবন্দি রানি বাসু এখানে ক্র্যাচ নিয়ে হাঁটে। এবং মাঝেমাঝেই মৃতা মেয়ে মিঠুকে দেখতে পায়। পিকে সেই দর্শনকে প্রাথমিক ভাবে বিভ্রম বলে মনে করলেও এক সময় সে-ও দেখতে পায় মৃতা মেয়েকে। থ্রিলারের সঙ্গে মেশে অতিপ্রাকৃত। এমন ক্ষেত্রে পরিচালককে প্রায় ট্র্যাপিজ় খেলোয়াড়ের দক্ষতায় সরু তারের উপর দিয়ে হাঁটতে হয়। যে কোনও মুহূর্তে কাহিনি রহস্যের এলাকা থেকে গিয়ে পড়তে পারে ‘মৃতের প্রতিশোধ’-মার্কা অতিপ্রাকৃতের দিকে। জয়দীপ বেশ দক্ষ ভাবেই সেই সমস্যা সামলিয়েছেন। ফলে ‘কাঁটায় কাঁটায়’ হয়ে উঠেছে আদ্যোপান্ত থ্রিলার বা আরও সঠিক ভাবে বললে ‘হুডানইট’।
‘মাউসট্র্যাপ’-এর মতো কাহিনিতে সবচেয়ে বড় প্যাঁচটি থাকে ‘হত্যাকারী কে’ বা গোয়েন্দা সাহিত্যের ভাষায় ‘হুডানইট’-এর উপর। আর এখানেই তৈরি হয় একের পরে এক সন্দেহভাজন চরিত্র। যাদেরকে রহস্যকাহিনির লব্জে ‘রেড হেরিং’ বলা হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিচ্ছিন্ন একটি বাড়ি। সেখানে কেউ একজন খুন হবে, নিশ্চিত। আর সেখানেই একের পর এক সন্দেহভাজন চরিত্রের আমদানি ক্রিস্টি বা তাঁর সমসাময়িক রহস্যকাহিনি লেখকদের সাহিত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই সিরিজ়েও একের পরে এক ‘রেড হেরিং’ তাদের স্বতন্ত্র মহিমায় ভাস্বর। কখনও অস্ত্র দেখিয়ে, কখনও বা বিদঘুটে আচরণ দিয়ে তারা তদের লাল হেরিং-পনা চালিয়ে যায়। এখানে জয়দীপ এবং চিত্রনাট্যকার পদ্মনাভ দাশগুপ্ত খোলা হাতে খেলার সুযোগ দিয়েছেন অভিনেতাদের। ফলে গোয়েন্দা কাহিনির ভার সপাটে গোয়েন্দার কাঁধে গিয়ে পড়ে না। ধীরে অথচ বেশ পোক্ত কেতাতেই তা ছড়াতে থাকে পর্দায়, পর্ব থেকে পর্বান্তরে। উল্লেখ্য, নুর আলি বেগ চরিত্রে কিঞ্জল নন্দের অভিনয়। খানিক নাটুকে এক চরিত্র। তার নাটুকেপনাই লাল হেরিং হিসাবে তাকে দাগিয়ে দেয়। বেশ উচ্চগ্রাম দরকার এ জাতীয় অভিনয়ে। কিঞ্জল সেই কাজটি ওস্তাদির সঙ্গেই করেছেন। সমান্তরালে বাকি লাল হেরিংরাও তাল দিয়েছেন। তবে সোহম চক্রবর্তীর প্রবেশের পর থেকে যবনিকাপাত পর্যন্ত যেন একটু তাড়াহুড়ো চোখে পড়ল। শেষ দৃশ্যে খুনিকে ধাওয়া করার বিষয়টিও সমস্যার। কারণ ক্রিস্টি থেকে শরদিন্দু— ‘হুডানইট’-এর লম্বা লিস্টিতে রহস্য ও রোমাঞ্চ থাকলেও যবনিকা নেমে আসার আগে ‘অ্যাকশন’ নেই। এডগার অ্যালান পো-র দুপাঁ থেকে কোনান ডয়েলের শার্লক হোমস হয়ে ক্রিস্টির মিস মার্পল বা পোয়ারো পর্যন্ত রহস্য লম্বমান হয় তার ধীর গতির জন্যই। শরদিন্দু বেগবান ভাষায় ব্যোমকেশ কাহিনি লিখলেও ঘটনাপ্রবাহে হুটোপাটি করার লোক ছিলেন না। পিকে বাসু-কাহিনিগুলিতেও নারায়ণ সান্যাল সেই মন্থরতাকেই আয়ুধ হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন। সেখানে পশ্চাদ্ধাবন ক্রিয়ার অবতারণা খানিক রসভঙ্গ করে।
এই মুহূর্তে বাংলা-হিন্দি-তামিল-তেলুগু ব্যেপে রহস্য সিরিজ়ের ঢল। এমনকি বাঙালির পাঞ্জাবি গায়ে চাপিয়ে শার্লক হোমস মশাইও উপস্থিত। এ হেন পরিস্থিতিতে আজি হতে আধা শতাব্দী আগেকার কাহিনিকে নিয়ে এগোতে চাইছেন জয়দীপ। শাশ্বত বা অনন্যার মতো দক্ষ অভিনেতার পক্ষে সেই স্পিরিটকে ধরে ফেলা সহজ। আর সেখান থেকেই আশা জাগে, বাংলা রহস্য সিরিজ়ে হারিয়ে যাওয়া ‘হুডানইট’-এর মন্থর অথচ শ্বাসরোধী পরিমণ্ডল কি ফিরবে? ফিরবে কি ‘চুপি চুপি আসে’ বা ‘যদি জানতেম’-এর উত্তরাধিকার? ‘কাঁটা সিরিজ়’ বেছে নিয়ে সাহসের পরিচয় দিয়েছেন জয়দীপ। আশা জাগিয়েছেন। অপেক্ষা পরবর্তী ‘কাঁটা’র জন্য।