‘হার্ট অফ স্টোন’-এ আলিয়া ভট্ট। ছবি: সংগৃহীত।
হলিউডে এখন ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ (এআই) তথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগ। ক্যামেরার সামনে ও নেপথ্যে— সাম্প্রতিক কালে দুই ক্ষেত্রেই এআই নিয়ে নাড়াচাড়া করার প্রবণতা বেড়েছে হলিউডে। তার প্রভাবও পড়েছে সিনেমা ও সিরিজ়ে। চিত্রনাট্য লেখার কাজে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বাড়ায় আন্দোলনে নেমেছেন হলিউডের লেখক ও চিত্রনাট্যকারেরা। তাঁদের সঙ্গে ধর্মঘটে যোগ দিয়েছেন তাবড় অভিনেতারাও। আন্দোলন ও ধর্মঘটের জেরে প্রায় স্তব্ধ হলিউড। স্থগিত রাখা হয়েছে একাধিক সিনেমা ও সিরিজ়ের শুটিং। প্রায় ছয় দশক পরে এই মাপের প্রতিবাদ কর্মসূচি প্রত্যক্ষ করছে হলিউড। এ দিকে, এআই-এর তার ব্যবহারিক প্রয়োগ ও সম্ভাবনা নিয়ে কৌতূহলী সাধারণ মানুষও। স্বাভাবিক ভাবেই, মানুষের সেই উৎসাহকে কাজে লাগিয়ে সিনেমা ও সিরিজ়ের পর্দায় উত্তরোত্তর উঠে আসছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। মাসখানেক আগেই মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মিশন: ইমপসিবল– ডেড রেকনিং পার্ট ওয়ান’ ছবিতে এই ‘অদৃশ্য’ শত্রুর মোকাবিলা করেছে ইথান হান্ট (টম ক্রুজ়)। মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতার বশে কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, তার ঝলক, ইতিমধ্যেই দেখেছেন দর্শক। সেই ধারণাকে মাথায় রেখেই তৈরি ‘হার্ট অফ স্টোন’।
‘ওয়াইল্ড রোজ়’ খ্যাত ব্রিটিশ পরিচালক টম হার্পারের ছবি। ছবিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন গ্যাল গ্যাডোট, জেমি ডর্নান ও আলিয়া ভট্ট। এই দেশের দর্শকের কাছে এই ছবি খুবই কাছের। কারণ, বলিউড অভিনেত্রী আলিয়ার হলিউড অভিষেক এই ছবির মাধ্যমেই। ছবি বিশেষ বটে, তবে সেই ছবির গল্পের মধ্যে কোনও বিশেষত্ব নেই। ‘মিশন: ইমপসিবল’ ও ‘ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস’ ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির কিছু ছবি দেখে নিলেই ‘হার্ট অফ স্টোন’ মোটামুটি জলবৎ তরলং। ছবি ‘থ্রিলার’ ঘরানার হলেও তাতে থ্রিল একেবারে নেই বললেই চলে। বরং গোড়ার দিকে দাবার বোর্ডে কোন ঘুঁটি কোথায়, তা স্পষ্ট হয়ে গেলে বাকি ছবির গল্প অনেকটাই আন্দাজ করা যায়।
এমআই৬-এর টেকনিক্যাল এজেন্ট হিসাবে কাজ করে র্যাচেল স্টোন (গ্যাল গ্যা়ডোট)। তার দলের অন্য তিন সহকর্মীদের মধ্যেই এক জন পার্কার (জেমি ডর্নান)। এক অস্ত্র ব্যবসায়ী মালভেনিকে পাকড়াও করার মিশন নিয়ে আল্পসের এক ক্যাসিনোয় গিয়ে উপস্থিত হয় চার সদস্যের ওই এমআই৬ দল। সেখানেই জানতে পারা যায়, স্টোন আদপে এক জন আন্ডারকভার এজেন্ট, যে এমআই৬-এর সঙ্গে কাজ করছে নিজের সংস্থার স্বার্থে। কী সেই সংস্থা? ওই সংস্থার নাম ‘চার্টার’। তারা কী কাজ করে? প্রিয়ঙ্কা চোপড়ার স্পাই সিরিজ় ‘সিটাডেল’-এর কথা মনে আছে? গোটা বিশ্বকে সব রকমের বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে যেখানে এসে জড়ো হন বিভিন্ন দেশের সেরার সেরা গুপ্তচরেরা? ‘চার্টার’ একেবারে সেই সংস্থাই। শুধু অন্য ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি বলে সেই সংস্থার নাম আলাদা। নানা দেশের নানা সরকারের হাতের পুতুল হয়ে থাকতে নারাজ ‘চার্টার’-এর এজেন্টরা। গোটা বিশ্বের স্বার্থই ‘চার্টার’-এর বৃহত্তর স্বার্থ। এ দিকে, স্টোন আন্ডারকভার এজেন্ট হওয়ায় তার এই পরিচয় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয় তার দলের অন্য তিন সদস্য। তাদের চোখে ফিল্ড এজেন্ট হওয়ার দক্ষতা নেই স্টোনের। দলের তিন সদস্য যখন এমন ভাবছে, সেই সময়েই আল্পসের বুকে দুরন্ত স্কিয়িং করে বেড়াচ্ছে র্যাচেল।
অন্য দিকে, এমআই৬-এর মালভেনিকে পাকড়াও করার মিশনের মাঝে বাধ সাধে এক টেক প্রডিজি। তার নাম কেয়া ধওয়ান। এই চরিত্রেই অভিনয় করেছেন আলিয়া। এমআই৬ বা চার্টারের সঙ্গে তার শত্রুতার কোনও বিশেষ কারণ নেই, স্রেফ নিজের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে স্টোনের মিশন বানচাল করতে উঠেপড়ে লাগে সে। মিশনের খাতিরে লিসবনে গিয়ে চার সদস্যের ওই দল স্টোনের আসল পরিচয় জানতে পারে। লিসবনে গাড়ির নিয়ে যে চেজ় দৃশ্যে দেখানো হয়েছে ‘হার্ট অফ স্টোন’-এ, তা দেখলে ‘মিশন: ইমপসিবল– ডেড রেকনিং পার্ট ওয়ান’-এ হলুদ গাড়ির চেজ় দৃশ্যের কথা মনে পড়তে বাধ্য। টম হার্পারের ছবির যতটুকু ‘থ্রিল’, তা শুধুমাত্র ওই দৃশ্যেই। তার পর থেকে বাকি ছবির গোটাটাই বেশ একরৈখিক।
চার্টারের চারটি ভাগ। ‘হার্ট’, ‘ক্লাব’, ‘স্পেড’ ও ‘ডায়মন্ড’— তাসের এই চারটি প্রতীকের নামে বিভক্ত গোটা সংস্থা। র্যাচেল স্টোন ‘হার্ট’-এর অন্যতম সদস্য। চার্টারের সব কাজকর্ম পরিচালিত হয় একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে, যার নাম ‘হার্ট’। ‘ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস’-এ ‘বার্ডস আই’-এর মাধ্যমে বিশ্বের যে কোনও জায়গা থেকে খুঁজে বার করে ফেলা যেত যে কোনও ব্যক্তিকে। ‘হার্ট অফ স্টোন’-এর ‘হার্ট’ বিশ্বের যে কোনও সিস্টেম হ্যাক করতে সমর্থ। এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়েই নিজেদের মিশন সম্পন্ন করে চার্টারের এজেন্টরা। এই প্রযুক্তিকেই হাতিয়ে নিতে চায় কেয়া ও তার সহযোগীরা। হার্টের এই প্রযুক্তির দখলও নেয় তারা। তবে আর পাঁচটা ‘হিরো ওয়ারশিপিং’ ছবির মতো দুষ্টুদের হাত থেকে সেই হার্ট উদ্ধার করে ‘ওয়ান্ডার ওম্যান’ র্যাচেল স্টোন।
টম হার্পারের এই ছবিকে মধ্যমানের ছবি হিসাবে তকমা দিলেও তার তারিফ করা হয়। ছবির চিত্রনাট্য অত্যন্ত দুর্বল। ছবির সংলাপও মনে থাকার মতো নয়। ‘ওয়ান্ডার ওম্যান’ হিসাবে গ্যাল গ্যাডোটের অভিনয় আর র্যাচেল স্টোনের অভিনয়ের মধ্যে তেমন পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। জেমি ডর্নান এখনও পর্যন্ত তাঁর ‘ফিফটি শেডস অফ গ্রে’-এর চরিত্রে থেকে বেরোতে পেরেছেন কি? ‘হার্ট অফ স্টোন’ দেখার পর এই প্রশ্নের অবধারিত উত্তর, না। তবে গ্যাল ও জেমির রসায়ন কিছুটা হলেও ঝিমিয়ে যাওয়া ছবিতে সামান্য উত্তেজনার সঞ্চার করে। গোটা ছবিতে সব থেকে উজ্জ্বল আলিয়া ভট্ট। তবে তাঁর ইংরেজি উচ্চারণে হিন্দির ছাপ বেশ স্পষ্ট। ‘কোয়ান্টিকো’-র মাধ্যমে হলিউড অভিষেকের সময় প্রিয়ঙ্কা চোপড়ার অভিনয় দেখতে গিয়ে তাঁর ইংরেজি উচ্চারণ নিয়ে এই অভিযোগ ছিল বলে মনে পড়ে না। তবে হলিউডের প্রথম ছবিতে সেই খামতিকে ছাড় দিলে আলিয়ার অভিনয় সত্যিই চোখ টানার মতো। বিশেষত গ্যালের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন তারকার পাশে একই ফ্রেমে অভিনেত্রী হিসাবে আলিয়া অনেক বেশি সপ্রতিভ। ছবির আবহ গোড়ার দিকে আলাদা ভাবে কানে এলেও সময় এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে তা-ও হারিয়ে যায়। অ্যাকশন থ্রিলার ছবিতে অ্যাকশনের দৃশ্যও মনে রাখার মতো নয়। এর থেকে ‘ওয়ান্ডার ওম্যান’ হিসাবে গ্যাল অনেক বেশি পরিপাটি।
‘মিশন: ইমপসিবল’, ‘সিটাডেল’-এর মতো তাবড় ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির জেরে সাম্প্রতিক কালে অ্যাকশন স্পাই থ্রিলারের বাজার অনেকটা দখল করে নিয়েছে অ্যামাজ়ন প্রাইম ভিডিয়ো। তার সঙ্গে পাল্লা দিতে নেটফ্লিক্সের একমাত্র ভরসা ‘ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস’। প্রায় দু’দশক পরে সেই ফ্র্যাঞ্চাইজ়িও এখন প্রায় খরচের খাতায়। ‘হার্ট অফ স্টোন’-এর মাধ্যমে হয়তো ‘সিটাডেল’-কে টেক্কা দিতে চেয়েছিল নেটফ্লিক্স। সে গুড়ে বালি! ভূরি ভূরি সমালোচনার পরেও ‘সিটাডেল’ সুযোগ পেয়েছে দ্বিতীয় সিজ়নের। হলিউডে এর পর আলিয়া আর সুযোগ পাবেন কি?