The Night Manager Review

দৃশ্য থেকে সংলাপ, সবটাই টোকাটুকি ও তর্জমায় ঠাসা! ‘দ্য নাইট ম্যানেজার ২’-এ চমক কোথায়?

সিরিজ়ের সিজ়ন একটাই, তবে তা মুক্তি পেল দুই ভাগে। প্রথম ভাগ মুক্তি পেয়েছিল ফেব্রুয়ারি মাসে। সিরিজ়ের শেষ ভাগ মুক্তি পেল সম্প্রতি। কেমন হল ‘দ্য নাইট ম্যানেজার ২’? জানাচ্ছে আনন্দবাজার অনলাইন।

Advertisement
স্নেহা সামন্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৩ ২০:২১
Aditya Roy Kapur

আদিত্য রায় কপূর। ছবি: সংগৃহীত।

‘আরিয়া’র মতো জনপ্রিয় ও প্রশংসিত ওয়েব সিরিজ়ের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন এর আগে। এ বার নিজের তৈরি সিরিজ় নিয়ে এলেন পরিচালক সন্দীপ মোদী। ‘দ্য নাইট ম্যানেজার’। ২০১৬ সালে মুক্তি পেয়েছিল ব্রিটিশ টেলিভিশন সিরিজ় ‘দ্য নাইট ম্যানেজার’। সেই ব্রিটিশ সিরিজ়েরই ভারতীয় সংস্করণ এটি। অবশ্য 'সংস্করণ' বললে একটু বেশি বলা হয়ে যাবে, 'তর্জমা' বলাই ভাল। কেমন হল ভারতের ‘দ্য নাইট ম্যানেজার’?

ব্রিটিশ সিরিজ়ে মুখ্য চরিত্র অর্থাৎ নাইট ম্যানেজারের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ব্রিটিশ অভিনেতা টম হিডলস্টন। ভারতীয় সংস্করণে সেই চরিত্রেই অভিনয় করেছেন আদিত্য রায় কপূর। টম হিডলস্টন অভিনীত ব্রিটিশ সিরিজ়ে ছিল মোট ছয়টি এপিসোড। ভারতীয় সিরিজ়ে এপিসোড রয়েছে মোট সাতটি। সিরিজের প্রথম ভাগ গত ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি পেয়েছিল। তাতে ছিল চারটি এপিসোড। বাকি তিনটি এপিসোড মুক্তি পেল জুনের একেবারে শেষে।

Advertisement

২০১৭ সালের রোহিঙ্গা গণহত্যার প্রেক্ষাপটে বাঁধা চিত্রনাট্য। চিত্রনাট্যের কেন্দ্র বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। ওই সময় রোহিঙ্গা গণহত্যার প্রতিবাদে আন্দোলনে ফুটছে সে শহর। সেখানকারই এক বিলাসবহুল হোটেলের নাইট ম্যানেজার আদিত্য তথা শান্তনু সেনগুপ্ত, ওরফে শান। ওই হোটেল থেকেই শুরু গল্প। ঢাকার এক প্রভাবশালী মাফিয়ার নাবালিকা স্ত্রীর সৌজন্যে এক নামজাদা ব্যবসায়ী ও তাঁর কর্মকাণ্ডের বৃত্তে প্রবেশ শানের। ওই নাবালিকাকে উদ্ধার করতে গিয়ে শানের হাতে এসে পড়ে এমন কিছু তথ্য, যাতে বিঘ্নিত হতে পারে বাংলাদেশ, মায়ানমারের পারস্পরিক সম্পর্ক। এমনকি, তার প্রভাব পড়তে পারে ভারতেও।

অন্য দিকে, শৈলেন্দ্র রুংতা ওরফে শেলি ভারতের অন্যতম খ্যাতনামা ব্যবসায়ী। কৃষিকাজের সহায়ক বিভিন্ন দ্রব্যাদি স্থানান্তর করার ব্যবসা তার, চলতি কথায় যাকে ‘শিপিং’-এর ব্যবসা বলা হয়। শেলির সেই আপাতনিরীহ ব্যবসার আড়ালেই চলে তার আসল কারবার— বেআইনি অস্ত্র পাচার। এক দিকে সে যেমন শরণার্থী শিবিরে গিয়ে অনাথ, অভুক্ত, বাসস্থানহীন শিশুদের সঙ্গে ছবি তোলে নিজের মানবিক ভাবমূর্তি রক্ষা করার জন্য, ক্যামেরার লেন্স বন্ধ হলে সেখানেই সে বেআইনি সব অস্ত্র পাঠায় স্রেফ নিজের লাভের কথা মাথায় রেখে। এই ব্যবসার ক্ষেত্রে শেলির কোনও ‘কোড’ নেই। যে ক্রেতা তাকে বেশি টাকা দেবে, অস্ত্রের ভান্ডার তার হাতে যাবে। দেশ-বিদেশের তাবড় সব নেতারা শেলির থেকে অস্ত্র কেনে শত্রু দেশকে কড়া জবাব দেওয়ার জন্য। আর ভারতের প্রতিরক্ষা দফতরের আধিকারিক এ কথা জেনেও চুপ করে থাকে, কারণ শেলির সেই বেআইনি অস্ত্রের কারবার নাকি আদপে দেশের সুরক্ষার স্বার্থেই। দেশের অন্যতম বড় ব্যবসায়ী, তার সঙ্গে বোঝাপড়ার সম্পর্কই রাখতে আগ্রহী প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ওই আধিকারিক। সেই আগ্রহ এতটাই যে, ‘র’-এর মতো সংস্থার এক গোয়েন্দাকে শাসাতেও ওই আধিকারিক পিছপা হয় না।

এ দিকে শানের থেকে তথ্য পেয়ে শেলির পিছনে ছুটছে লিপিকা সইকিয়া রাও, তথা তিলোত্তমা সোম। তার কাছে পুঁজি কম, কিন্তু আত্মপ্রত্যয় তার ষোলোআনা। শেলিকে হাতের মুঠোয় পাওয়াই একমাত্র লক্ষ্য তার। সন্তানসম্ভবা অবস্থাতেও ভারত থেকে শ্রীলঙ্কা দাপিয়ে বেড়ায় শানের কাছ থেকে শেলির বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করার তাগিদে। শান অন্য দিকে তত দিনে শেলির কাছের লোকদের মধ্যে অন্যতম। শেলির বৃত্তের ভিতরে ঢুকে কবাডি খেলার মতো করে আস্তে আস্তে একের পর এক ঘুঁটি সরাতে থাকে শান। শেলিকে শেষ পর্যন্ত কী ভাবে শায়েস্তা করে শান? সেই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য দেখতে হবে ‘দ্য নাইট ম্যানেজার’।

অভিনেতা হিউ লরি এবং টম হিডলস্টন।

অভিনেতা হিউ লরি এবং টম হিডলস্টন। ছবি: সংগৃহীত।

কিন্তু দেখতে বসে আপনার প্রাপ্তি কী কী? প্রথমেই বলে রাখা ভাল, অনুপ্রাণিত চিত্রনাট্য ও আদ্যোপান্ত তর্জমার মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকে। ‘দ্য নাইট ম্যানেজার’-এর চিত্রনাট্য সাজাতে গিয়ে সেই ফারাকটা একেবারেই ভুলে গিয়েছিলেন পরিচালক সন্দীপ মোদী। ২০১৬ সালের ব্রিটিশ সিরিজ় ‘দ্য নাইট ম্যানেজার’ থেকে হুবহু টুকেছেন তিনি, একেবারে রাম-টোকা যাকে বলে আর কী! দৃশ্য থেকে সংলাপ, টুকতে কোথাও বাকি রাখেননি সন্দীপ। এমনকি, সিরিজ়ের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের নাম পর্যন্ত বদলানোর প্রয়োজন মনে করেননি তিনি। সিরিয়া ও ইজিপ্টের বদলে মায়ানমার ও বাংলাদেশের পটভূমিতে খাড়া করেছেন গল্পকে— এই যা ফারাক।

তা হলে কী পড়ে থাকে ভারতীয় ‘দ্য নাইট ম্যানেজার’-এর গল্পে? অনিল কপূর ও শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের দুরন্ত অভিনয়। আর পর্দায় তিলোত্তমা সোমের অনবদ্য উপস্থিতি। অলিভিয়া কোলম্যানের জুতোয় পা গলানোর কাজটি খুব সহজ নয়। তবে তিলোত্তমা অনায়াসে ফুটিয়ে তুলেছেন লিপিকা সইকিয়া রাওকে। শেলির চরিত্রে অনিল কপূর বেশ ভাল, তবে তাঁর শরীরী ভাষার মধ্যে আরও একটু পরিমিতি থাকলে তা আরও চরিত্রোপযোগী লাগত। ব্রিটিশ সিরিজ়ে রিচার্ড রোপার চরিত্রকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন অভিনেতা হিউ লরি, অনিল কপূর চেষ্টা করলেও তার ধারেকাছে পৌঁছতে পারেননি। আদিত্য রায় কপূর শান হিসাবে যে প্রত্যাশা তৈরি করেছিলেন সিরিজ়ের প্রথমে, শেষ পর্যন্ত তা ধরে রাখতে পারেননি। শেষের দিকে তাঁর প্রতিটি অভিব্যক্তিই বেশ একঘেয়ে ঠেকেছে। বিশেষত, টম হিডলস্টনের মতো পোক্ত অভিনেতাকে ওই চরিত্রে পর্দায় দেখার পর আদিত্যকে বেশ ফ্যাকাশে লাগে। তবে ব্রিজপাল তথা ‘বিজে’র চরিত্রে শাশ্বত প্রায় নিখুঁত। শরীরী বিভঙ্গি থেকে শুরু করে প্রতিটি সংলাপের মোচড়েও নিজের জাত চিনিয়েছেন শাশ্বত। শোভিতা ধুলিপালার চরিত্রের ওজন থাকলেও তাঁর অভিনয় একেবারেই মনে রাখার মতো নয়।

তবে সন্দীপ মোদীর ‘দ্য নাইট ম্যানেজার’-এ সব থেকে বেশি চোখে লেগেছে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে গোঁজামিল। ‘র’-এর দুই কর্মী ছুটছে এক কুখ্যাত ব্যবসায়ীকে পাকড়াও করার জন্য। তলে তলে বোঝাপড়া হচ্ছে সেই ব্যবসায়ী ও উপরমহলের আধিকারিকের মধ্যে। অথচ ‘র’-এর ওই দুই গোয়েন্দাকে যারা সাহায্য করছে বাইরে থেকে, তারা প্রায় অদৃশ্য। ফোনে ফোনেই তাদের সঙ্গে সব পরিকল্পনা সারা। আদপেও কি এতটা সহজে মুশকিল আসান হয় এমন একটি মিশনে? তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে ব্রিটিশ ও আমেরিকান কূটনৈতিক কাঠামোর থেকে ভারতীয় কাঠামো বেশ কিছুটা আলাদা। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দিক থেকেও বেশ কিছু পার্থক্যও আছে বটে। সেই কারণেই বোধ হয় টোকার ক্ষেত্রে এই দিকটা কিছুটা এড়িয়ে গিয়েছেন সন্দীপ মোদী। তাতে অবশ্য তাঁর বুদ্ধিমত্তার পরিচয়ই মেলে। টুকেছেন তিনি আগাগোড়া, তবে স্থান-কাল-পাত্র বুঝে, একটু সতর্ক হয়েই।

আরও পড়ুন
Advertisement