মিমি চক্রবর্তী। ফাইল চিত্র।
টলিউড পার্টি থেকে রাজনৈতিক মঞ্চ, তাঁর দেখা কোথাও নেই। নিন্দকরা বলেন, ‘‘হাতে কোনও ছবি নেই, তাই ইনস্টাগ্রামেই ব্যস্ত।’’ তবে এ সবে বিন্দুমাত্র যায়-আসে না সাংসদ-অভিনেত্রীর মিমি চক্রবর্তীর। তিনি বাঁচেন তাঁর নিজের শর্তে। শুক্রবার মুক্তি পাচ্ছে তাঁর নতুন ছবি ‘খেলা যখন’। অরিন্দম শীল পরিচালিত এই থ্রিলারে তাঁকে দেখা যাবে অর্জুন চক্রবর্তীর সঙ্গে। ‘গানের ওপারে’র জনপ্রিয় জুটি আবার একসঙ্গে ফিরছে বড় পর্দায়। কতটা আশাবাদী অভিনেত্রী? আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে খোলামেলা আড্ডায় মিমি।
প্রশ্ন: আপনাকে আজকাল ইনস্টাগ্রাম ছাড়া কোথাও সে ভাবে দেখা যায় না কেন?
মিমি: (হাসি) আমি তো বরাবরই বাড়িতে থাকতে বেশি ভালবাসি। অতিমারির আগেও এমনই ছিলাম। আমার কাছে আমার কাজ আর পরিবার সবচেয়ে বেশি জরুরি। বাড়ি থেকে বেরোই একমাত্র কাজের জন্য কিংবা যখন ছুটি কাটাতে যাই। কোনও পাব বা মল বা ক্যাফেতে আমায় কখনওই দেখতে পাবেন না। আমার মনে হয়, বিভিন্ন পার্টিতেও আমি বেমানান। যে সময় লোকে পার্টি করে, সে সময় আমি ঘরে বসে নেটফ্লিক্স দেখি, লেখালেখি করি, পড়াশোনা করি কিংবা কনটেন্ট (ইনস্টাগ্রামের জন্য) তৈরি করি। আমার বাবা-মা-পোষ্যদের সঙ্গেই সবচেয়ে বেশি সময় কাটাতে ভালবাসি।
প্রশ্ন: অনেকেই বলেন, হাতে ছবি নেই বলে মিমি ইনস্টাগ্রামে ব্যস্ত। বলিউডে প্রায় সব তারকাই সমাজমাধ্যমে সক্রিয়, আপনার প্রতি এই সমালোচনা একপেশে লাগে না?
মিমি: কে কী বলছে, তাতে আমার যায়-আসে না। কোনও দিনই আসত না। তারা তো আমার সংসার চালায় না। জীবনটা আমার। এর চাবিকাঠি শুধু আমার হাতে। যত দিন আমার দর্শক আমায় দেখতে চান, তত দিন এ সবে আমি কান দেব না। কেরিয়ারের যেই জায়গায় আমি দাঁড়িয়ে, সেখানে আমার কাছের লোকেরা খুব ভাল করে জানে আমি কতটা পরিশ্রমী। তাই বছরে একটা ছবি করলেও আমি সেই ছবিটা মন দিয়ে করব এবং সেটা নিয়ে গর্ব বোধ করব। বছরের একগুচ্ছ আজেবাজে ছবি, যেগুলোর কোনওটাই বক্স অফিসে লাভের মুখ দেখল না, করার চেয়ে একটা ছবি করা অনেক ভাল।
প্রশ্ন: মানুষ থ্রিলার দেখতে বেশি ভালবাসেন। সেই ভাবনা থেকেই কি এ বছর ‘খেলা যখন’ বেছেছিলেন?
মিমি: প্রায় চার বছর আগে ছবিটা বেছেছিলাম। তখনই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শুটিং শুরু হওয়ার দশ দিন আগে বন্ধ হয়ে গেল। তার পর অনেক পরে আবার চিত্রনাট্য হাতে পেলাম। তার পর কাস্ট বদলে গেল। এমন বহু বার হয়েছে। শেষে আমি অরিন্দমদাকে (শীল, পরিচালক) বলেছিলাম, ফ্লোরে গেলেও বিশ্বাস নেই। যে দিন ছবিটা পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে, সে দিন আনন্দ করব। তা-ও ছবির শুটিং শেষ হয়েছে গত বছরের অগস্ট মাসে। এর মধ্যে দেখুন দেড় বছর হয়েও গেল!
প্রশ্ন: ‘পোস্ত’ ছবির পর আবার এক বার আপনাকে মায়ের চরিত্রে দেখা যাবে। অন্য নায়িকাদের তুলনায় আপনি এত অনায়াসে মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করতে রাজি হয়ে যান কী করে?
মিমি: আমার মনে এ সব নিয়ে কোনও খুঁতখুতানি থাকলে আমি প্রায় পাঁচ বছর আগে ‘পোস্ত’ করতে রাজি হতাম না। আমি শুধুই চিত্রনাট্য দেখি আর নিজের মতো চলি। গল্প পছন্দ হলে আমি মা কেন, ঠাকুমার চরিত্রও করব। আসলে আমি মন থেকে কাজ বাছি। অন্যদের দেখে কিছু করি না। আর বিদেশে তো এ সব নিয়ে কেউ ভাবেই না। এখন ২৫-২৬ বছরে কত মেয়ে মা হয়ে যাচ্ছে! তা হলে আর এমন চরিত্রে অভিনয় করতে বাধা কোথায়? আমি প্রযোজকদের কাছে কৃতজ্ঞ যে এমন অনেক চরিত্রে আমায় ভাবেন তাঁরা, যেখানে আমি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারি।
প্রশ্ন: সেটা আপনার ফিল্মোগ্রাফি দেখলেও বোঝা যায় যে, নানা স্বাদের ছবি করেছেন। এটা কি খুব সচেতন ভাবেই করা?
মিমি: আমি শুরু করেছিলাম ‘গানের ওপারে’ দিয়ে। তার পর ‘বোঝে না সে বোঝে না’ করার পর ‘খাদ’ করেছি। তার পর আবার ‘যোদ্ধা’র মতো ছবিও করেছি। আসলে আমি না একটি চিত্রনাট্য হাতে নিয়ে অনেক দিন ধরে চিন্তাভাবনা করি না। কখনও পরিচালক পছন্দের হলে গল্প শুনতে চাই না। আবার কখনও গল্প ভাল লাগলেও মন থেকে সায় না পেলে রাজি হই না। তবে এটুকু বলতে পারি যে, অনেকে আমার উপর সেই ভরসা করেছিলেন বলেই আমি এত রকম চরিত্রে কাজ করতে পেরেছি। কেরিয়ার শুরু করেছিলাম ১৯-২০ বছর বয়সে। অথচ পর্দায় তখন ২৭-২৮ বছরের একটি মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছি। তার পরই ‘বোঝে না সে বোঝে না’ ছবিতে আমার চরিত্রটা একদম বিপরীত মেরুর ছিল। পরিচালক-প্রযোজকরা আমায় এতটা অন্য রকম দু’টো চরিত্রে দেখেই হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, মেয়েটা সব রকম চরিত্র করতে পারবে। আমার এখনও মনে আছে, শ্রীকান্ত স্যর (মোহতা, প্রযোজক) আমায় সেই পুরনো এসভিএফ অফিসে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘তুমকো নাচ-গান সে প্রবলেম নেহি হ্যায় না?’’ আমি তখনই উত্তর দিয়েছিলাম, ‘‘নেহি, আই উড লাভ টু।’’ (হাসি)
প্রশ্ন: ‘গানের ওপারে’তে অর্জুন চক্রবর্তীর সঙ্গেই অভিনয় শুরু করেছিলেন। এ ছবিতে এত বছর পর ফের একসঙ্গে। অবসর সময়ে নিজেদের কেরিয়ারের গতিপথ নিয়ে আলোচনা হয় নাকি?
মিমি: অর্জুন তো খুব অন্তর্মুখী। এমনিই কম কথা বলে, আমার সঙ্গে তো আরওই বলে না! ‘গানের ওপারে’তে গোটা গল্পই ছিল গোরা আর পুপেকে নিয়ে। অথচ ও তখন আমার সঙ্গে কোনও দিনও কথা বলেনি! শুধু চিত্রনাট্য হাতে নিয়ে রিহার্স করতাম, তার পর শট দিতাম। ‘ক্রিসক্রস’-এ আমি ওর গার্লফ্রেন্ড হয়েছিলাম, তা-ও কথা বলত না। পর্দায় আমাদের রসায়ন যতটা দারুণ, বাস্তবে ততটাই খারাপ! ও আমাকে ইনস্টাগ্রামে ফলো পর্যন্ত করত না! জানতামই না ও ইনস্টাগ্রামে আছে! ‘খেলা যখন’-এ অনেক বার কাস্ট বদল হয়েছে। একটা সময় পর আমি জিজ্ঞেস করা বন্ধ করে দিয়েছিলাম যে, নায়ক কে হচ্ছে। শেষে যখন জানলাম অর্জুন, তখন খবরটা দেওয়ার সময়ে ইনস্টাগ্রামে আমার টিম ওকে ট্যাগ করতে গিয়ে জানতে পারল, ও আমায় ফলো করে না। চিত্রনাট্য পড়ার সময়ও একটাও কথা বলেনি। এক দিন আমি ওকে জিজ্ঞেস করি, ‘‘তোর কি আমার সঙ্গে কোনও সমস্যা আছে? কথা বলিস না কেন?’’ তখন অবশ্য হেসে বলেছিলে, ‘‘না না, তেমন কোনও ব্যাপার নেই।’’ তার পর অবশ্য শুটিংয়ের সময়ে আমরা আউটডোরে গিয়ে একসঙ্গে থাকতাম সকলে। তখন একটু আড্ডা হত।
প্রশ্ন: ‘ধনঞ্জয়’-এর পর তো অরিন্দম শীলের সঙ্গে এটা আপনার দ্বিতীয় কাজ...।
মিমি: অরিন্দমদা খুব মেথডিক্যাল পরিচালক। সেটে কোনও রকম চিৎকার নেই। আর্টিস্টদের অত্যন্ত স্বচ্ছন্দে কাজ করার মতো পরিবেশ তৈরি করেন। খুব বেশি শট নেন না। আমি অনেক সময় হয়তো বলতাম, ‘‘আরও একটা কি শট নেবে?’’ কিন্তু অরিন্দমদার মাথাটা খুব পরিষ্কার। বাড়তি শট নেবেন না কখনও। এই ছবিটা যে আমার কথা ভেবে লিখেছেন, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। এত বার কাস্ট বদল হল। কিন্তু আমায় কথা দিয়েছিলেন, ঊর্মির চরিত্রটা আমিই করব।
প্রশ্ন: ব্যক্তিগত ভাবে আপনার থ্রিলার পছন্দ?
মিমি: যে কোনও থ্রিলারের নাম বলুন, আমি হয়তো ইতিমধ্যেই দেখে ফেলেছি। কিছু দিন আগে নেটফ্লিক্সে ‘ডাহ্মার’ দেখে সারা রাত ওই নিয়েই স্বপ্ন দেখলাম। মা তো মানা করে, ঘুমোনোর আগে এ সব দেখতে। তা-ও আমি নিজেকে আটকাতে পারি না।
প্রশ্ন: অরিন্দম শীল থ্রিলারে পারদর্শী বলে কি ছবি নিয়ে উদ্বেগ কম?
মিমি: মুক্তির আগে উদ্বেগ সব ছবি নিয়েই থাকে। তবে এই ছবিটা আমার খুব কাছের। এটা আমি চাইব, ভবিষ্যতে আমার ছেলেমেয়েদের দেখাতে। কিংবা আমি অবসর নেওয়ার পর পরিবারের সঙ্গে বসে আবার হয়তো এই ছবিটা দেখব। শিল্পী হিসাবে এটুকুই বলতে পারি। বাকি তো আজকাল কিছুই বলা যায় না। বক্স অফিসের ক্ষেত্রে কী যে কাজ করে, কী করে না, বোঝা মুশকিল। যত বড় মুখই থাকুক, যত ভালই গল্প হোক, কিংবা যতই বড় প্রযোজনা সংস্থা হোক না কেন, অনেক সময় সব থাকা সত্ত্বেও একটা ছবি চলে না।
প্রশ্ন: ওটিটি আসাতেই কি এই অবস্থা?
মিমি: ওটিটি-তে এখন কনটেন্ট এত বেশি যে মানুষ হয়তো টিকিট কেটে হলে যাওয়ার ঝক্কি আর নিতে চান না। একটা সোয়াইপ করলে বসার ঘরে বিশাল স্ক্রিনে ড্রাগন দেখতে পাচ্ছেন, অ্যাভেঞ্জার্স দেখতে পাচ্ছেন, যা ইচ্ছা, তা-ই পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু আমার মতে, সিনেমা হলের অভিজ্ঞতাটাই আলাদা। বড় পর্দার ম্যাজিক একদম অন্য রকম।
প্রশ্ন: সে কারণেই কি আপনাকে ওয়েব সিরিজ়ে দেখা যায় না?
মিমি: না তেমন নয়। আমি ঠিক সময় আর ঠিক চিত্রনাট্যের জন্য অপেক্ষায় রয়েছি।
প্রশ্ন: ঠিক চিত্রনাট্য মিমি চক্রবর্তী কী ভাবে বাছেন? কারণ এখন তো আপনি আরও বেছে কাজ করছেন।
মিমি: গল্পটা আগে দেখি। তার পর দেখি আমার চরিত্রটা ছবিতে কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে। পাশাপাশি আমার পারিশ্রমিকটা অবশ্যই দেখি। সেটাও আমার কাছে খুব জরুরি। এখন আর আমায় কেউ পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে ছবি করাতে পারবে না। সঙ্গে কে আছে, কখনও জিজ্ঞেসও করি না। আমার জন্য গল্প আর টাকাটা আসল। সেগুলো ঠিক হলে তার পর হয়তো জিজ্ঞেস করি, সঙ্গে কে করছে। তবে সহকর্মীর ভিত্তিতে কখনও চিত্রনাট্য বাছাই করি না।
প্রশ্ন: বছরে এত কম ছবি করেও নিজেকে সব সময় এত অনুপ্রাণিত রাখেন কী ভাবে?
মিমি: বাংলা ছবির নায়িকাদের যে পারিশ্রমিক দেওয়া হয়, তাতে সংসার চলে না। ছবি কম করতে পারি, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে আমার সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় ব্র্যান্ড এন্ডোর্সমেন্ট রয়েছে। তা করার জন্য আমায় সারা ক্ষণ পরিশ্রম করতে হয়। ‘আউট অফ দ্য বক্স’ ভাবতে হয়। এবং আমি সেটাই করি। আমার কাছে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা মানুষের ভালবাসা। আমি একটা মফস্সল থেকে আসা মেয়ে, যাকে আজ লোকে এত ভালবাসা দিয়েছেন, এই জায়গাটা দিয়েছেন, তাই আমার মানুষের উপর ভরসা রয়েছে। সাংসদ হিসাবে, কিংবা অভিনেত্রী হিসাবে, আমি শুধু নিজের কাজটা করে যাই। আমার ঘাড়ে অনেক দায়িত্ব রয়েছে। যত দিন সেটা থাকবে, আমি পরিশ্রম করে যাব।
প্রশ্ন: আগামী বছরের নির্বাচন নিয়ে ভাবছেন?
মিমি: যে আসনটা আমায় মানুষ দিয়েছেন, শুধু সেটাই মন দিই। নিজের দায়িত্বগুলো পূরণ করার চেষ্টা করি। আর এক ঘণ্টা পর কী হবে, সেটাই জানি না। আগামী বছরের কথা তো ভাবতেই পারি না। আমি বর্তমানে বাঁচতে জানি, ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবি না।
প্রশ্ন: বর্তমানে রাজনৈতিক মহলে তো অনেক কাণ্ড হচ্ছে। সেগুলো আপনাকে চিন্তায় ফেলে না?
মিমি: আমার জন্মেরও আগে থেকে সব রাজনৈতিক দলেই কিছু না কিছু ঘটে আসছে। এ সবের মধ্যে আমি ঢুকতে চাই না। শুধু নিজের কাজটা ঠিক করে করায় বিশ্বাসী আমি।
প্রশ্ন: আগামী নির্বাচনে টিকিট পেলে আবার দাঁড়াবেন?
মিমি: সে তখন দেখা যাবে (হাসি)।