Basusree cinema hall

বিক্রি হবে ঐতিহাসিক প্রজেক্টর! ‘বসুশ্রী’ কি হস্তান্তরের পথে? অনুসন্ধানে আনন্দবাজার অনলাইন

‘বসুশ্রী’র তিনটি ভিন্টেজ প্রজেক্টর বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অংশীদারদের একাংশ প্রেক্ষাগৃহ বাইরের কোনও সংস্থাকে হস্তান্তর করে দিতে চাইছেন।

Advertisement
অভিনন্দন দত্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৮:৫৭
Industry buzz suggests eminent Basusree cinema hall of Kolkata is going to be sold

‘বসুশ্রী’ প্রেক্ষাগৃহ। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।

সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ ও ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ‘অযান্ত্রিক’। তিনটি ছবির মধ্যে একটি যোগসূত্র— তাদের প্রিমিয়ার হয়েছিল দক্ষিণ কলকাতার বসুশ্রী প্রেক্ষাগৃহে। ৭৭ বছরের ঐতিহ্যপূর্ণ প্রেক্ষাগৃহটির মালিকানা কি এ বার হস্তান্তরের পথে? টলিপাড়ায় বিষয়টি নিয়ে গুঞ্জন ক্রমশ জোরালো হচ্ছে।

Advertisement

১৯৪৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর সত্যভূষণ বসু এবং ইন্দুভূষণ বসুর হাতে বসুশ্রীর যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে প্রেক্ষাগৃহের অংশীদার ছ’জন। শোনা যাচ্ছে, দীর্ঘ দিন লোকসানে চলছে বসুশ্রী। তাই প্রেক্ষাগৃহ বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অংশীদারদের একাংশ। শুধু তা-ই নয়, প্রেক্ষাগৃহে রয়েছে তিনটি ‘ভিন্টেজ’ প্রজেক্টর, যার মাধ্যমে এক সময় বাংলা ছাড়াও দেশ-বিদেশের অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ছবি দেখেছেন শহরের মানুষ। সেই তিনটি প্রজেক্টরকেও নাকি বিক্রি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে বসুশ্রীর পরিচালন সমিতির সদস্য সৌরভ বসুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এই খবরে সিলমোহর দিয়েছেন। কিন্তু, সৌরভ নিজে পারিবারিক ঐতিহ্য হস্তান্তরের বিপক্ষে। তিনি বললেন, ‘‘২০১৪ সাল থেকে শুনলাম, ব্যবসা নাকি লোকসানে চলছে। তার পরেও আমি বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে হাল ফেরানোর চেষ্টা করি। কিন্তু এখন অন্য কোনও কোম্পানিকে হল বিক্রির চেষ্টা করা হচ্ছে।’’

অন্য কোনও পক্ষকে হল পরিচালনের ক্ষমতা হস্তান্তর করে মাসিক ভিত্তিতে টাকা নিতে ইচ্ছুক বসু পরিবারের একাংশ। কিন্তু সে ক্ষেত্রে মালিকানা আর পরিবারের হাতে থাকবে না। শোনা যাচ্ছে, যে সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হবে, তারা প্রেক্ষাগৃহের নীচে ব্যাঙ্কোয়েট এবং প্রথম তলে সিনেমা প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে আগ্রহী।

এরই সঙ্গে অভিযোগ উঠছে, প্রেক্ষাগৃহে তিনটি ভিন্টেজ প্রজেক্টরকে ‘লোহার দরে’ বিক্রির চেষ্টা করা হচ্ছে। সম্প্রতি, প্রেক্ষাগৃহের পরিচালন সমিতির বৈঠকে এই প্রসঙ্গে আলোচনা হয়েছে। সৌরভ বললেন, ‘‘তিনটে প্রজেক্টরকেই এখনও সক্ষম রাখা হয়েছে। এগুলো বিক্রি হয়ে গেলে বাংলা ছবির ইতিহাসের বড় ক্ষতি হবে।’’

Industry buzz suggests eminent Basusree cinema hall of Kolkata is going to be sold

বসুশ্রী সিনেমার একটি প্রজেক্টর। ছবি: সংগৃহীত।

বসুশ্রী প্রেক্ষাগৃহে ৪২ বছর প্রজেকশনের দায়িত্ব ছিলেন সুকুমার ঘোষ। অন্য দিকে মুম্বইয়ে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসছেন ‘সিনেমা পারাদিসো’ ছবির পরিচালক জুসেপ তোরনাতোরে। আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর পরিচালকের হাত থেকে বিশেষ পুরস্কার নিতে মুম্বই পাড়ি দিচ্ছেন সুকুমার। উল্লেখ্য, তোরনাতোরের এই ছিবির বিষয়বস্তু ছিল এক প্রেক্ষাগৃহের প্রজেক্টর অপারেটরের সঙ্গে এক সিনেমাপ্রেমী বালকের সখ্য। প্রজেক্টর যন্ত্রটিই যেন এক চরিত্র পরিণত হয় এই ছবিতে। তোরনাতোরের হাত থেকে পুরস্কৃত হবেন এক বর্ষীয়ান প্রক্ষেপক। বিষয়টি যেন অনেকখানি প্রতীকী তাৎপর্য বহন করছে। এখানেই সৌরভের আক্ষেপ, ‘‘বাইরের মানুষ আমাদের সম্মান জানাচ্ছেন, গুরুত্ব বুঝছেন। কিন্তু নিজেদের লোকেরাই বুঝতে চাইছেন না।’’

সৌরভ জানালেন, ‘ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের’ কর্ণধার শিবেন্দ্র সিংহ দুঙ্গারপুরের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। হলিউড পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান এই ডিজিটাল যুগেও মূলত সেলুলয়েড ফিল্মে ছবির শুটিং করেন। সৌরভের কথায়, ‘‘বসুশ্রীতে ওঁর ছবি দেখানোর কথা চলছে। শিবেন্দ্রের থেকে জানতে পেরেছি, সব ঠিকঠাক থাকলে প্রদর্শন উপলক্ষে কলকাতায় আসতে পারেন নোলান। কিন্তু প্রজেক্টরগুলোই যদি আর না থাকে, তা হলে কী হবে ভেবেই খারাপ লাগছে।’’

Industry buzz suggests eminent Basusree cinema hall of Kolkata is going to be sold

বসুশ্রীর প্রজেকশন রুমে কাজ করছেন সুকুমার ঘোষ। ছবি: সংগৃহীত।

সৌরভ জানালেন, অংশীদারদের একাংশ হল লোকসানে চলছে বলে দাবি করছেন। তাই তাঁরা মাসিক ভিত্তিতে টাকা পেতে ইচ্ছুক। সৌরভের কথায়, ‘‘এ দিকে টিকিট বিক্রি বা প্রক্ষাগৃহে কোথায় কী খরচ হচ্ছে, সেই হিসেব পাওয়া যায় না। আমাদের তৃতীয় প্রজন্মের হাতেও পরিচালন ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে না। আমরা বিশ্বাস, সকলে মিলে উদ্যোগ নিয়ে বসুশ্রীকে আবার দাঁড় করানো যেতে পারে।’’

বসুশ্রী যে বিক্রির পরিকল্পনা চলছে, এই খবর পেয়েছেন চলচ্চিত্রবিদ্যার গবেষক ও অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। জানালেন, সত্যজিৎ রায়ের প্রথম দু’টি ছবি (‘পথের পাঁচালী’ ও ‘অপরাজিত’) এবং ঋত্বিক ঘটকের প্রথম ছবি ‘অযান্ত্রিক’ বসুশ্রীতে মুক্তি পায়। এই প্রেক্ষাগৃহেই মুক্তি পায় আলফ্রেড হিচকক পরিচালিত ‘সাইকো’। অমিতাভ বচ্চন ও রেখা অভিনীত ‘দো আনজানে’ ছবির শুটিংও হয়েছিল বসুশ্রীতে। সঞ্জয়ের কথায়, ‘‘সেই প্রেক্ষাগৃহ বিক্রি হবে যাবে! মেনে নিতে পারছি না।’’

মৃণাল সেনের থেকে শোনা বসুশ্রীকে ঘিরে একটি ঘটনার স্মৃতিচারণ করলেন সঞ্জয়। জানালেন, ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তির দিন দু’বার বসুশ্রীতে ছবিটা দেখতে আসেন মৃণাল। সতীর্থদের জন্য প্রেক্ষাগৃহের বাইরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন সত্যজিৎ। সঞ্জয়ের কথায়, ‘‘কাছেই ছিল প্যারাডাইস ক্যাফে। সেখানে মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়েরা আড্ডা দিতেন। ওখান থেকে দল বেঁধে তাঁরা বসুশ্রীতে ছবিটা দেখতে গিয়েছিলেন।’’

সঞ্জয়ের মতে, বিদেশে সিনেমা সংক্রান্ত ইতিহাসকে সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু বাংলায় এই রকম ঘটনা দেখে তিনি ব্যথিত। বললেন, ‘‘আমার ধারণা, অবিলম্বে সরকারি পদক্ষেপ করা উচিত। তা ছাড়া বসুশ্রীকে বাঁচানো যাবে না।’’

উল্লেখ্য, ২০২০ সালে অতিমারির সময় থেকেই বিভিন্ন সময়ে বসুশ্রী ‘রুগ্ন’ বলে দাবি করা হয়েছে। তবে এ বার পরিস্থিতি গুরুতর। তাই আগামী দিনে প্রেক্ষাগৃহের ভাগ্য কোন পথে চালিত হবে, সেটাই দেখার।

আরও পড়ুন
Advertisement