পুজোর আগে আয়োজকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
২০২০ সাল। অতিমারির জেরে আড়ম্বর ছাড়াই দুর্গাপুজো পালন করেছিল বাংলা। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পুজোর উদ্বোধন থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উপরেও জারি ছিল নিষেধাজ্ঞা। করোনা অতীত হলেও চলতি বছরে আরজি কর-কাণ্ডের জেরে বিনোদন জগতে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। চলতি বছরে পুজোর আগে বাংলার অনুষ্ঠান আয়োজকদের তাড়া করছে চার বছর আগের শারদীয়ার স্মৃতি। পুজোর আর মাত্র কয়েক সপ্তাহ বাকি। এ দিকে শহরের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজকদের বুকিংয়ের খাতা খুললে অন্য ছবি ধরা পড়ছে। পরিস্থিতি জরিপ করল আনন্দবাজার অনলাইন।
প্রত্যেক বছর দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে পুজো উদ্বোধন, জলসা এবং মাচার অনুষ্ঠান মিলিয়ে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা হয়। পুজোর সময় উদ্বোধনে তারকাদের হাজির করা থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দায়িত্ব দেওয়া হয় বিভিন্ন আয়োজক সংস্থাকে। কিন্তু এই বছর এখনও পর্যন্ত পরিস্থিতি বেশ খারাপ বলেই জানালেন আয়োজকদের একাংশ। কোথাও শিল্পীরা ট্রোলিংয়ের ভয়ে পিছিয়ে আসছেন। আবার কোথাও পুজো উদ্যোক্তারাও ভয় পাচ্ছেন। এই মুহূর্তে অনুষ্ঠানের জন্য বিদেশে রয়েছেন আয়োজক বনি ঘোষ। আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানালেন, একাধিক অনুষ্ঠানের বুকিং বাতিল হয়েছে। বনির কথায়, ‘‘এখনও পর্যন্ত আমাদের ১০টা শো বাতিল হয়েছে। তাঁর মধ্যে নিকিতা গান্ধীর অনুষ্ঠানও ছিল। অনেককে অগ্রিমও টাকাও দেওয়া হয়ে গিয়েছিল।’’ গত বছর পুজোর সময় রাজ্যে প্রায় ৪০টি শো এবং ২০টি পুজোর উদ্বোধনের আয়োজন করেছিলেন বনি। পরিস্থিতি যে ভাল নয়, তা মেনে নিয়েই বললেন, ‘‘অনুষ্ঠান বাতিল করলেও কাউকে তো দোষ দিতে পারব না! কারণ, এটা একটা আবেগ এবং মানুষ এখন উৎসব বা কোনও বিনোদনের মধ্যে থাকতেই রাজি নন।’’
বর্ষীয়ান আয়োজক তোচন ঘোষ এক সময় পুজোর আবহে শহরে রাজেশ খন্না, শ্রীদেবী, জয়াপ্রদার মতো অভিনেতাদের নিয়মিত শহরে হাজির করতেন। কিন্তু এই বছরের পরিস্থিতি দেখে তাঁর কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। বললেন, ‘‘দু’-একটা ফাংশনের বুকিং এসেছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত পুজো উদ্বোধন নিয়ে কোনও এনকোয়্যারি পাইনি।’’
গত বছর তোচন ১০টি পুজোর উদ্বোধনের দায়িত্বে ছিলেন। পাশাপাশি ছিল একাধিক অনুষ্ঠান। বললেন, ‘‘করোনার বছরের থেকেও খারাপ পরিস্থিতি। কারণ, আরজি করের সঙ্গে মানুষের আবেগ জড়িয়ে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে উদ্বোধন বা ফাংশন কেউ করলেই তাঁদের সমালোচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’’ তবে তোচন নিজেও আরজি করের নির্যাতিতার বিচারের পক্ষে। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের ক্ষতি আমরা পুষিয়ে নেব। কিন্তু মেয়েটা যেন বিচার পায়।’’
চলতি বছরে যতগুলো বুকিং পেয়েছিলেন, তার মধ্যে এখনও পর্যন্ত ৭০ শতাংশই বাতিল হয়ে গিয়েছে বলে জানালেন আয়োজক সত্যজিৎ চক্রবর্তী। বললেন, ‘‘যেগুলো হওয়ার কথা, সেগুলোও শেষ পর্যন্ত হবে কি না, বুঝতে পারছি না।’’ সত্যজিৎ জানালেন, গত বছর তিনি একশোরও বেশি পুজো উদ্বোধন এবং অনুষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর আশঙ্কা, চলতি বছরে সেই সংখ্যা প্রায় তলানিতে এসে ঠেকতে পারে। আরজি কর আবহে নাগরিক সমাজে অস্থিরতা। কিন্তু সত্যজিতের পর্যবেক্ষণ, মফস্সলে ঘটনার প্রভাব শহরের তুলনায় অনেকটাই কম। তাঁর মতে, কলকাতা এবং তার পাশ্ববর্তী অঞ্চলের অনুষ্ঠানই বেশি বাতিল হচ্ছে।
পুজোর সময়ে জলসা এবং মাচার সঙ্গে অজস্র শিল্পী এবং কলাকুশলীর রুজিরুটি জড়িয়ে থাকে। পুজোর পাঁচ দিনের উপার্জনের উপরে নির্ভর করে অনেকের সারা বছর চলে। সত্যজিতের কথায়, ‘‘মানুষের আবেগকে সম্মান করি। কিন্তু এই মানুষগুলোর পরিবারের পুজোর নতুন জামা কী ভাবে হবে, সেটাই বুঝতে পারছি না। তাঁরা প্রতিবাদও করছেন, কিন্তু মুখে হয়তো কিছু বলতে পারছেন না।’’
সত্যজিৎ জানালেন, সম্প্রতি শ্রীরামপুরে একটি অনুষ্ঠান চলাকালীন স্থানীয় মানুষেরা আপত্তি জানান। ফলে বন্ধ করে দিতে হয় অনুষ্ঠান। আয়োজকদের একাংশের মতে, বিক্ষিপ্ত ঘটনা হলেও মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে আরজি কর মামলার পরবর্তী শুনানির উপরেও আগামী দিনগুলো নির্ভর করছে। এক আয়োজকের কথায়, ‘‘এক শ্রেণির মানুষ বিনোদন চাইছেন। কিন্তু, পুরো বিষয়টায় আমরা সকলেই পরিস্থিতির শিকার।’’
আয়োজক তরুণ ঘোষ অবশ্য আশাবাদী। গত বছর তিনি ৩০ থেকে ৩৫টি অনুষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন। চলতি বছরে এখনও পর্যন্ত সংখ্যাটা ২০-তে দাঁড়িয়েছে। বললেন, ‘‘মানুষের যা মনের অবস্থা, বুঝতে পারছি, বাংলার শিল্পীদের নিয়ে বেরোতে পারব না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সন্ন্যাসী এবং মহারাজদের সঙ্গে কথা হয়েছে। মুম্বইয়ের কিছু শিল্পীর সঙ্গেও কথা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হবে, এখনই বলতে পারব না।’’
সংশ্লিষ্ট মহলে খোঁজ নিয়ে জানা যাচ্ছে, অনুষ্ঠান বাতিল হলে ছোট শিল্পী এবং কলাকুশলীদের সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয়। কারণ, বাংলার প্রথম সারির শিল্পীদের একটা বড় অংশ পুজোর সময়ে বিদেশে শো করতে যান। এক আয়োজকের কথায়, ‘‘তাঁরা তো ফিরে এসে আবার বাংলার বাজার ধরে নেবেন। তাই সমস্যা হয় না। ফাঁপরে পড়েন বাকিরা।’’
আরজি কর আবহে রাজ্যের একাধিক পুজো কমিটি সরকারি অনুদান ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আয়োজকের কথায়, ‘‘কোনও পুজো কমিটি ‘দুর্গা ভান্ডার’-এর টাকা ফিরিয়ে দেওয়া মানে, তাঁদের বাজেট এমনিতেই কমে যাচ্ছে। তার পর তাঁরা আর অনুষ্ঠান করবেন কী ভাবে?’’ খোঁজ নিয়ে জানা গেল, পুজো উদ্যোক্তা এবং আয়োজকেরাও এখন জল মেপে এগোতে চাইছেন। অনেকেই জানালেন, দুর্গাপুজোর তুলনায় কালীপুজোর জন্য অনেক বুকিং করা হয়েছে। কিন্তু তার পরেও আশঙ্কা রয়ে যাচ্ছে। এক আয়োজকের কথায়, ‘‘আরজি করের সমস্যা যদি না মেটে এবং প্রতিবাদ যদি চলতেই থাকে, তা হলে মনে হচ্ছে, কালীপুজোর অনেক অনুষ্ঠানও বাতিল হয়ে যাবে।’’
চলতি বছরে পুজোর উদ্বোধন এবং অনুষ্ঠানের সংখ্যা কম বলে আয়োজক এবং শিল্পীরা অনিশ্চয়তার সম্মুখীন। সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশ যে উদ্যাপনের মানসিকতা পোষণ করছেন না, তা স্পষ্ট। আবার তা বলে যে আরজি কর-কাণ্ডে যে প্রতিবাদ চলছে, তাকেও সম্মান জানাচ্ছেন আয়োজকদের একাংশ। ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় উৎসবের মরসুমে আয়োজক এবং শিল্পীরা সম্ভাব্য ‘ক্ষতি’র সঙ্গে কী ভাবে মানিয়ে নেবেন, সেটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।