ছোটবেলার ছবিগুলি দেখলে মনে হয় এ যেন অন্য কোনও মানুষ! একটা বয়সে এসে কমবেশি প্রায় সকলেরই এমন মনে হয়। ব্যতিক্রম নন ‘লাল্টু বিশ্বাস’, ব্যতিক্রম নন তাঁর সাদামাঠা মেদবহুল শরীরের ভিতরে থাকা শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও। থিয়েটারের দিনগুলি হোক কিংবা ‘কুইনাইন’-এর গান, সেখান থেকে ‘লাল্টু বিশ্বাস’ হিসেবে দর্শকের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের সফর মোটেও সহজ কথা নয়। অভিনেতা-পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের এই সফর যথেষ্ট রঙিন। কিন্তু অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তি মেদও জমেছে কোমরে, পেটে। পর্দায় কখনও সেটাই হয়ে ওঠে দর্শকের আকর্ষণের কারণ। এ বার অবশ্য পর্দার টানেই সেই বাড়তি মেদে কাঁচি বসছে।
জানা গিয়েছে, আগামী দিনে বেশ কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করতে চলেছেন শিবপ্রসাদ। সেই সব চরিত্র যে ‘হামি’-র ‘লাল্টু বিশ্বাস’-এর থেকে কয়েক যোজন দূরের, সে কথা তো বলাই যায়। ফলে চরিত্রের প্রয়োজনেই নিজেকে গড়েপিঠে নিচ্ছেন তিনি। আর এই যাত্রায় প্রথম পদক্ষেপ নিজের চেহারায় পরিবর্তন আনা। ইতিমধ্যে ১০ কিলোগ্রাম ওজন কমিয়ে ফেলেছেন পরিচালক-অভিনেতা। নিজেই জানিয়েছেন, আরও দু’কিলোগ্রাম ওজন কমাতে চান তিনি।
কিন্তু কেন এত কিছুর প্রয়োজন হচ্ছে? সেই বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ শিবপ্রসাদ। তবে তিনি মুখ না খুললেও ৭৬ কিলোগ্রাম থেকে ৬৬ কিলোগ্রামে এসে দাঁড়ানো শিবপ্রসাদের নতুন ‘লুক’ ইতিমধ্যেই টলিউডে চর্চার কারণ হয়ে উঠেছে। এমনও শোনা যাচ্ছে, পর্দায় কৌশানীর সঙ্গে প্রেমের রসায়ন জমিয়ে তুলতেই নাকি চেহারায় বিশেষ পরিবর্তন আনছেন অভিনেতা শিবপ্রসাদ।
এই বিষয়ে আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে যোগাযোগ করা হলে অবশ্য শিবপ্রসাদ সরাসরি বলে বসেন, ‘‘আপাতত চরিত্র নিয়ে মুখ খোলা নিষেধ। কী ধরনের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য আমায় এতটা ওজন কমাতে হল সেটা জানতে হলে ছবির মুক্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। দীর্ঘ দিন ধরে দর্শক মনে রেখে দিয়েছেন ‘লাল্টু বিশ্বাস’-কে। আমার নতুন ‘লুক’ সেই ছবি মুছে নতুন শিবপ্রসাদের সঙ্গে পরিচয় করাবে।’’
ওজন কমানোর বিষয়ে আনন্দবাজার অনলাইনকে শিবপ্রসাদ জানিয়েছেন, “সবটাই অভিনয়ের খাতিরে। ‘আমার বস’ এবং ‘বহুরূপী’ ছবি দু’টির জন্যই রোগা হওয়া। ওখানে আমাকে যে ধরনের চরিত্রে দেখা যাবে, তার জন্যও রোগা হওয়া দরকার ছিল।’’ তা ছাড়া কোমরে চোট পাওয়ার পরও খানিকটা ওজন কমানোর প্রয়োজন হয়েছে চিকিৎসকের পরামর্শে, সে কথাও জানিয়েছেন তিনি। আরও জানিয়েছেন, ‘নতুন’ শিবপ্রসাদ হতে গিয়ে কম সংযম অভ্যাস করতে হয়নি। অনেক পছন্দের খাবার বাদ পড়েছে। রাতের খাবার খেতে হচ্ছে ঘড়ি ধরে নির্দিষ্ট সময়ে। সঙ্গে চলছে পাল্লা দিয়ে ঘাম ঝরানো শরীরচর্চা।
প্রথমেই বদল হয়েছে ডায়েটে। পরিচালক-অভিনেতার দাবি, এখন তিনি সকালে খাবার খেয়ে নেন ভরপেট। পাতে ওট্সের রুটি, এক বাটি সেদ্ধ সব্জি, দু’টি কলা, একটি ওমলেট। তাঁর মতে, সকালে ভারী জলখাবার খেলে সারা দিনের খিদে কমে যায়। দুপুরে তিনি নানা রকম তরকারি আর মাছ খাচ্ছেন। ছেঁটে ফেলেছেন ভাত। এর পাশাপাশি আরও একটি প্রিয় জিনিস ছাড়তে হয়েছে তাঁকে। সেটি হল মুড়ি। শিবপ্রসাদের বিকেল মানেই আয়েশ করে মুড়ি খাওয়া। না, শুকনো মুড়ি-শসা নয়। এত দিন সেই মুড়িতে থাকত চানাচুর, ছোলা, বাদাম, পেঁয়াজ-লঙ্কাকুচি— আরও কত কী!
শিবপ্রসাদ বলেন, “আগে বিকেলে অনেকটা মুড়ি খেয়ে ফেলতাম, তাই রাতের খাবার খেতে দেরি হয়ে যেত।’’ এখন রাতের খাওয়া সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে সেরে নেন। তাঁর কথায়, “এখন কোনও নিমন্ত্রণ থাকলে রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে যাই, যাতে খাবার দেখে খিদে না পায়।’’ স্ত্রী জিনিয়া সেনের কড়া নজরও রয়েছে সে দিকে।
এত কিছুর পর রয়েছে শরীরচর্চাও। কিন্তু জিমে গিয়ে ঘাম ঝরানোর সময় কোথায়, সারা দিনই তো ছবির কাজে ব্যস্ত শিবপ্রসাদ! তিনি বলেন, “ফিজ়িক্যাল থেরাপিস্টকে অনুরোধ জানিয়েছিলাম, এমন কিছু ব্যায়াম শিখিয়ে দিন, যেটা যে কোনও জায়গায় করা যেতে পারে।’’ সেই অনুযায়ী ফিজ়িক্যাল থেরাপিস্ট সৌভিক রায় নানা ধরনের ব্যায়াম অভ্যাস করতে দিয়েছেন। শিবপ্রসাদ জানান, এগুলি রেসিস্ট্যান্ট ব্যান্ড দিয়ে যে কোনও জায়গায় করা যায়। দ্রুত ওজন ঝরে।
শরীরচর্চা নিয়ে সবিস্তার জানতে আনন্দবাজার অনলাইন কথা বলেছিল ফিজিক্যাল থেরাপিস্ট সৌভিক রায়ের সঙ্গে। তিনি বলেছেন, ‘‘প্রযোজক-পরিচালক-অভিনেতা ওজন ঝরিয়ে মাংসপেশি সুগঠিত করতে চেয়েছিলেন। সেই অনুযায়ী, তিনি ব্যায়ামের একটি নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে অ্যারোবিক এবং প্রোগ্রেসিভ রেসিস্টেড প্রশিক্ষণ। এই ধরনের শরীরচর্চা শুধুমাত্র নমনীয়তা ধরে রেখে পেশিকে আরও সুগঠিত করেনি, বরং তাঁর শরীরের বাড়তি মেদ কমাতেও সাহায্য করেছে। পাশাপাশি, শিবপ্রসাদ নির্দিষ্ট ডায়েট কড়া ভাবে মেনে চলেন।’’
‘বহুরূপী’র শুটিং সেটে বড় ধরনের দুর্ঘটনায় কোমর ভেঙে গিয়েছিল শিবপ্রসাদের। সেই সময় তাঁর চিকিৎসার দায়িত্বে ছিলেন চিকিৎসক সুনন্দন বসু। কী বলছেন তিনি? চিকিৎসকের কথায়, ‘‘আমি কাউকে কোনও খাবার খেতে বারণ করি না। এমনকি, রাস্তার খাবারও না। পরিমাণে কম খেতে বলি। আর নির্দিষ্ট সময়ে খেতে বলি। এতে খাবার দ্রুত হজম হয়।’’ তাঁর মতে, হাঁটার থেকে ভাল শরীরচর্চা আর নেই। ট্রেডমিল নয়, খোলা হাওয়ায় রোজ সকাল-বিকেল হাঁটুন। বাইরে যেতে না পারলে ঘরের ভিতরে হাঁটতে হবে। প্রথমে আড়াই মিনিট। তার পর ক্রমশ বাড়বে সেই সময়। রোজ আধ ঘণ্টা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট হাঁটতে পারলে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, বাড়তি মেদ-সহ অনেক সমস্যা কমবে।
প্রত্যেক দিন অনুরাগীদের থেকে তাঁর নতুন ‘লুক’-এর জন্য প্রচুর অভিনন্দন পাচ্ছেন। সিনেমহল বলছে, অতীতের শিবপ্রসাদ আর নেই। বয়স সংখ্যামাত্র, এটাও প্রমাণ করেছেন তিনি। ৫০ ছুঁয়েও তিনি ২৫-এর মতোই তরতাজা।
এখন আয়নায় নিজেকে দেখে কতটা খুশি শিবপ্রসাদ? তৃপ্তি ঝরেছে তাঁর কথায়, ‘‘অনেক হালকা লাগছে। আগের থেকেও দ্রুত কাজ করতে পারছি। আরও দু’কিলোগ্রাম ওজন ঝরিয়ে ৬৪ কিলোগ্রাম হওয়ার ইচ্ছে আছে। দেখা যাক।’’