রুক্মিণী মৈত্র। —ফাইল চিত্র।
বড় পর্দায় অভিনয় করার কথা কখনও স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি। কিন্তু বর্তমানে একের পর এক ছবিতে কাজ করে চলেছেন নায়িকা। একই দিনে টলিপাড়ার এক সুপারস্টারের সঙ্গে নতুন ছবির মহরত করেন আবার বিকেলবেলা অন্য সুপারস্টারের সঙ্গে ছবির প্রচারে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি সত্যবতী, তিনি নটী বিনোদিনী, আবার তিনি মহাভারতের দ্রৌপদীও। এই মুহূর্তে টলিউডের ব্যস্ততম নায়িকাদের মধ্যে তালিকার উপরের দিকে যাঁর নাম জ্বলজ্বল করছে, তিনি রুক্মিণী মৈত্র। তাঁর সময় পাওয়াই এখন ‘চ্যালেঞ্জ’। নতুন ছবি ‘ব্যোমকেশ ও দুর্গরহস্য’ মুক্তির আগে রুক্মিণীর সাক্ষাৎকারের জন্য সময় চাওয়া হয়েছিল। বলেছিলেন ফাঁকা হলেই যোগাযোগ করবেন। টানা ২১ ঘণ্টা শুটিং সেরে ফেরার পথে এল নায়িকার ফোন। কথা ছিল বাড়ি ফিরে একটু ঘুমিয়েই ফোন করবেন। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগেই মোবাইল বেজে উঠল।
প্রশ্ন: বরাবরই বলেছেন খুব বেশি চাপ নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করেন না। হঠাৎ কী হল আপনার, পর পর এত কাজ করছেন?
রুক্মিণী: আসলে সবই সময়। এটাই আমার জীবনের সত্য যে, আমি যেটাকেই ‘না’ বলি সেটাই আমার জীবনে ঘটে। এটাও আমার জীবনের একটা মুহূর্ত। আমি মনে করি, পেশাদার জীবন এবং ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে একটা সমতা রাখা উচিত। যেমন আমি আমার আলসেমিটা উপভোগ করি, তেমনই আবার উপভোগ করছি এই সময়টাও। এখন হয়তো আমি বিশ্রাম নিতে পারছি না। বেশ ক্লান্ত লাগছে। কিন্তু জানি কিছু ক্ষণ মায়ের সঙ্গে সময় কাটালে আবার চাঙ্গা হয়ে যাব।
প্রশ্ন: এই ইন্ডাস্ট্রিতে অভিনেত্রী হিসাবে ছয় বছর হয়ে গেল। নিজের অভিনীত পুরনো সিনেমাগুলো দেখে কি যাচাই করেন কতটা উন্নতি হয়েছে?
রুক্মিণী: না। আমি নিজের কোনও পুরনো ছবি দেখিনি। আমার মনে হয় না প্রিমিয়ারের পর ‘চ্যাম্প’ আর দ্বিতীয় বার দেখেছি। ‘কিশমিশ’ও দেখিনি। কিন্তু আত্মমূল্যায়ন আমি সারা ক্ষণ চালাতে থাকি। যখন সেটে থাকি বা চিত্রনাট্য পড়ি— বলা যেতে পারে প্রতিটা মুহূ্র্তে। পুরনো কাজ ফিরে দেখার মতো পর্যাপ্ত সময় হয়তো হাতে নেই, কিন্তু কাজ করতে করতে নিজের ভুল-ত্রুটিগুলো নজরে রাখার চেষ্টা করি। খামতিগুলোকে বার করে সেই বিশেষ জায়গায় উন্নতির চেষ্টা করি। তাই কোনও কাজ করার আগে সঠিক প্রশিক্ষণ নিই এবং পড়াশোনা করি। শেখার প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে হবে। সেই ইচ্ছাটা না থাকলে তা হলে সেখানেই সব কিছুর ইতি।
প্রশ্ন: কী ব্যাপার, রুক্মিণী মৈত্র শুদ্ধ বাংলায় উত্তর দিচ্ছেন?
রুক্মিণী: আমার বাংলা কোনও দিন খারাপ ছিল না। ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করেছি বলে শুধু একটা ক্লাসেই বাংলা পড়ানো হত। বাকি বিষয়গুলি তো ইংরেজিতে পড়ানো হত। বাড়িতেও তেমনই পরিবেশ পেয়েছি। আমার বাংলা নিয়ে এত কথা হলে আমার কিছু বলার নেই। আমার বাংলা খুবই ভাল। তবে শুদ্ধ বাংলায় সব সময় কেউই কথা বলতে পারেন না।
প্রশ্ন: তবু ‘সত্যবতী’র একটা প্রভাব পড়েছে কি?
রুক্মিণী: আমার জীবন জুড়ে সত্যবতীর একটা বিশাল বড় প্রভাব থাকবে। আমরা মুখে সব সময় বলে থাকি, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি না। কিন্তু বাস্তবে সব সময় তেমনটা হয় না। সত্যবতী সত্যিই আমার জীবন থেকে নিরাপত্তাহীনতা দূর করে দিয়েছে। কারণ, সত্য কখনও সেই বৈধতা খোঁজে না। সে জানে সে কী। কারও স্বীকৃতির দরকার নেই তার। সত্যবতী নতুন করে আমার জীবনে সাহস জুগিয়েছে। কে কী বলল, কী ভাবল সেই গুরুত্বটা আর নেই আমার জীবনে।
প্রশ্ন: কয়েক দিন আগে আর এক সত্যবতী অর্থাৎ সোহিনী সরকারের সঙ্গে দেখা হল। কী কথা হল আপনাদের?
রুক্মিণী: সোহিনীকে আমি আগের থেকেই চিনি। উনি যে মাপের অভিনেত্রী সেটা নিয়ে কিছু বলার নেই। সোহিনীর ‘মহাভারত’ নাটকটি বাংলা আকাদেমিতে দেখতে গিয়েছিলাম। আমি মুগ্ধ ওঁর কাজ দেখে। আমার জন্মদিনে উনি দারুণ একটা মেসেজ পাঠিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, “এক সত্যবতীর তরফ থেকে আর এক সত্যবতীকে জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা এবং কাজের জন্য আরও আরও অনেক শুভেচ্ছা।”
প্রশ্ন: আপনি বাংলা নাটক দেখেন? আপনার ভাবমূর্তির সঙ্গে অনেকেই মেলাতে পারবেন না।
রুক্মিণী: এটা কেউ জানেন না। আমি স্কুলে পড়ার সময় নাটক করেছি। স্কুলের ৫০তম প্রতিষ্ঠা দিবসে ‘নজরুল মঞ্চ’-এ নাটক করেছিলাম। আমার বন্ধুরাও অনেকে নাটক করে। সত্যম ভট্টাচার্যকে আমি ছোটবেলা থেকে চিনি। ওদের নাটক দেখতে যেতাম। আমি কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের নাটক দেখতে গিয়েছি। ‘ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা’-তে গিয়েও নাটক দেখেছি। এই নাটকটাই আমি ফিরে পেয়েছি রামকমল মুখোপাধ্যায়ের ‘নটী বিনোদিনী’ ছবিতে কাজের মাধ্যমে। নিয়মিত না হলেও সুদীপ্তাদির (চক্রবর্তী) সঙ্গে নাটক দেখতে গিয়েছি বেশ কয়েক বার। আসলে বাইরেটা দেখেই সব কিছু মানুষ বিচার করেন। তাই এগুলো কেউ হয়তো ভাবতে পারবেন না।
প্রশ্ন: এত কাজ করছেন। তবুও দর্শকের একটাই কথা, ‘দেবের ছবি মানেই রুক্মিণী’। এইটা কবে উল্টো হবে ‘রুক্মিণীর ছবি মানেই দেব’?
রুক্মিণী: এটা সমাজের প্রথা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এটা পাল্টানো খুব কঠিন। প্রথমত দেব অন্য নায়িকাদের সঙ্গেও অনেক কাজ করছে। নতুন অভিনেত্রীদের সুযোগ দিচ্ছে। ইশা সাহা, কৌশানী মুখোপাধ্যায় থেকে সৌমিতৃষা কুণ্ডু, শ্বেতা ভট্টাচার্য প্রচুর নায়িকা কাজ করছেন ওর সঙ্গে। সেটা লোকে দেখেও ভুলে যাবে। এটা ঠিক, আমার কেরিয়ারে অধিকাংশ ছবির নায়ক দেব। পরিচালকেরা আমায় বাছলে কিছু করার নেই। আমায় নিয়ে তাঁরা ভাবলে লোকের কথা ভেবে কেন ভাল কাজ হাতছাড়া করব আমি? যে দিন ব্যোমকেশের টিজ়ার লঞ্চ হয় সে দিন সকালে আমি জিতের ‘বুমেরাং’-এর মহরৎ করি। কোনও নায়িকার একই দিনে দুই তারকার সঙ্গে দুটি বড় বড় ঘোষণা হয়েছে কখনও! অথচ তা নিয়ে লেখা হয় না। বিনোদিনী যে আমি করছি সেটাও প্রথমে অনেকে বিশ্বাস করতে চায়নি।
প্রশ্ন; এত ধরনের আলোচনার মাঝে দেব আর আপনার মধ্যে কখনও ইগো কাজ করেছে?
রুক্মিণী: খারাপ লাগা ছিল। দেব এবং আমার মধ্যে একটা ইগোর লড়াই ছিল, মনোমালিন্য ছিল ব্যক্তিগত স্তরে। তখন ছিল যখন আমি দেবকে বলেছিলাম যে, আমি বাংলা সিনেমা করব না। সাধারণত মানুষ ভাবেন একই ময়দানে দুটি তলোয়ার থাকলে ঝগড়া হয়। আমাদের ক্ষেত্রে উল্টো হয়েছে। ময়দানে ঢুকতে চাইছিলাম না বলে ঝগড়া হচ্ছিল দেবের সঙ্গে। আসলে ও যখন আমায় কাজের জন্য বলেছিল তখন পড়াশোনাটাই আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ছিল। এমবিএ শেষ হওয়ার পর দেবকে ছবিতে অভিনয়ের জন্য ‘হ্যাঁ’ করি। তখন আমাদের মধ্যে সব ইগো, মনোমালিন্য শেষ হয়ে যায়। দেব আজকের যুগে দাঁড়িয়ে এক জন ‘ফেমিনিস্ট’। যে চায় মেয়েরা এগিয়ে যাক। ব্যোমেকেশের ভাবনাও খানিকটা এমনই। যে নারীকে নারীর মতো ভালবাসতে জানে।
প্রশ্ন: ‘নটী বিনোদিনী’, ‘দ্রৌপদী’— একের পর এক ছবিতে নায়িকা। পরিচালকরা কী দেখে বার বার আপনাকে বেছে নিচ্ছেন বলে মনে হয়?
রুক্মিণী: মনে হয় আমার কাজ, নিষ্ঠা। রাত ৩টে অবধি শট দিলেও এক মুহূর্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ি না। ‘বুমেরাং’-এর শুটিং চলছে এখন। হার্নেসে ঝুলে চার-পাঁচ ঘণ্টা ধরে শট দিচ্ছি। যত ক্ষণ না সঠিক শট পাওয়া যাচ্ছে নামছি না। বিনোদিনীর সময়ও ১০৪ জ্বর নিয়ে শুট করেছি। সদ্য মুর্শিদাবাদ থেকে শুটিং সেরে ফিরলাম, হয়তো পায়ের আঙুলে ক্র্যাক হয়েছে। কিন্তু শুটিং বন্ধ করব না। নিজের ৫০০ শতাংশ দিয়ে কাজ করি। আমার মূলমন্ত্র— চেষ্টা। তাই হয়তো পরিচালকদের সেটাই ভাল লেগেছে।
প্রশ্ন: ‘দ্রৌপদী’ বললেই তো রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের মুখ ভেসে আসে। ওঁর সঙ্গে কি কথা হয়েছে?
রুক্মিণী: রূপাম্যামের সঙ্গে আমার আলাপ আছে। কিন্তু ‘দ্রৌপদী’র বিষয়ে কথা হয়নি। অবশ্যই ওঁর অভিনয় দেখেছি। উনি জাতীয় স্তরের দ্রৌপদী। আমার ইচ্ছা আছে, রূপাম্যামের কাছে ওয়ার্কশপ করার। উনি যদি আমায় শেখাতে রাজি হন, তা হলে আর কিছু বলারই নেই!