অনন্যা চট্টোপাধ্যায়। ছবি-সংগৃহীত।
সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ছবির নাম ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’। শুটিং শুরু হয়ে গিয়েছে। সেই ব্যস্ত শিডিউলের মধ্যেই অকপট আড্ডায় অভিনেত্রী।
প্রশ্ন: বহু দিন পরে আবার সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করছেন!
অনন্যা: সৃজিতের সঙ্গে এর আগে ‘জাতিস্মর’-এ কাজ করেছি। তা ছাড়া এখনকার ছবিটিতে যাঁরা অভিনয় করেছেন, তাঁদের সঙ্গে আগেও আমি কাজ করেছি। তাই একটা রিইউনিয়নের মতো হচ্ছে। আর যাঁদের সঙ্গে আগে কখনও কাজ করিনি, তাঁদের সঙ্গে কাজ করার উত্তেজনাও রয়েছে। আর এত দিন পরে বড় পর্দায় কাজ করছি, তার কারণ ছবি আমি কমই করি। যখন ছোট পর্দায় কাজ করতাম, তখনই নিয়মিত আমায় দেখা যেত। তেমন পছন্দসই গল্প না পেলে কাজ করি না। সেই জন্যই আমায় কম দেখা যায়।
প্রশ্ন: ছোট পর্দাতে এখনও অবধি আপনার শেষ কাজ ‘কালী কলকাত্তাওয়ালি’। টেলিভিশনে আর ফিরবেন না?
অনন্যা: এই মুহূর্তে ছোট পর্দায় ফেরার কোনও পরিকল্পনা নেই। ‘সুবর্ণলতা’র ১০ বছর পরে আমি ‘কালী কলকাত্তাওয়ালি’-তে অভিনয় করেছিলাম। দেখলাম, নতুন রকমের গোয়েন্দা চরিত্র। ভাল লেগেছিল। করলাম। তেমনই নতুন কিছু না পেলে, ঠিক ভাল লাগে না।
প্রশ্ন: কম কাজ করলেও একাধিক মনে রাখার মতো অভিনয় করেছেন। ফলে আরও ভাল চরিত্রের জন্য ডাক পাওয়া তো উচিত ছিল!
অনন্যা: এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে মুশকিল। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে এত ভাল ভাল অভিনেত্রী রয়েছেন! তাই ভাল চরিত্র হলেই যে আমার কাছে আসবে, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। নিশ্চয়ই কখনও মনে হয়েছে, ওই চরিত্রটা পেলে ভাল লাগত। কিন্ত অন্য যাঁরা চরিত্রের সঙ্গে সুবিচার করেছেন, তাঁদের কাজ দেখে আর কিছু মনে হয়নি। নিজে ভাল চরিত্র পেলে তো সবারই ভাল লাগে।
প্রশ্ন: ঋতুপর্ণ ঘোষ। ‘আবহমান’। অভিজ্ঞতা?
অনন্যা: ‘আবহমান’-এর আগে আমি একটাই বড় পর্দার ছবি করেছিলাম- ‘রাত বারোটা পাঁচ’। টেলিফিল্ম ‘দেবদাস পারো ১৪১২’-তে আমায় দেখে আবহমানের জন্য ঋতুদা আমায় ডাকেন। শুরুতে খুব ভয়ে ছিলাম। প্রথম এত বড় পরিচালকের সঙ্গে কাজ। সবাই খুব ভয় পেত নাকি ঋতুদাকে, এ সব শুনে গিয়েছিলাম। কিন্তু প্রথম দিন স্ক্রিপ্ট শুনতে গিয়ে বুঝলাম, একদম ছেলেমানুষের মতো। আমায় বলেছিলেন, ‘‘তুই বল তোর সম্পর্কে আমার কী জেনে রাখা উচিত! আমিও বলব, আমার সম্পর্কে তোর কী জেনে রাখা উচিত।’’ মনে আছে, প্রায়ই ঋতুদা ফ্লোরে এসে নতুন দৃশ্য লিখে ফেলতেন।
প্রশ্ন: এ রকম কোনও একটা দৃশ্যের কথা মনে পড়ে?
অনন্যা: পড়ে। এক দিন আমার মেকআপ রুমে ঢুকলেন। তখন আমি গুনগুন করে গান গাইছিলাম। ঋতুদা বললেন, ‘‘আরে, তুই এত ভাল গান গাইতে পারিস, জানতাম না তো! দাঁড়া একটা সিন লিখি,’’ বলে একটা দৃশ্য লিখে ফেললেন। সেখানে খুব বেশি গান ছিল না যদিও। বিনোদিনী যখন শেষ কার্টেন কল নিচ্ছেন, তার আগে একটি দৃশ্যে মাতাল গলায় তিনি একটি কীর্তন গাইছেন। সেই দৃশ্যটা। খুব স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে লিখে ফেলতেন ঋতুদা।
প্রশ্ন: আচ্ছা আপনি বললেন, ঋতুদা নিজের সম্পর্কে কিছু জানিয়ে দিয়েছিলেন। কী বলেছিলেন?
অনন্যা: ফ্লোরের কিছু সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে কথা বলেছিলাম আমরা। শেষে বললেন, ‘‘ও তুই মুডি। আমারই মতো। লোকে তোর সম্পর্কে কেন যে বলে, তোর নাকউঁচু?’’ মনে আছে, বেড়ালে খুব ভয় পেতেন। এক বার সেটে একটা বিড়াল ঢুকে পড়েছিল। ঋতুদা লাফিয়ে চেয়ারে উঠে পড়লেন। সে কী কাণ্ড। বিড়াল ফ্লোর থেকে বের করা অবধি শট নেওয়া গেল না।
প্রশ্ন: বহু পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন। ঋতুপর্ণ ঘোষ কোন জায়গায় আলাদা?
অনন্যা: ঋতুদা নারী চরিত্রকেই মুখ্যচরিত্র হিসাবে যে ভাবে তুলে ধরতেন, সেটা আমাদের কাছে বিরাট পাওয়া। আর ওই যে বললাম, ওঁর স্বতঃস্ফূর্ততা। আমি আগে এমন দেখিনি যে, এক জন পরিচালক বসে বসে এ ভাবে দৃশ্য লিখে ফেলছেন! আর কোনও দৃশ্য পছন্দ হলে ছেলেমানুষের মতো আদর করে দিতেন। ঋতুদার সঙ্গে সম্পর্কটা বন্ধু, আবার কখনও বড় দাদার মতো ছিল।
প্রশ্ন: আচ্ছা ‘মেঘে ঢাকা তারা’র পরে আর কোনও বায়োপিক-এর প্রস্তাব পেয়েছেন?
অনন্যা: না, পাইনি।
প্রশ্ন: নিজের কোনও বিশেষ চরিত্রের বায়োপিকে অভিনয় করার ইচ্ছে আছে?
অনন্যা: অনেক চরিত্র আছে। আমি গহরজান, অমৃতা প্রীতমের চরিত্রে অভিনয় করতে চাই। উমরাও জানও খুব পছন্দের। অভিলাষ আর আকাঙ্ক্ষার কোনও শেষ নেই।
প্রশ্ন: কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, অপর্ণা সেনের ছবিতে আপনাকে আবার কবে দেখা যাবে?
অনন্যা: এই মুহূর্তে বলতে পারব না। তেমন কোনও কথা হয়নি। বিশেষ করে কৌশিকদার সঙ্গে ছবিতে খুবই ভাল রসায়ন তৈরি হয় আমার। ‘ল্যাপটপ’-এর মতো ছবির কথা সবাই বলে। কৌশিকদা নিজে একজন অসাধারণ অভিনেতা। এ ছাড়া সৃজিত মুখোপাধ্যায়, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় বা অপর্ণা সেনের মতো পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছে তো থাকেই। সব অভিনেতারই থাকে।
প্রশ্ন: ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়রা পর পর ছবিতে কাজ করছেন। আপনি এত বিরতি নিয়ে কাজ করেন। দর্শকরা তো ভুলে যেতে পারে আপনাকে, আশঙ্কা হয় না?
অনন্যা: না, হয় না। বরং, অনেক দিন বাদে বাদে ছবি করলেও দর্শকরা যে প্রতিক্রিয়া দেন, ভালবাসা দেন, তাতে বুঝি, তাঁরা মোটেই ভুলে যাননি আমায়। বরং আমার কাজ দেখার জন্য তাঁরা অপেক্ষা করেন। তাঁদের প্রত্যাশাও অনেক বেশি থাকে। সেই প্রত্যাশা পূর্ণ করার বরং একটা চাপ থাকে আমার। এতে দায়িত্বও বেড়ে যায়।
প্রশ্ন: আপনার সমসাময়িক অভিনেত্রী শ্রীলেখা মিত্র টলিউডে স্বজনপোষণ নিয়ে সরব হয়েছেন একাধিক বার। আপনি কখনও স্বজনপোষণের শিকার হয়েছেন?
অনন্যা: স্বজনপোষণ জিনিসটা সারা পৃথিবীতেই আছে। কোথাও কম, কোথাও বেশি। আমি যেটুকু কাজ করি, নিজের ইচ্ছেয় করি। আমি জানি না, আমি স্বজনপোষণের শিকার হয়েছি কি না। হয়তো যেটুকু পাওয়ার ছিল, সেটুকুই পেয়েছি। এমনও হয়েছে, হয়তো অন্য কারও চরিত্রটা করার কথা ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি করেছি। আমি হয়তো সেটা জানিও না। আবার হয়তো, আমাকে ভেবেও পরে আমার পরিবর্তে অন্য কোনও অভিনেত্রীকে নেওয়া হয়েছে, সেই অভিনেত্রীও সেটা জানতেন না হয়তো। পরিচালক যাঁকে মনে করবেন, তাঁকেই নেবেন। আমি আসলে এগুলি থেকে দূরে থাকি। সমাজমাধ্যমেও সক্রিয় নই। পার্টিতে যাই না। তাই বাজারের খবর আমার কান অবধি পৌঁছয় না।
প্রশ্ন: সম্পর্কের প্রসঙ্গে আসি। বিবাহবিচ্ছেদের সময়ে সৌজন্য বজায় রেখেছিলেন। একটা কথা বলবেন, বিচ্ছেদের পরে কি বন্ধুত্ব রাখা যায়?
অনন্যা: আমি মনে করি, বিচ্ছেদটা কী ভাবে হয়েছে তার উপরে নির্ভর করে বন্ধুত্ব থাকবে কি না। কিন্তু সম্পর্কটা যখন ছিল, তার মধ্যে তো একটা মান ছিল। বিচ্ছেদেও সেই মানটুকু যেন থাকে। মানুষ হিসাবে আমরা হয়তো এটুকু করতেই পারি।
প্রশ্ন: কিন্তু একা লাগে না কখনও?
অনন্যা: না, আমার একা লাগে না। আমার ভাল বন্ধু আছে। আমার মা আছেন, বই আছে, গান আছে। আর এটা একটা অভ্যাস। একা কী ভাবে ভাল থাকতে হয়, সেটা নিজেকেও জানতে বা অভ্যাস করতে হয়। সঙ্গী থাকলে কার না ভাল লাগে! কিন্তু সঙ্গী না থাকলে হতাশ হয়ে থাকব, সেটা ঠিক নয়। আর হতেই তো পারে, কোনও সঙ্গী চলে এল (হেসে)। ওই দরজাটা তো খোলাই আছে...
প্রশ্ন: পরিস্থিতি তেমন হলে আবার কখনও বিয়ের কথা ভাববেন?
অনন্যা: আমি অত দূর কিছু ভাবছিই না। আমি বাঁচতে ভালবাসি।
প্রশ্ন: একটা একদম অন্য রকম সামাজিক প্রশ্নের উত্তর দেবেন?
অনন্যা: বলুন।
প্রশ্ন: ‘প্রাইড মানথ’ চলছে। সমকামী, উভকামী, রূপান্তরকামীদের উদ্যাপনের মাস। এক দিকে যখন বিষয়টার উদযাপন হচ্ছে, তখনই সমাজমাধ্যমে ট্রোলিংও দেখা যাচ্ছে এলজিবিটি কমিউনিটিকে নিয়ে। কী বলবেন?
অনন্যা: এর অনেকগুলি দিক আছে। ট্রোলাররা আলাদা প্রজাতি। যে কোনও জিনিস নিয়ে তারা ট্রোল করবেই। ওদের গুরুত্ব দেওয়ার দরকার পড়ে না। আর আমার বিশ্বাস আমার কাছে। আমি যদি মনে করি, আমার কাজে অন্যায় কিছু নেই এবং আমি ভাল থাকছি, তা হলে অন্য কে কী বলছে, সেগুলিতে গুরুত্ব না দিলেও চলে। দ্বিতীয়ত, যে কোনও ধরনের নতুন বিষয় গ্রহণ করতে মানুষের সময় লাগে। গোটা সমাজেই তাই।
প্রশ্ন: আচ্ছা, আপনি কেন সমাজমাধ্যম থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন?
অনন্যা: আমি নিজেকে সরিয়ে রাখি না, আসলে আমি কম ছবি করি। ছবির প্রচারমাধ্যম হিসাবেই সমাজমাধ্যমকে আমি ব্যবহার করি। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনের রোজনামচা পোস্ট করতে ভালবাসি না। আমার অত ধৈর্যও নেই। প্রাসঙ্গিক থাকার জন্য কনটেন্ট তৈরি করব, এটা আমি পারি না।
প্রশ্ন: আপনার ‘সুবর্ণলতা’ আজও মানুষ মনে রেখেছে। কিন্তু আজকের ধারাবাহিক ক্ষণস্থায়ী। কী মনে হয়?
অনন্যা: এর পিছনে একাধিক কারণ আছে। সমাজমাধ্যমে সবাই খুব সহজলভ্য এখন। তার একটা খারাপ দিক আছে। শিল্পী ব্যক্তিগত জীবনে কেমন, সেটিও তাঁরা এখন দেখছেন। মানুষেরও ধৈর্য কমে গিয়েছে।
প্রশ্ন: ‘বাংলা ছবির ‘পাশে দাঁড়ানো’ নিয়ে নানা কথা হয়। কী মতামত আপনার?
অনন্যা: বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ালে আমাদেরই ভাল। কিন্তু এটাও ঠিক কথা, ছবি ভাল হলে মানুষ দেখবে। না হলে মানুষ দেখবে না। সেটা মানুষের মৌলিক অধিকার। একটা সৎ ছবি হলে মানুষ দেখতে আসবেই।
প্রশ্ন: রাজনীতিতে আসার প্রস্তাব কোনও দিন পেয়েছেন?
অনন্যা: প্রস্তাব এসেছে। কিন্তু আমি ও সবে নেই। দেখছেন সমাজমাধ্যমই ব্যবহার করতে পারি না(হাসি), রাজনীতি করব?
প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে কোনও আক্ষেপ আছে?
অনন্যা: কোনও আক্ষেপ নেই।
প্রশ্ন: গান নিয়ে আগামী দিনে কোনও পরিকল্পনা?
অনন্যা: ওরে বাবা, না (হেসে)। একদম না। একটা ছবিতে গান গেয়েছিলাম। সেটা আর মুক্তিই পেল না। তাই ভাবছি, প্রকাশ্যে আর গান-টান গাইব না।