‘গাজনের ধুলোবালি’ ছবির শুটিংয়ে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। ছবি: সংগৃহীত।
হেমন্তের দুপুরে গ্রামে ঢোকার রাস্তার ঠিক মুখটায় একটা সাদা গাড়ি এসে থামল। সামনে গ্রামবাসীদের ভিড়। গাড়ি থেকে নেমে এলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। সোজা এগিয়ে প্রাচীন এক গাছতলার বেদিতে উঠে জনসাধারণের উদ্দেশে হাত নাড়লেন। জোর গলায় বললেন, ‘‘আপনারা কেমন আছেন? আমি আপনাদের অমৃতা।’’ সাধারণ মানুষ তত ক্ষণে হাততালি দিতে শুরু করেছেন। দুটো টেকেই শট ওকে। পরিচালকের চোখেও খুশির ঝলক।
পরিচালক ইন্দ্রাশিস আচার্যের নতুন ছবি ‘গাজনের ধুলোবালি’র আউটডোর শুটিং চলছে মুর্শিদাবাদের আজিমগঞ্জে। ঋতুপর্ণা ছাড়াও ছবিতে রয়েছেন ঋত্বিক চক্রবর্তী, লোকনাথ দে, শ্রেয়া সিংহ, দেবপ্রসাদ হালদার প্রমুখ। হোটেল থেকে গাড়িতে মিনিট পনেরোর দূরত্বে বেণীপুর। সেখানেই চাঁদাবাগ গ্রামে সেট ফেলেছে ইউনিট। ঋতুপর্ণার শট শেষ হতেই ইন্দ্রাশিস বললেন, ‘‘রিয়্যাল লোকেশনে স্থানীয় মানুষদের নিয়ে শুটিং করার মজাই আলাদা।’’ তবে পাশাপাশি অন্য কথাও জানালেন পরিচালক। প্রতি দিন দূরদূরান্ত থেকে মানুষ ভিড় করছেন লোকেশনে। দাবি একটাই— এক বার ঋতুপর্ণাকে চোখের সামনে দেখতে চান তাঁরা। ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে অভিনেত্রী অবশ্য অনুরাগীদের সেই আবদার মিটিয়েছেন হাসিমুখে।
‘বিলু রাক্ষস’, ‘পিউপা’, ‘পার্সেল’ হয়ে ‘নীহারিকা’— এর আগে দর্শক ইন্দ্রাশিসের কাছ থেকে যে ধরনের ছবি পেয়েছেন, এই ছবিটি কিন্তু সেগুলির তুলনায় বিপরীত পথে হাঁটবে। কারণ পরিচালকের মতে, এই ছবিতে তিনি সামাজিক হিংসার নেপথ্য কারণ অনুসন্ধান করতে চাইছেন। ইন্দ্রাশিস বললেন, ‘‘এখন সমাজে ভক্তি এবং ঘৃণা— এই দুটো বিষয় চরমে পৌঁছেছে। ফলে সমাজমাধ্যম থেকে শুরু করে সর্বত্র হিংসা একটা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।’’ গল্প নিয়ে এখনই বিশদে যেতে নারাজ পরিচালক। তবে জানালেন, ঋতুপর্ণার চরিত্র অমৃতার স্বামী সাংবাদিক। গ্রাম থেকেই সে নিখোঁজ হয়। স্বামীর সন্ধানে এসেই তার সামনে একের পর এক সত্য উন্মোচিত হতে শুরু করে।
সেটে তখন লাঞ্চ ব্রেক। এ দিকে অন্য খবর কানে এল। আগের দিন রাত থেকে ঋতুপর্ণার শরীর খারাপ। রাতে বমি হয়েছে। সকালে ইঞ্জেকশনও নিতে হয়েছে। অভিনেত্রী বিশ্রাম করছেন। অভিনেত্রীর শারীরিক অবস্থা নিয়ে পরিচালকের কপালেও চিন্তার ভাঁজ। কিন্তু ইউনিটের এক সদস্য বললেন, ‘‘এর পরেও ঋতুদি যে ভাবে শট দিয়ে চলেছেন, দেখলে অবাক হতে হয়।’’ লাঞ্চ ব্রেকের পর ফ্লোরে ফিরলেন ঋতুপর্ণা। অমৃতার উপর আক্রমণ হয়েছে। বাড়িতে সে বিশ্রাম করছে। তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন গ্রামের মাস্টারমশাই (লোকনাথ দে)। দৃশ্যের টেক নিলেন পরিচালক। কিছু ক্ষণ পর পোশাক পরিবর্তন করে বেরিয়ে এলেন লোকনাথ। সে দিন তাঁর আর দৃশ্য নেই। হোটেলে ফেরার আগে ধানক্ষেতের আল বরাবর হাঁটতে হাঁটতে বলছিলেন, ‘‘ইন্দ্রাশিসের ছবির নির্মাণশৈলীর আমি ভক্ত। এই ছবিটাও ও যে ভাবে ভেবেছে, আমার মনে হয়, দর্শকের পছন্দ হবে।’’ এরই সঙ্গে লোকনাথ তারঁ চরিত্র নিয়ে যোগ করলেন, ‘‘গ্রামে উন্নয়নের পক্ষে এবং বিপক্ষে যে লড়াই, সেখানে আমার চরিত্রটি একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে।’’ তবে অমৃতার সঙ্গে মাস্টারমশায়ের সম্পর্কটি ঠিক কী রকম, তা নিয়ে আপাতত নীরবই রইলেন লোকনাথ।
ধীরে ধীরে সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ছে। হৈমন্তিক হাওয়ার শিরশিরে ভাব। গ্রামের মানুষের প্রতিবাদ মিছিলের দৃশ্য গ্রহণ করা হবে। তাদের হাতে মশাল এবং প্ল্যাকার্ড। সন্ধ্যায় বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে মিছিল দেখছে অমৃতা। বেশ কয়েক বার মিছিল ক্যামেরার সামনে দিয়ে এগিয়ে গেল। পরিচালকের দৃষ্টি আটকে মনিটরে। শট শেষেই খবর পাওয়া গেল, ঋত্বিক লোকেশনে হাজির হয়েছেন।
ঋত্বিকের সন্ধান পাওয়া গেল মেকআপের তাঁবুতে। তিনি ছবিতে রাজেনের চরিত্রে। পুরু গোঁফ। কপালে লাল তিলক। রূপটান শিল্পী অভিনেতার আঙুলে পর পর আংটি পরিয়ে দিলেন, কব্জিতে লাল ধাগা। রাজেন কি খলনায়ক? ঋত্বিক হেসে বললেন, ‘‘ঠিক ধরেছেন। রাজেন গুন্ডা এবং রাজনৈতিক দিক থেকে ক্ষমতাবান। অমৃতার সঙ্গে তার সংঘাত কী ভাবে শুরু হচ্ছে, সেটা কিন্তু এখনই বলতে চাইছি না।’’ সম্প্রতি, পর পর খল চরিত্রে অভিনয় করছেন ঋত্বিক। কিন্তু তা নিয়ে তিনি একটুও বিচলিত নন। ঋত্বিকের কথায়, ‘‘আমি কিন্তু বিভিন্ন ধরনের চরিত্র করছি। সেখানে ভিলেনও রয়েছে।’’
সন্ধ্যা নেমেছে। ফ্লোর থেকে ডাক এল। অমৃতার সঙ্গে রাজেনের প্রথম আলাপের দৃশ্য। একতলা বাড়ির বারান্দায় খুবই কম আলো রাখা হয়েছে। অমৃতাকে দেখতে দলবল নিয়ে হাজির হয়েছে রাজেন। তার মুখে সংলাপ— ‘‘ম্যাডাম, আপনি আমাদের গ্রামে এসেছেন। তাই আপনার সঙ্গে একটু চেনাজানা করতে এলাম।’’ বোঝাই গেল, অমৃতা বেশ বিরক্ত। ডিওপি শুভদীপ দে ক্লোজ়আপে ধরলেন দু’জনকে। কয়েকটা টেকের পর আশ্বস্ত হলেন পরিচালক। দৃশ্যের দ্বিতীয় ভাগে ঘরের মধ্যে জোর করে প্রবেশ করে অমৃতার ব্যাগ ঘাঁটতে শুরু করে রাজেন! হালকা চালে হুমকিও দিতে দেখা গেল। এতেই চরিত্রটার রূপরেখা স্পষ্ট হয়। শটের পর সে দিনের মতো ঋত্বিকের প্যাকআপ। কিন্তু ঋতুপর্ণার আরও দৃশ্য বাকি।
সন্ধ্যা সাতটা। ইউনিটে আধ ঘণ্টার বিরতি। চা ও জলখাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিজের ঘরে পাওয়া গেল ঋতুপর্ণাকে। রূপটান শিল্পী তখন তাঁর কপালে ও গালে আঘাতের চিহ্ন ফুটিয়ে তুলছেন। অভিনেত্রী জানালেন, সকালের থেকে অনেকটাই ভাল আছেন। সারা দিনে তাঁর মেনুতে কী রয়েছে? মৃদু আলোয় ঋতুপর্ণা হেসে বললেন, ‘‘ওই যে বাটিতে ঢাকা দেওয়া কাঁচকলা সেদ্ধ!’’ বিশ্রাম নিচ্ছেন না। পরের দিন শুটিং শেষে অভিনেত্রী গাড়িতে পুরীর উদ্দেশে রওনা দেবেন। সেখানে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত নতুন ছবির আউটডোর। এই অফুরান এনার্জির রহস্য কী? ঋতুপর্ণা বললেন, ‘‘ভাল ছবির প্রতি দায়বদ্ধতা। নিজেকে কখনও বলি না যে, আমি ক্লান্ত।’’
দীর্ঘ কেরিয়ারে অজস্রবার গ্রামে শুটিং করতে এসে আগেও সাধারণ মানুষের আবদার মিটিয়েছেন ঋতুপর্ণা। কথাপ্রসঙ্গে হেসে বলছিলেন, ‘‘সে দিন তো কারা যেন মজা করে বলল যে, এটা তো পুরো শো হয়ে গেল। বললাম, তা হলে তো টাকা দিতে হবে! গ্রামের মানুষ তাতেও রাজি। আসলে, অনুরাগীদের এই ভালবাসার কোনও বিকল্প নেই।’’ ইন্দ্রাশিসের সঙ্গে এই নিয়ে তৃতীয় ছবি ঋতুপর্ণার। হ্যাটট্রিক প্রসঙ্গে বললেন, ‘‘অনেক দিন আগেই ইন্দ্রাশিস এই ছবিটার কথা আমাকে বলেছিল। আমার মনে হয়, গ্রামজীবনের রাজনীতির একটা নতুন দিক এই ছবিতে উন্মোচিত হবে।’’ ঋত্বিক এবং ঋতুপর্ণা এর আগে বিভিন্ন স্বাদের ছবিতে দর্শকের সামনে হাজির হয়েছেন। আর দর্শকও পছন্দ করেছেন সেই উপস্থিতি। অভিনেত্রীর বিশ্বাস, এই ছবিতেও তার অন্যথা হবে না।
রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে। ইউনিটের প্যাক আপ হতে আরও কয়েক ঘণ্টা দেরি। এ দিকে কলকাতা ফেরার তাড়া। শেষ বেলায় পরিচালক জানালেন, আজিমগঞ্জের স্থানীয় একটি নাটকের দলের একাধিক অভিনেতা ছবিতে অভিনয় করছেন। এর আগে বোলপুরে ছবির প্রথম ধাপের শুটিং সেরেছিল ইউনিট। আজিমগঞ্জের পর কলকাতায় দু-তিন দিনের শুটিং বাকি থাকবে। প্রমোদ ফিল্মস প্রযোজিত ছবিটি আগামী বছরের শেষের দিকে মুক্তি পেতে পারে।