বিনোদন জোগাতে পারল না ‘ব্রহ্মাস্ত্র’
মা-বাবা মারা গিয়েছে ছোটবেলায়। অনাথ ছেলেটা ছোট থেকে বুঝতে পারে, সে বাকিদের চেয়ে আলাদা কেন। হঠাৎ সে জানতে পারে ভাল আর মন্দের লড়াইয়ে সে-ই আসল যোদ্ধা। কিছুতেই দুষ্টের দমন করা সম্ভব হয় না। কারণ শয়তান যে না জীবিত, না মৃত। অথচ দিনদিন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। শেষে জয় হয় ভালরই। আর এই লড়াইয়ের মূল অস্ত্র ভালবাসা। গল্পটা কি চেনা চেনা লাগছে? হ্যারি পটারের ভক্তদের চিনতে একটুও সময় লাগবে না। তবে এ গল্প কিন্তু শুধুই তাঁদের চশমা পরা জাদুকরের নয়। এই গল্প আমাদের ঘরের কাছেরই, প্রিয় রণলিয়ার ‘ব্রহ্মাস্ত্র’-এরও বটে! যদিও গল্প মিশেছে খানিকটা অ্যাভেঞ্জার্সের কীর্তিকলাপ। জনপ্রিয় দুই ফ্যান্টাসি সিরিজ থেকে ধার করেও কিন্তু ঠিক সেই বিনোদন জোগাতে পারল না ‘ব্রহ্মাস্ত্র’!
পরিচালক অয়ন মুখোপাধ্যায়ের স্বপ্নের ছবি ব্রহ্মাস্ত্র। তিনি নাকি প্রায় ছ’বছর ধরে এই ‘মৌলিক’ গল্পের উপর কাজ করেছেন। এ ছবির কথা অন্যতম প্রযোজক কর্ণ জোহর ২০১৭ সালেই ঘোষণা করেছিলেন। তার পর শ্যুটিং হতে সময় লেগেছে বিস্তর। মাঝে দেরি হয়েছে অতিমারির জন্যও। ৪১০ কোটি টাকা বাজেটের ছবি করতে সময় তো লাগবেই। ছবির গল্প যেমন নানা রকম অস্ত্র নিয়ে, তেমন দর্শকের মন জয় করতেও পরিচালক নানা রকম অস্ত্র ব্যবহার করেছেন। তার প্রথম অস্ত্র অবশ্যই ‘স্পেক্টাক্ল’ তৈরি করা। গোটা ছবি জুড়ে ভিএফএক্স-এর কাজ দেখলে চোখ ফেরানো দায়। হেসেখেলে যে কোনও মার্ভেল বা ডিসি-র ছবির স্পেশ্যাল এফেক্টস-এর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে পারবে। এত দিন তাবড় তাবড় বিগ বাজেট দক্ষিণী ছবির স্পেশ্যাল এফেক্টস তাক লাগিয়ে দিত। এ বার সে সব ছাপিয়ে একদম আন্তর্জাতিক মানের কাজ করেছেন নির্মাতারা। ফলে ছবি দেখতে দারুণ হয়েছে।
দেখতে আরও সুন্দর হয়েছে, কারণ পর্দায় রণবীর কপূর এবং আলিয়া ভট্টের মতো অপরূপ সুন্দর দুই অভিনেতা রয়েছেন। রূপে-গুণে তাঁরা যে বলিউডে এখন এক নম্বর, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর তাঁরাই অয়নের দ্বিতীয় অস্ত্র। তৃতীয় অস্ত্র অবশ্যই তারকা অতিথি শিল্পী। শাহরুখ খান, নাগার্জুন থেকে ডিম্পল কাপাডিয়া— যাঁরাই এই ছবিতে ক্যামিও করেছেন, কয়েক মিনিটের জন্য দর্শক চোখ ফেরাতে পারেননি। এ বার আসা যাক ছবির চতুর্থ অস্ত্রে— ছবির খলনায়করা। মূল খলনায়ক অতি জাগতিক এক অবয়ব মাত্র। যাকে আমরা হয় কমিক্স আঁকার তুলিকলার কায়দায় দেখি, কিংবা ভিএফএক্স-এর ভেল্কিতে। এই সিরিজের দ্বিতীয় অংশ তাকে ঘিরেই। এই ভোল্ডেমর্ট কাম থানোস মার্কা খলনায়ককে ঘিরে যথেষ্ট কৌতূহল সফল ভাবে তৈরি করতে পেরেছেন পরিচালক। কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে, হৃতিক রোশন কিংবা রণবীর সিংহকে দ্বিতীয় ছবিতে এই চরিত্রের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কে হবে এই এনিগম্যাটিক ‘দেব’, তা নিয়ে ভালই উৎসাহ থাকবে দর্শকের মধ্যে? দ্বিতীয় খলনায়ক ছবিতে মৌনী রায়। তাঁর চরিত্রটা অনেকটা ভোল্ডেমর্টের পেয়ারের নাগিনীর মতোই। মৌনী অবশ্য নিজে দীর্ঘ দিন জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘নাগিন’ করেছেন। তাই ফ্যান্টাসি জঁর তাঁর হোমগ্রাউন্ড বলা যেতে পারে। না, তিনি মার্ভেলের স্কারলেট উইচের (এলিজাবেথ অলসেন যে চরিত্রটাকে পর্দায় প্রাণ দিয়েছেন) প্রভাব দর্শকমনে না ফেলতে পারলেও অনেকটাই সেই দিকে এগোচ্ছেন।
এ বার আসা যাক এমন কিছু অস্ত্রে যা তেমন ধারালো নয়। ছবির রোম্যান্স অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দর্শকের জন্য এবং গল্পের নায়ক শিবের জন্যেও। অতি শক্তিশালী ক্ষমতার দমন সে করবে ভালবাসার জোরেই। কিন্তু সেটা যেন জমল না। ব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্রকে যে ভালবাসা হারিয়ে দেয়, সে কি আর যেমন তেমন ভালবাসা হলে চলে? রোম্যান্স অয়নের হাতের পাঁচ। ‘ওয়েক আপ সিড’-এ যিনি এমন পরিণত প্রেম দেখিয়েছিলেন, ‘ইয়ে জওয়ানি…’তে যিনি দীপিকা-রণবীরের মধ্যে মন ছুঁয়ে যাওয়া একের পর এক দৃশ্য লিখেছিলেন যিনি, তিনিই এ বার পর্দায় প্রেম তৈরি করতে একদম ফেল করেছেন। রণবীর-আলিয়ার প্রেম মনে দাগ কাটবে না একটুও। শিব-ঈশার ভালবাসায় গল্প এগোয় না, হোঁচট খায়। দর্শক ছটফট করবেন, কখন আবার গল্পে কিছু হবে। কোথায় গেল কবীর-নয়নার সেই পেটের মধ্যে উথালপাথাল করা প্রেমের সংলাপ, কোথায় সেই গলায় কান্না দলাপাকানো বিরহের দৃশ্য? শিব-ঈশা যে বড়ই ফিকে। তারা কেন প্রেমে পড়ছে বুঝতেই পারবেন না দর্শক। অয়নের কাছ থেকে এমন কাঁচা প্রেম-ভালবাসার গল্পের বুনোন হতাশ করল।
তার পর আসা যাক ছবির গানে। ছবিতে এত গান যে মিউজিক্যাল বলা যেতে পারে। অরিজিৎ সিংহের ‘কেশরিয়া’ আর ‘দেবা দেবা’ শুনতে ভাল লাগলেও তা ‘ইলাহি’ কিংবা ‘কবীরা’ হয়ে উঠতে পারল না। বাকি গানগুলো তো হল থেকে বেরিয়ে মনেও থাকবে না। ‘ইয়ে জওয়ানি…’ সাফল্যের পিছনে বড় অবদান ছিল ছবি প্রত্যেকটা হিট গানেরও। এ ছবি বক্স অফিসে কামাল করতে পারে, কিন্তু তা গানের জন্য হবে না।
ছবির কাহিনি বহু গল্প দ্বারা অনুপ্রাণিত। ভারতীয় পৌরাণিক গল্পের সঙ্গে বিদেশি ফ্যান্টাসি সিরিজ মিশিয়ে ভালই ফেঁদেছেন পরিচালক। থানোস যেমন ব্রহ্মাণ্ডের শক্তিশালী পাথর ধাওয়া করছিল, এখানে দেব খুঁজছে ব্রহ্মাস্ত্র। তা ছাড়াও পবনাস্ত্র, কবজাস্ত্র, নন্দী অস্ত্র, অগ্নি অস্ত্র, রয়েছে কত কী! ডাম্বলডোরমাফিক গুরু অমিতাভ বচ্চনের মুখ থেকে সে সব কাহিনি শুনতে মন্দ লাগবে না। গল্প যেখান থেকেই অনুপ্রাণিত হোক না কেন, ‘কী হবে, কী হবে’ একটা কৌতূহল তৈরি হবেই। এই ছবিতে অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলবে না। সেগুলোর জন্য অপেক্ষা করতে হবে দ্বিতীয় পর্বের জন্য। তবে সেই অপেক্ষা করতে চাওয়ার মতো কৌতূহল দর্শকের মনে তৈরি করতে পেরেছেন অয়ন।
তবে, সব অস্ত্র থাকলেও নেই একটি অস্ত্র— মগজাস্ত্র। ফ্যান্টাসি সিরিজের গল্প শোনাতে যে পরিমাণ মনোযোগ লাগে, তা নাচ-গান-ঠুনকো রোম্যান্সে হারিয়ে ফেলেছেন অয়ন। যাঁরা ‘গেম অফ থ্রোনস্’ দেখে অভ্যস্ত (তুলনা টানতে হচ্ছে, কারণ এখানে নায়ককে বার বার ড্রাগনও বলা হচ্ছে, টার্গেরিয়ানদের মতো সে আগুনে পোড়ে না) তাঁদের কাছে এই ভাল-মন্দের লড়াই পুরনো হয়ে গিয়েছে। নীতি-গল্প না শুনে টানটান যুদ্ধ দেখতে চান সকলে। সমানে সমানে। ভালবাসা দিয়ে সব জয় করা যায়, এই গল্পও যে পচে গেল। মাথা থেকে কি আর নতুন কিছুই বেরোচ্ছে না? ফেলু মিত্তির থাকলে নির্ঘাত বলতেন, মগজাস্ত্রে অনেক দিন শান দেওয়া হয়নি। তাই এই অবস্থা!