হঠাৎ করে ধারাবাহিক বন্ধের সিদ্ধান্ত কতটা প্রভাব ফেলছে টলিপাড়ায়? খোঁজ নিল আনন্দবাজার অনলাইন।
পুজোর বাকি আর মাত্র ক’টা দিন। পুজোর আগেই এক ধাক্কায় বন্ধ সাত-সাতটা ধারাবাহিক। এক সপ্তাহ কি বড় জোর তিন-চার দিন আগে কলাকুশলীকে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যে বেশি দিন নেই। বন্ধ করে দেওয়া হবে শ্যুটিং। কেন এমনটা হচ্ছে? শুধুই কি কম টিআরপি এর নেপথ্যে?
ছোট পর্দা হোক কিংবা বড় পর্দা— সব সময় একটা অনিশ্চয়তা কাজ করে। আচমকা কাজ হারানোর ভয়, নতুন কাজ না পাওয়ার আশঙ্কা, অভিনেতা থেকে টেকনিশিয়ান সকলকেই কম-বেশি এই অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তাঁদের মানসিক স্থিতিও সেই ভাবেই গড়ে ওঠে। এই হঠাৎ ছন্দপতন কী ভাবে সামলান তাঁরা? দর্শক-মনে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার লড়াই প্রতিনিয়ত চালিয়ে যেতে হয় অভিনেতাদের। এই নিরাপত্তাহীনতাকে কী ভাবে সামলায় টলিপাড়া? এর কি আদৌ কোনও সমাধান আছে? খোঁজ নিল আনন্দবাজার অনলাইন।
এই মুহূর্তে টিআরপি রেটিংয়ে তাঁর ধারাবাহিক তালিকায় শীর্ষে। ‘গৌরী এলো’ ধারাবাহিকের মুখ্য চরিত্র ঈশান ওরফে বিশ্বরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে, তিনি বলেন, “এটার নেপথ্যে অনেকগুলো কারণ কাজ করে। কলাকুশলীর মাত্র কয়েক দিন আগে জানানোটা খুবই ভুল। ইন্ডাস্ট্রি কিছু মানুষ এটাকে প্রায় নিয়ম করে ফেলছে। তারা বলে, এখনই শিল্পীদের জানিও না, তা হলে শট দিতে চাইবে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো এমনটা সত্যিই ঘটে, কিন্তু সব ক্ষেত্রে তো আর ঘটে না। একটা নির্দিষ্ট সময় দেওয়া উচিত ধারাবাহিক বন্ধের ঘোষণা করার আগে। চ্যানেল বা প্রযোজকদেরও একটা ধারাবাহিক শুরুর পর কিছুটা সময়ে অন্তত ধৈর্য ধরে দেখা উচিত। দু’মাস গেল কী গেল না, আর বন্ধ করে দিলাম, এই প্রবণতা তো ঠিক নয়।”তবে স্বস্তিকা দত্তের গলায় আবার অন্য সুর। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেন, “এ ক্ষেত্রে আমি চ্যানেল প্রযোজকদের হয়েই কথা বলব। আমার ধারাবাহিক তিন বছরের মাথায় বন্ধ হয়। তখন আমাকে এক সপ্তাহ আগে জানানো হয়েছিল। টিআরপির উপরেই অনেক কিছু বিচার হয়। আর ধারাবাহিক শুরু হওয়া এবং বন্ধ হওয়া দুই-ই দর্শকের হাতে। দিনের শেষে টিআরপি কথা বলে। তা ছাড়া এখন একটা কাজ শেষ হওয়ার পর খুব বেশি দিন অপেক্ষা করে থাকতে হয় না অভিনেতাদের।”
ধারাবাহিকের টিআরপি তার ওঠা-পড়া অনেকটাই নির্ভর করে মেগার গল্পের উপর। দর্শককে বিভিন্ন সময় নিত্য নতুন গল্প উপহার দিয়ে এসেছেন লীনা গঙ্গোপাধ্যায়। এ বিষয়ে তাঁর কী মতামত? তাঁর কথায়, “না অবশ্যই নোটিস দেওয়া হয়। আগে থেকেই জানানো হয়। দিনের শেষে এটা সমাজ সেবা নয়, এর মধ্যে একটা ব্যবসা আছে। লাভের মুখ দেখা না গেলে কর্তৃপক্ষ সেই ধারাবাহিক চালাতে চান না। এটা একটা লড়াই। আমরা জেনে বুঝেই এই যুদ্ধ ক্ষেত্রে নেমেছি। আমার শো নম্বর না দিলেও আমাকে সরে যেতে হবে। যে কোনও কর্পোরেট সংস্থাতেও এ ভাবেই কাজ হয়। তেমনই এখানে নিজেদের লক্ষ্যপূরণ না করতে পারলে কর্তৃপক্ষকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।”
এই টিআরপি, প্রতিযোগিতার ভিড়ে শুধু অভিনেতা নন, ভুক্তভুগী বাকি কলাকুশলীও। বিশেষত সমস্যার মুখে পড়তে হয় দৈনিক মজুরির ভিত্তি কর্মরত সেই সব টেকনিশিয়ানদের। এ প্রসঙ্গে আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে যোগাযোগ করা হয় ফেডারশনের সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, “এই প্রবণতা বেশ কিছু দিন ধরেই আমি লক্ষ করছি। আগে আমরা জানতাম একটা ধারাবাহিক নুন্যতম ৫০০ পর্ব দেখানো হবে। এখন ১০০ পর্বেই শেষ করে দেওয়া হচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, আমাদের লেখকরা ভাল গল্প দিতে পারছেন না। নিশ্চয়ই প্রযোজক, চ্যানেলের কর্মকর্তারা নজর করবেন এই বিষয়ে। তবে আমার টেকনিশিয়ানদেরর সত্যিই সমস্যা হচ্ছে। হেয়ার, মেকআপ, লাইটের কাজে যুক্ত যাঁরা, তাঁদেরই সবচেয়ে ঝামেলায় পড়তে হয়।”বাকি কলাকুশলীর সঙ্গেও কথা বলেছিল আনন্দবাজার অনলাইন। তাঁদেরও এমনটাই মত। এই আচমকা ধারাবাহিক বন্ধের খবর জীবনে অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর্থিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। প্রতিটা মানুষের জীবনে কোনও না কোনও পরিকল্পনা থাকে। সেই সব কিছুতেই ছেদ পড়ছে। এ সব ক্ষেত্রে অনেক সময়ই আঙুল ওঠে চ্যানেলের দিকেই। তাই এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল জি এন্টারটেইনমেন্ট এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড ইস্ট ক্লাস্টার হেড সম্রাট ঘোষের সঙ্গে। তিনি জানালেন, একটি ধারাবাহিক বন্ধ হয়ে যাওয়ার নেপথ্যে শুধু মাত্র টিআরপি নয়, কাজ করে আরও অনেক কিছু বিষয়।
তিনি বলেন, “আমাদের কৃষ্ণকলি, রানি রাসমণি প্রায় চার বছর পর্যন্ত চলেছে। প্রতিটি পণ্যের একটি নির্দিষ্ট জীবনচক্র থাকে। একটা শুরু আর একটা শেষ হয়। আর অন্য ক্ষেত্রে হয় তো এক রকম ভাবনাচিন্তা করে ধারাবাহিক তৈরি করা হয়। মনে হয় নিশ্চয়ই দর্শক পছন্দ করবেন। হয়তো তা হল না। কেন হল না? সেটা কি শুধুই টিআরপি ভিত্তিতে নির্বাচিত হয়। না আমরা তা করি না। সাধারণ মানুষের থেকে প্রতিক্রিয়া, তাঁদের মতামত নেওয়া হয়। সেখান থেকে বোঝা যায়, কোনটা ভাল লাগছে দর্শকের আর কোনটা ভাল লাগছে না। তার পরেই কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।”