বড় পর্দায় প্রথম বার জুটি বাঁধতে দেখা গেল বরুণ ধওয়ান এবং জাহ্নবী কপূরকে। ছবি: সংগৃহীত।
সাদা-কালো, ভাল-মন্দ, উপর-নীচ— জীবনে সবকিছুরই একটা ছকে বাঁধা বৈপরীত্য রয়েছে। প্রত্যেক মানুষকেই যেন দু’দিকের মধ্যে যে কোনও একটি ঘরে থাকতে হয়, পরিচয় তৈরির জন্য। কিন্তু যাঁরা দুই দিকের মধ্যে কোনও খোপেই জায়গা পান না, যাঁদের অস্তিত্ব মধ্যবর্তী কোথাও একটা, তাঁরা কি আত্মপরিচয় সঙ্কটে ধীরে ধীরে ডুবে যেতে থাকেন? নীতেশ তিওয়ারি পরিচালিত ‘বাওয়াল’ ছবিটি দেখলে দর্শকের মনে এই প্রশ্ন কোথাও না কোথাও উঁকি দেবে। ‘ছিঁচোড়ে’, ‘দঙ্গল’,এবং ‘ভূতনাথ রিটানর্স’-এর মতো একাধিক ছবি সিনেপ্রেমীদের উপহার দিয়েছেন নীতেশ। এ বার পরিচালকের হাতেখড়ি হল ওটিটি প্ল্যাটফর্মে। শুক্রবার অ্যামাজন প্রাইম ভিডিয়ো প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পেয়েছে বরুণ ধওয়ান এবং জাহ্নবী কপূর অভিনীত ‘বাওয়াল’।
প্রায় আড়াই ঘণ্টা দীর্ঘ এই ছবির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন নীতেশ। রোম্যান্টিক ঘরানার এই ছবির সঙ্গে মিশে রয়েছে অ্যাডলফ হিটলার এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনাবলি। কোথাও ড্রামা, কোথাও কমেডি আবার কোথাও ভরপুর রোম্যান্স।
আশি-নব্বইয়ের শতকের পুরনো হিন্দি গান, সাদা-কালো ফ্রেম। লখনউয়ের রাস্তা দিয়ে বুলেট বাইকে চেপে যাচ্ছে অজয় দীক্ষিত ওরফে অজ্জু ভাইয়া (বরুণ ধওয়ান)। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সাদা-কালো থেকে রঙিন হয়ে ওঠে পর্দা। ছবি কিছু দূর এগোনোর পরেই অজ্জু সেই কারণও মনে হয় বাতলে দিল— ‘‘পরিবেশ এমন তৈরি করতে হয় যেন সকলের নজর তার দিকেই থাকে। ফলাফল কেমন হল সে দিকে নয়।’’
সারাটা জীবন এই ‘মহল’ থুড়ি পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তৈরি করতেই ব্যস্ত হয়ে রয়েছে অজ্জু। কারণ সমাজ তাকে নিয়ে কী ধারণা পোষণ করে তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। হাস্যরসের মধ্যে দিয়ে নিজ স্রোতে বয়ে যেতে শুরু করে ছবিটি। তার পরেই গল্পে প্রবেশ হয় নিশার (জাহ্নবী কপূর)। চিত্রনাট্যের মোড় তার পরেই ঘুরে যায়। হাস্যরসের খোলস ছেড়়ে গল্প হয়ে ওঠে গুরুগম্ভীর।
নিশা ছোটবেলা থেকেই মৃগী রোগে আক্রান্ত। দশ বছর পর আবার বিয়ের দিন সেই রোগ ফিরে আসে। সমাজে নিজের দুর্দান্ত ‘ইমেজ’ নিয়ে চলা অজ্জুর কাছে এই ঘটনা যেন এক লহমায় তার সব স্বপ্ন ভেঙেচুড়ে দেয়। পরিবারের সঙ্গে দূরত্ব, জীবন নিয়ে অসন্তুষ্ট থাকা অজ্জুর কেরিয়ারও সঙ্কটের মুখে পড়ে। কিন্তু ‘ইমেজ’ তো বজায় রাখতেই হবে। তাই নিশাকে নিয়ে ইউরোপ সফরের সিদ্ধান্ত নেয় সে। সাসপেন্ড হয়ে যাওয়া স্কুলশিক্ষক অজ্জু ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে সরাসরি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিষয় পঠনপাঠনের দায়িত্ব নিল।
সেই সূত্রেই অজ্জু এবং নিশার জটিল সম্পর্কে ঢুকে পড়ল অ্যাডলফ হিটলার এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা। রোম্যান্স এবং কমেডিতে মোড়া ছবি মুহূর্তের মধ্যেই ইতিহাস, জীবন দর্শন এবং নৈতিকতার পাঠে পরিণত হতে থাকে।
প্যারিস হোক বা অ্যামস্টারডাম, আইফেল টাওয়ার হোক বা আউশভিৎজ়ের গ্যাস চেম্বার— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কিত নানা ঘটনাবলি তুলে ধরেছেন নীতেশ। পাশাপাশি সমান্তরাল পথে চলেছে অজ্জু এবং নিশার ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লাগানোর অনবরত চেষ্টা। দু’দিক সামলাতে গিয়ে যেন অথৈজলে ডুবে গেল ‘বাওয়াল’।
বরুণ এবং জাহ্নবী এই প্রথম জুটি বাঁধলেন। পর্দায় দুই তারকার রসায়ন প্রশংসনীয়। বরুণ যে কমেডি ঘরানার হিরো ছাড়াও খানিকটা জটিল চরিত্রে ভাল অভিনয় করেন, তার ছিটেফোঁটা ধরা পড়েছে এই ছবিতে। জাহ্নবী যে তাঁর অভিনয় নিয়ে আরও পরিণত হয়ে উঠেছেন, তার প্রমাণ দিয়েছেন অভিনেত্রী। বরুণ এবং জাহ্নবীর পাশাপাশি পার্শ্বচরিত্রে মনোজ পাহোয়া, অঞ্জুমান সাক্সেনা, মুকেশ তিওয়ারি এবং প্রতীক পাচোরির মতো তারকাদের অভিনয়ও যথাযথ। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে অজ্জু-নিশার সম্পর্কের যোগসূত্র স্থাপন করার সময় বার বার যেন ছবির ছন্দ কাটে। যেন তেল এবং জল মিশিয়ে জোর করে ঘোল বানানোর আপ্রাণ চেষ্টা চলছে।
তীরে এসেও তরী ডুবিয়ে দিল ‘বাওয়াল’। ছবির ক্লাইম্যাক্স মন ভাল করা হলেও যেন দর্শকের মনে সন্তুষ্টি জোগাতে পারল না। তবুও ছবির শেষে অরিজিৎ সিংহের কণ্ঠে আবহসঙ্গীত সেই অসন্তুষ্টি একশো ভাগ পূরণ করেছে। ‘দঙ্গল’ এবং ‘ছিঁচোড়ে’ ছবির মাধ্যমে নীতেশ দর্শকমনে যেমন দাগ কেটেছিলেন, ‘বাওয়াল’ যেন সেই জায়গা পূরণ করতে পারল না। ছবির শেষে দর্শকের জন্য রয়ে গেল শুধু ঝুলিভর্তি নৈতিকতার বাণী এবং জীবনদর্শন।