তিলোত্তমার কাছে বলিউড শাহেনশার তুলনায় কিছুটা হলেও বেশি আপন বাদশা। ছবি: পিটিআই।
নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তখন দর্শকাসন প্রায় ভরে আসছে। একে একে মঞ্চে নির্ধারিত আসন দখল করছেন নিমন্ত্রিত অতিথিরা। নির্ধারিত সময়ের প্রায় তিরিশ মিনিট পর জুন মালিয়া ও সাহেব চট্টোপাধ্যায়ের সঞ্চালনায় শুরু হল ২৮তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান।
প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হবে। কিন্তু তিনি কই? শাহরুখ খান। আর শাহরুখকে ছাড়া উৎসবের উদ্বোধন তো অকল্পনীয় ব্যাপার। তা হলে কি তিনি আসছেন না? প্রশ্ন উঁকি দিল দর্শক মনে। উৎসবের চেয়ারম্যান রাজ চক্রবর্তী মঞ্চের এক পাশ থেকে সঞ্চালকদ্বয়কে কিছু বললেন। ঘোষণা করা হল, আপাতত উদ্বোধন স্থগিত রেখে আগে বিশিষ্টদের সম্মাননা জ্ঞাপনের পর্বটি আগে সেরে ফেলা হবে। জুনকে বলতে শোনা গেল, ‘‘আপনাদের চিন্তার কোনও কারণ নেই। আমাদের প্রিয় মমতাদি যখন আমন্ত্রণ জানিয়েছেন শাহরুখ নিশ্চয়ই আসবেন।’’ কথা রেখেছেন বলিউডের বাদশা।মঞ্চে তখন দর্শকের চোখে বিশিষ্টদের আপাত ‘নীরস’ সম্মাননা জ্ঞাপন চলছে।
হঠাৎই স্টেডিয়ামে জনতার গগনভেদী উচ্ছ্বাস। তাঁদের মুখে একটাই স্লোগান— ‘শাহরুখ, শাহরুখ!’ বাদশা এসে পৌঁছলেন। মঞ্চ থেকে নেমে তাঁকে বরণ করে নিতে এগিয়ে গেলেন স্বয়ং অনুষ্ঠানের ভরকেন্দ্র মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শাহরুখের সঙ্গী রানি মুখোপাধ্যায়। ‘চলতে চলতে’ ছবির জুটি মঞ্চে উপস্থিত হতেই জনতার করতালিতে ফেটে পড়ল বৃহস্পতিবারের নেতাজি ইন্ডোর।
অনুষ্ঠানে ছিল চাঁদের হাট। কে নেই! তিন বছর পর আবার উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছেন অমিতাভ বচ্চন ও জয়া বচ্চন। এসেছেন অরিজিৎ সিংহ, মহেশ ভট্ট, কুমার শানু, শত্রুঘ্ন সিন্হা। কলকাতা থেকে রয়েছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। প্রত্যেকেই তাঁদের বক্তৃতায় দর্শকের মন জয় করে নিলেন। অমিতাভ আসা মানেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হয় তাঁর নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা। কিন্তু না, বৃহস্পতিবারের নেতাজি ইন্ডোর যেন প্রমাণ করল, তিলোত্তমার কাছে বলিউড শাহেনশার তুলনায় কিছুটা হলেও বেশি আপন বাদশা।
কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে শাহরুখের উপস্থিতি মানেই তাঁর মুখে দু’-চার কথা বাংলা শোনা দর্শকের জন্য বাড়তি পাওনা। কথা রেখেছেন শাহরুখ। তাঁর বক্তৃতার শুরুতেই শাহরুখ বলেন, ‘‘দিদিকে কথা দিয়েছিলাম, কলকাতায় এলেই আমি বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করব। তবে আজকে রানিকে ফাঁসিয়ে আমার বাংলা বক্তৃতাটি তৈরি করিয়েছি। ভাল হলে প্রশংসা করবেন আর খারাপ হলে সেটা অবশ্যই রানির দোষ!’’ ‘রীতি’ মেনে শাহরুখের এই বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুকে প্রেক্ষাগৃহ হাততালিতে ফেটে পড়ে।এর পরেই শাহরুখ স্পষ্ট বাংলায় বলে ওঠেন, ‘‘কলকাতায় এসে খুব ভাল লাগছে। দিদি-দাদা এবং কলকাতার জামাইবাবুকে এই মঞ্চে দেখে আমার খুব ভাল লাগছে। অনেক দিন দেখা হয়নি তো। কিন্তু আপনাদের দেখে সব থেকে বেশি খুশি হলাম।’’
মঞ্চে শাহরুখ মানে তাঁর মুখে কোনও সংলাপ শোনা হবে না, কলকাতাবাসীর কাছে সেটা প্রায় অকল্পনীয়। এ বারও নিরাশ করেননি বাদশা। কয়েক বছর আগে এই মঞ্চেই তাঁর অভিনীত ‘জিরো’র ট্রেলার দেখিয়েছিলেন শাহরুখ। এ বারে সেরে নিলেন তাঁর নতুন ছবি ‘পাঠান’-এর প্রচার। ছবির সংলাপ তো শোনালেনই, তার সঙ্গেই বললেন, ‘‘কিছু দিন হয়তো আপনাদের সঙ্গে দেখা হয়নি। এখন তো আবার সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছে। সবাই ভাল আছে। আমি সব থেকে ভাল আছি।’’ প্রসঙ্গত, সমাজমাধ্যমে ‘পাঠান’কে বয়কটের ডাক দিয়েছে গেরুয়া শিবিরের সমর্থক। এ দিন তাঁর বক্তব্যেও ফুটে ওঠে সমাজমাধ্যমে বাড়তে থাকা নেতিবাচক চিন্তাধারার কথা। শাহরুখের কথায়, ‘‘এই ধরনের মানসিকতা সিনেমার ক্ষতি করে।’’
এর পরেই কিছুটা থেমে তিনি বলেন, ‘‘আর এটা বলতে আমার কোনও আপত্তি নেই যে চারপাশে যাই হোক না কেন জানবেন, আপনি, আমি এবং এই পৃথিবীর পজিটিভ মানুষরা প্রত্যেকেই বেঁচে আছি।’’ বিগত এক বছর শাহরুখের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গিয়েছে। ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে অভিনেতার কেরিয়ার, ফালাফালা করা হয়েছে আতশকাচের নীচে। ডিসেম্বরের সন্ধ্যায় শহরে এসে কি এখনও হেরে না যাওয়ারই বার্তা দিলেন ‘বাজিগর’?