গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
বুধবার সকাল থেকে টালিগঞ্জ ফের পুরনো মেজাজে। পরিচালক-টেকনিশিয়ান লড়াই নাকি থেমে গিয়েছে? ফেডারেশনের সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাস তাঁর প্রিয় মাননীয়ার নির্দেশেই (?) টেকনিশিয়ানদের কাজের অনুমতি দিয়েছেন। আপাত অর্থে ছবিটা সহজসরল মনে হলেও, বিষয়টি তা নয়। এই যুদ্ধে জয় হল কার, পিছিয়ে পড়ল কে, ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতিই বা হল কত, সে দিকে নজর রাখল আনন্দবাজার অনলাইন।
ফেডারেশনের সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাস আনন্দবাজার অনলাইনকে জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবারেও রাহুলকে নিয়ে টেকনিশিয়ানদের মনে ক্ষোভ রয়েছে। পরিচালকদের আচমকা কাজে যোগ না দেওয়ার বিষয়কে তিনি “পূর্বপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র” বলে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর এই বক্তব্যের সপক্ষে তিনি জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুসারী তিনি। মমতা যেমন কোনও ক্ষেত্রেই কর্মবিরতিকে সমর্থন জানান না, তিনিও পরিচালকদের কাজ বন্ধ করার সিদ্ধান্তকে সহজ ভাবে দেখেননি। আর এখানেই একটি প্রশ্ন উঠছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুসারী স্বরূপ তা হলে ৫ অগস্ট থেকে পরিচালক রাহুলের কাজ শুরুর পক্ষে সমর্থন জানালেন না কেন? উলটে তিনি আনন্দবাজার অনলাইনকে জানিয়েছেন, ৫ অগস্ট টেকনিশিয়ানেরা সিদ্ধান্ত জানাবেন, তাঁরা রাহুলের সঙ্গে কাজ করবেন কি না। অর্থাৎ, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেও স্বরূপ ‘ভাঙবেন তবু মচকাবেন না’।
দেখা যাচ্ছে, শুধু স্বরূপ নয়, এই যুদ্ধে যৌথ ভাবে জয়ের পতাকা হাতে তুলে নিলেন ‘বিশ্বাস ব্রাদার্স’। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে নভেম্বরে নতুন নিয়মনীতি নিয়ে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হবে। যেখানে ফেডারেশনের সমস্ত নিয়ম সংস্কার করা হবে। এই কমিটিতে থাকবেন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস।
যে বিষয়গুলি এখনও অস্পষ্ট, তা হল স্রেফ স্বজনপোষণের ভিত্তিতেই কি চলতে থাকবে গিল্ডের কার্ড পাওয়ার প্রক্রিয়া? না কি যোগ্যতার নিরিখে বিচার করা শুরু হবে? আর তা যদি না হয়, ‘লাপতা লেডিজ়’-এর চিত্রনাট্যকার এসআরএফটিআই-এর ছাত্র বিপ্লব গোস্বামীর মতোই কলকাতা ছেড়ে মুম্বইয়ে চলে যেতে হবে অনেককেই। মেধাবী ছাত্ররা যেমন চলে যাচ্ছেন, সে রকম মেধাবী পরিচালকেরাও চলে যাবেন ধীরে ধীরে।
না, ফেডারেশনের সভাপতি কোনও দিনই ‘ব্যানড’ শব্দটি সমর্থন করেন না। পরিবর্তে, অসহযোগ নীতিকেই টেকশিয়ানদের আন্দোলনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে চান। ফলে, পরিচালক রাহুল মুখোপাধ্যায় যখন ফেডারেশনকে লুকিয়ে বাংলাদেশে শুটিং করেন, তখন ফেডারেশনের তরফে রাহুলের বিরুদ্ধে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। সেখানে লেখা, “চিরন্তন মুখোপাধ্যায় (রাহুল) ফেডারেশনের নিয়মবিরুদ্ধ কাজ করেছেন। সেই সূত্রে ডিরেক্টর অ্যাসোসিয়েশন অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়া (ডিএইআই) তাঁকে শুটিং সংক্রান্ত কাজ বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিয়েছে।” প্রসঙ্গত, রাহুল মাসখানেক আগে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে নাকি কয়েক জন কলাকুশলীও গিয়েছিলেন।
ফেডারেশনকে না জানিয়ে শুটিং, অর্থাৎ ‘গুপি শুটিং’-কে কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত। কী এই ‘গুপি শুটিং’?
উদাহরণস্বরূপ, রিমা দাস অসমে ‘ভিলেজ রকস্টারস’ ছবিটি তৈরি করেন যা অস্কার মনোনীত হয়েছিল। সেই ছবির ইউনিটের সংখ্যা মাত্র ৪। কখন বৃষ্টি পড়বে, কখন বন্যা আসবে, সেই অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না অগুনতি মানুষের ইউনিট তৈরি করে দিনের পর দিন বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করা। ফেডারেশনের সভাপতি ও টেকনিশিয়ানেরা একেই ‘গুপি শুটিং’ বলছেন।
ফলে বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গে আর এই ধরনের শুটিং করা যাবে না। প্রকৃতির জন্য অপেক্ষা করা, কম টেকশিয়ান নিয়ে শুটিং করা যেমন বন্ধ, তেমনি স্বতন্ত্র ছবি বানানো প্রায় বন্ধ হয়ে গেল এই রাজ্যে। কারণ স্বতন্ত্র পরিচালকেরা এই ‘গুপি শুটিং’-এর আওতায় পড়ে গেলেন!
ফেডারেশনের মতে, এক একটা শুটিংয়ে গড়ে ১২০ জন টেকশিয়ান নিতে হবে। অর্থাৎ, মানুষ বেশি, ছবির বাজেট বড়। ছবির বাজেট ছোট হলে চলবে না। কিন্তু এই বাজেট দিতে রাজি হন না কোনও প্রযোজক। পরিচালকদের কাছে তাঁদের দু’টি প্রশ্ন, এক ছবির বিষয়, দুই ছবির বাজেট। সেই পরিচালক যদি কম বাজেটে ছবি না বানাতে পারেন, কাজটি অন্য পরিচালকের কাছে চলে যায়। যে ভাবে ফেডারেশনের নতুন নিয়ম অনুযায়ী, বাংলাদেশের ওয়েব প্ল্যাটফর্ম ‘চরকি’ কলকাতা থেকে চলে গেল। স্বরূপ ওরফে ফেডারেশনের দাবি, বাংলাদেশ হল ‘বিদেশ’। তাই এখানকার টেকনিশিয়ানেরা কাজ করার জন্য চার গুণ বেশি অর্থ নেবেন। স্বাভাবিক ভাবেই ‘চরকি’ সেই টাকা দেবে না, ফলে তারা বাইরে চলে গেল।
ধরা যাক, একটি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বছরে ১২টি ছবি ও ১২টি ওয়েব সিরিজ় নিয়ে আসে। ওয়েব সিরিজ়ের খরচ ধরা যাক গড়ে ১.৫ কোটি। তা হলে ১২টি ওয়েব সিরিজ়ের খরচ ১৮ কোটি। গড়ে একটি ওটিটি ছবির খরচ যদি ১ কোটি হয়, তা হলে ১২টি ছবির হিসেবে ১২ কোটি। অতএব, ‘চরকি’ চলে যাওয়ায় মোট ৩০ কোটির আর্থিক ক্ষতি হল পশ্চিমবঙ্গে!
ফেডারেশন সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাস কর্মবিরতির সময় বলেছিলেন, "শুটিং বন্ধ থাকার কারণে কোটি টাকার উপর ক্ষতি হল ৷ ডব্লিউএটিপি (ওয়েস্ট বেঙ্গল টিভি প্রোডিউসার্স) কর্মবিরতির ডাক দেওয়ার কথা অফিশিয়ালি জানায়নি ফেডারেশনকে ৷" ‘চরকি’ কলকাতায় শুটিং করতে পারলে আরও অনেক ওটিটির শুটিং হত এখানে। যদি কম করে তিনটি ওটিটির শুটিং হত, তা হলে অঙ্ক দাঁড়াত মোটামুটি দেড়শো কোটি! ফেডারেশনের কর্ণধার আর্থিক ক্ষতি নিয়ে সরব। তিনি কি জানেন ‘চরকি’ চলে যাওয়ায় কত কোটির আর্থিক ক্ষতি হয়েছে!
কলকাতায় কোনও হিন্দি ছবি শুট করা হলে চোখ বন্ধ করে ৬.৫ কোটি বাজেট থাকে টেকশিয়ানদের জন্য। তামিল, তেলুগু ছবির ক্ষেত্রেই একই হিসেব। যদি ৫টি হিন্দি ছবি আর ৫টি দক্ষিণী ছবি কলকাতায় হয় তা হলে অঙ্ক দাঁড়ায় ৬০ থেকে ৭০ কোটি। মাঝেমধ্যে তা ১০০ কোটিও ছুঁয়ে ফেলে। হিন্দি ওটিটির শুটিং সব বাইরে চলে গিয়েছে। হিন্দি ওটিটি থেকে কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকার ব্যবসা হতে পারত। শুধুমাত্র ফেডারেশনের কঠোর নিয়মাবলির কারণে তা সম্ভব হয়নি।
বাংলা ছবির ক্ষেত্রে প্রেক্ষাগৃহ থেকে সাধারণত কুড়ি থেকে পঁচিশ লক্ষ টাকা আসে। স্যাটেলাইট ও ডিজিটাল রাইটস কেনা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ছবি চললে গড়ে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা উপার্জনের জায়গা থাকে। এই টাকার মধ্যে বাংলার পরিচালকদের ছবি বানাতে হয়। প্রচারের খরচ এর মধ্যে থাকে না। প্রযোজকও আর্থিক ক্ষতির কথা মাথায় রেখেই ছবি করেন। ফলে কম বাজেটে, কম সময়ে, কম লোক নিয়ে শুটিং করাটাই সুবিধাজনক।
কিন্তু টেকশিয়ানদের দাবি, তাঁদের কাজ দিতে হবে। শুধু কাজ দেওয়া নয়। অনেক ক্ষেত্রে ধারাবাহিকে খ্যাতনামী অভিনেতাদের তুলনায় তাঁরা বেশি পারিশ্রমিক পাচ্ছেন। কম পারিশ্রমিকে খ্যাতনামী অভিনেতারা কাজ করতে চাইছেন না। ফলে ধারাবাহিকের মান পড়ছে। তাঁদের জায়গায় তাঁরা হয়তো ঠিক। বৃহৎ সংখ্যক সদস্য তাঁদের। এটা খানিকটা ‘ক্যাচ-২২ সিচ্যুয়েশন’-এর মতো। কাজ না এলে লোকে পাবে না। যত বেশি কাজ আসবে, তত বেশি লোকে কাজ পাবে। ‘সিনেমা ফ্রেন্ডলি রাজ্য’— পশ্চিমবঙ্গ থেকে এই তকমা সরে গিয়েছে।
আগে বছরে ১৪০টি বাংলা ছবি হত। এই বছরে তা ৬৫ থেকে ৭০। প্রতিটি ছবি যদি ১.৫ কোটির হয়, তা হলে প্রায় মোট প্রায় একশো কোটি। যদি বিজ্ঞাপনী ফিল্মের কথা বলা হয়, কলকাতার বিজ্ঞাপনী ফিল্মের বাজেট থাকে ২৫ লক্ষ, মুম্বইয়ের ক্ষেত্রে তা ৭০ লক্ষ। আগে পুজোর সময় অধিকাংশ বিজ্ঞাপনী ফিল্মের শুটিং হত কলকাতায়। ঠিক যে রকম আইপিএলের মরসুমে শুটিং হয় মুম্বইয়ে। সে ক্ষেত্রে হিসেব করলে আয় হতে পারত একশো কোটি। ফেডারেশনের পরিকাঠামোর জন্য সেই পথও বন্ধ!
কলকাতাকে ভালবেসে এক পরিচালক মুম্বই থেকে কলকাতায় এসে মাঝেমধ্যেই শুটিং করেন। তিনি জানালেন, তাঁর পুরো টিম মুম্বই থেকে আসে। নিয়ম অনুযায়ী ফেডারেশনের ৪-৫ জন সদস্য শুটিংয়ে শুধুমাত্র উপস্থিত থাকেন। সেটে তাঁদের কোনও কাজ থাকে না।
ফেডারেশনের এই নিয়মের বেড়াজালে প্রায় পাঁচশো কোটির আর্থিক ক্ষতি হল পশ্চিমবঙ্গে। এই ক্ষতিপূরণ হবে কী ভাবে কেউ জানে না। তা হলে বলা যেতে পারে, এই লড়াইয়ের কোনও সুরাহা হল না।
নিন্দকেরা প্রশ্ন তুলেছেন, তবে কি এটা ভোটব্যাঙ্কের লড়াই? খেয়াল করলে দেখা যাবে, টালিগঞ্জ ও নিউ আলিপুর অঞ্চলে অধিকাংশ টেকশিয়ানের বসবাস। তাঁদের কাজের সুযোগ এবং যথার্থ পারিশ্রমিক দিয়ে এলাকার বিধায়ক নাকি তাঁর ভোট সুনিশ্চিত করেন? অবশেষে ফেডারেশন-পরিচালক লড়াই বিধায়কের ভোটব্যাঙ্ক বনাম টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রির লড়াইয়ে পর্যবসিত হল পাঁচশো কোটির বিনিময়ে।