Shakti Samnta birthday

দাদার সঙ্গে দেখা হলে হয়তো বলতেন, স্টার পরিচালক থেকে স্টার লেখক হয়ে গিয়েছি

১৩ জানুয়ারি সোমবার পরিচালক শক্তি সামন্তের জন্মদিন। গুরুর জন্মদিনে আনন্দবাজার অনলাইনের পাতায় স্মৃতিচারণায় পরিচালক প্রভাত রায়।

Advertisement
প্রভাত রায়
প্রভাত রায়
শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০২৫ ১৩:৫৫
image of director Shakti Samanta

পরিচালক শক্তি সামন্ত। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।

শক্তি সামন্ত ছিলেন আমার গুরু। আজ আমি যেখানে রয়েছি, আমার পরিচিতি— সবটাই তাঁর সৌজন্যে। আমাকে কেউ চিনত না। এক সময়ে চুটিয়ে নাটক করতাম। সেখান থেকে সিনেমার প্রতি ভালবাসা। কিন্তু কোনও দিন ভাবিনি, বাংলার তাবড় অভিনেতাদের নিয়ে আমি ছবি পরিচালনা করব। মুম্বই গিয়ে নিজের ছবির শুটিং করব। এই সবটাই কিন্তু শক্তিদার জন্যই সম্ভব হয়েছিল। আজ তাঁর জন্মদিনে কিছু টুকরো স্মৃতি আনন্দবাজার অনলাইনের পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই।

Advertisement

জন্মদিন দিয়েই না-হয় শুরু করা যাক। শক্তিদার সঙ্গে যাঁরা কাজ করতেন, তাঁদের এক মাসের বোনাস দেওয়া হত তাঁর জন্মদিনে। ওঁর জন্মদিনের এটা একটা অন্য রকম বিশেষত্ব ছিল। আমরাও সারা বছর এই দিনটার অপেক্ষায় থাকতাম। তার পর ওঁর অফিসে বা কোনও হোটেলে জন্মদিনের উদ্‌যাপন। আমি যখন শক্তিদার অধীনে আমার কেরিয়ার শুরু করি— তখন মুম্বইয়ের পরিচালকদের মধ্যে তিনি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। যে বছর তাঁর জন্মদিন উদ্‌যাপন হত, সে বছর তাই স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বহু তারকা আসতেন।

এখন তো শক্তিদা আর আমাদের মধ্যে নেই। আশির দশকে সকলের বাড়িতে ফোন ছিল না। আমি কলকাতায় থাকলে তাঁর জন্মদিনে কোনও ভাবে ফোনে শুভেচ্ছা জানানোর চেষ্টা করতাম। ফোনের ও পার থেকে দাদার পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলে আমারও মন ভাল হয়ে যেত।

Bengali director Prabhat Roy remembers Shakti Samanta on his 98th birthday

একান্ত আড্ডায় শক্তি সামন্ত এবং প্রভাত রায়। ছবি সৌজন্য: একতা ভট্টাচার্য।

শক্তিদাকে এখনও আমি খুবই মিস্‌ করি। শুধু যে তাঁর কাছে কাজ শিখেছি তা তো নয়। আমার সঙ্গে দাদার একটা আত্মিক সম্পর্ক ছিল। আমি ছিলাম তাঁর পরিবারেরই একজন। এত বছর ধরে কত অজস্র ঘটনার সাক্ষী থেকেছি। দাদার দলে যদি কেউ ভাল কাজ করতেন, তা হলে সকলের সামনে তাঁর প্রশংসা করতেন। আমারও বেশ কয়েক বার সেই সৌভাগ্য হয়েছিল।

মানুষ হিসেবেও শক্তিদা ছিলেন অসাধারণ। মুম্বইয়ে তখন শুটিং করতে গেলে আমি শুটিংয়ের সরঞ্জাম নিতাম দাদার ‘নটরাজ স্টুডিয়ো’ থেকে। আমার জন্য দাদা সরঞ্জামের ভাড়ায় বিশেষ ছাড় দিতেন। মুম্বইয়ে শুটিং করতে গেলে দাদা জানতেই পারতেন। নিয়ম ছিল, তাঁর বাড়িতে গিয়ে রাতের খাবার খেতে হবে। বেণুকে (অভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তী) নিয়ে শুটিং করতে গিয়েছি। মনে আছে তখনও আমরা সকলে গিয়ে দাদার বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করে আড্ডা দিয়েছিলাম।

শক্তিদার পরমর্শ মেনে পরবর্তী সময়ে পরিচালক হিসেবে আমিও অনেক পরিণত হয়েছি। এখন জানি না, নতুনদের কোনও পরিচালক অনুপ্রাণিত করেন কি না, বা কোনও পরামর্শ দেন কি না! দাদার দু’টি পরামর্শ আমার পেশাগত জীবনে পরবর্তী সময়ে খুবই কাজে এসেছিল। ছবি পরিচালনার ক্ষেত্রে শক্তিদা দু’টি কথা বলতেন— ছবি এমন তৈরি করতে হবে যাতে তার সঙ্গে সাধারণ মানুষ তাঁদের জীবনের মিল খুঁজে পান। যেমন ধরা যাক আমার ‘শ্বেত পাথরের থালা’, ‘শুভদৃষ্টি’র মতো ছবিগুলো। অথবা ছবিকে হতে হবে লার্জার দ্যান লাইফ। সেখানে যেন প্রতিবাদের ভাষা থাকে। নায়ক যেন অ্যাকশন করেন। কারণ সাধারণ মানুষ অনেক সময়েই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারেন না। তখন সিনেমার মধ্যে তাঁরা সেই প্রতিবাদের ভাষা খোঁজার চেষ্টা করেন। ‘প্রতীক’, ‘প্রতিকার’ বা ‘লাঠি’ ছবিগুলো এই ভাবনা থেকেই তৈরি করেছিলাম।

Bengali director Prabhat Roy remembers Shakti Samanta on his 98th birthday

‘অমানুষ’-এর শুটিং ফ্লোরে (বাঁ দিক থেকে) শক্তি সামন্ত, শর্মিলা ঠাকুর, প্রভাত রায়, উৎপল দত্ত এবং উত্তম কুমার। ছবি সৌজন্য: একতা ভট্টাচার্য।

শক্তিদার সেটে সহকারী পরিচালকদের মধ্যে আমি বেশ জনপ্রিয় ছিলাম। তারকারাও শুটিংয়ের অবসরে আমার সঙ্গেই বেশি গল্প করতেন। তাই অবসরে মজা করে শক্তিদা আমাকে বলতেন, ‘‘তুমি তো স্টার অ্যাসিসট্যান্ট ডিরেক্টর। সবাই তো তোমাকেই চায়।’’ আমি যখন পরিচালক হিসেবে পরিচিতি পেলাম, তখনও শক্তিদা আমাকে অনুপ্রাণিত করতেন। জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পর দেখা করলাম। প্রণাম করতে গেলে মজা করে বললেন, ‘‘তুমি তো এখন স্টার পরিচালক। আমাকে একদম প্রণাম করবে না।’’ গত বছর আত্মজীবনী (‘ক্ল্যাপস্টিক’) লিখে ফেলেছি। সেখানে শক্তি সামন্তকে নিয়ে তো কত কথাই লিখেছি। কারণ আমি তাঁর সঙ্গে ১৭টা বছর কাটিয়েছিলাম। আজ মনে হচ্ছে, আজ দাদা যদি জীবিত থাকতেন, দেখা হলে হয়তো বলতেন, ‘‘স্টার অ্যাসিসট্যান্ট ডিরেক্টর থেকে স্টার ডিরেক্টর। এ বার স্টার লেখকও হয়ে গেলে। লেখা থামিয়ো না।’’

২০২৬ সালে শক্তি সামন্তের জন্মশতবার্ষিকী। আশা করি, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলচ্চিত্রপ্রেমীরা এবং শক্তিদার গুণগ্রাহীরা তাঁকে স্মরণ করবেন। একসময়ে আমি ভেবেছিলাম, শক্তিদাকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাতে তাঁর কোনও একটি ছবির রিমেক তৈরি করব। সেটা তো এখনও করে উঠতে পারিনি। তবে তাঁর শতবার্ষিকীতে আমারও একটা সুপ্ত বাসনা রয়েছে। শারীরিক পরিস্থিতির জন্য আমি নিজে কতটা কী করে উঠবে পারব, জানি না। শক্তিদার সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ তো অবিচ্ছেদ্য। তাই সে বছর যদি শক্তিদাকে নিয়ে শহরে দিন সাতেকের জন্য কোনও রেট্রোস্পেক্টিভ হয়, তা হলে আমি খুব খুশি হব।

(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত।)

Advertisement
আরও পড়ুন