অকপট, অন্তরঙ্গ পরীমণি। ছবি: ফেসবুক।
নায়িকা নয়, ভাল অভিনেত্রী হওয়ার সাধ নিয়ে কলকাতায় কাজ করলেন পরীমণি। দেবরাজ সিংহের ‘ফেলু বক্সী’ ছবিতে তাঁর প্রথম কাজ। ভিসা সমস্যায় শহরে ছবির প্রচারে যোগ দিতে পারেননি। কিন্তু মুঠোফোন কি কাঁটাতারের বিভেদ মানে? আনন্দবাজার অনলাইনের কাছে আরও একবার নিজেকে উজাড় করলেন দুই দেশের চর্চিত নায়িকা।
প্রশ্ন: টলিউডে পরীমণিকে স্বাগত...
পরী: (ফোনের ও পারে), কী সুন্দর বললেন! মনটা ভাল হয়ে গেল। আনন্দবাজার অনলাইনের প্রত্যেককে চিনি, আপনজন মনে হয়।
প্রশ্ন: ‘ফেলু বক্সী’তে অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়ে এ রকমই খুশি হয়েছিলেন?
পরী: সত্যি বলতে কি, অভিনয় করার ভাবনা নিয়ে কলকাতায় আসিনি। মনে মনে কোনও প্রস্তুতি না থাকলে সেটা হলে বা না হলে কোনও অনুভূতি তৈরি হয় না। আমারও তাই। কারণ, তখনও আমি পুরোপুরি মাতৃত্বে ডুবে। পদ্ম আরও ছোট। ওকে সামলে কী করে কাজ করব— সেটাই একমাত্র চিন্তা। ওকে ছেড়ে কাজ করার ভাবনাও নেই। কিন্তু ছবিতে আমার অভিনীত চরিত্র শোনার পর সেই আমি কিছুতেই ‘না’ বলতে পারলাম না। একটাই অনুরোধ, এক্ষুনি চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করবেন না। বললে ছবি দেখার আনন্দই মাটি (হাসি)।
প্রশ্ন: টলিউডে অভিনয় মানেই অধিকাংশের স্বপ্ন, দেব বা জিতের নায়িকা। নয়তো কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় কাজ। হল না বলে মনখারাপ?
পরী: বিশ্বাস করুন, একটুও না! আমি রাজি হব, সেটাই তো ঠিক ছিল না। আমার কাছে যে কোনও কাজ সম্মানের, গুরুত্বপূর্ণ। কেউ একদিনে নাম করে ফেলেন না। তা ছাড়া, কে বলতে পারে, আজ যিনি নতুন, তিনি তাঁর প্রথম কাজেই বিখ্যাত হবেন না? নতুনদের প্রতি তাই সমান বিশ্বাসী, শ্রদ্ধাশীল। দলের প্রত্যেকে প্রচণ্ড সুসংবদ্ধ। ভীষণ নিয়মনিষ্ঠ। যা দেখে মনে হবে না, ওঁরা নতুন।
প্রশ্ন: কলকাতা যে আপনাকে নায়িকা হিসেবে দেখতে চেয়েছিল...!
পরী: তা হলে তো আপনি জানেন, আমায় কোন চরিত্রে দেখা যাবে (বলেই হা হা হাসি)। সাধারণত, বাণিজ্যিক ছবিতে নায়িকা কেবল নায়কের সঙ্গে নাচাগানা, প্রেম করে। আর দুই পরিবারের মধ্যে ঝগড়া হয়। এই চেনা গণ্ডিতে সারা ক্ষণ থাকতে ভাল লাগে? ‘ফেলু বক্সী’র গল্প শোনার পর মনে হল, নায়িকা না হয়ে আমি যেটা বেছে নিয়েছি সেটা করলে অভিনয়ের অনেক সুযোগ পাব। ওই চরিত্রেই আমায় বেশি মানাবে। আরও একটা ব্যাপার, মাতৃত্বের কারণে আমি তখন পৃথুলা। শিফন জড়িয়ে নাচের মতো ছিপছিপে নই। এই দিকটাও ভুলিনি। নায়িকা তো আমি আবারও হতে পারব। আরও একটা ব্যাপার আছে..
প্রশ্ন: কী সেটা?
পরী: গতে বাঁধা কিছু নিয়ম থাকে ইন্ডাস্ট্রিতে। ইন্ডাস্ট্রির লোকেরাই দর্শকমনে নায়িকার আদল তৈরি করে দেয়। দর্শকও সেটাই বোঝেন। আমরা নিজেরাই যদি ছক না ভাঙি তা হলে আর কবে এগোব? দিন বদলেছে। এখন ‘নায়িকা’র থেকেও ‘অভিনেত্রী’ শব্দটি বেশি পছন্দ সকলের। পর্দায় কত ক্ষণ দেখা গেল— এটা নিয়ে কেউ আর মাথা ঘামান না। কত বেশি দর্শকমনে থেকে যেতে পারলাম, সেটাই আসল কথা। একটা দৃশ্যে অভিনয় করেও কিন্তু আত্মতৃপ্তি বা সমালোচকের প্রশংসা পাওয়া যায়।
প্রশ্ন: আপনি ফেলুদা বা ব্যোমকেশ পড়েছেন? রহস্য কেমন লাগে?
পরী: (মিষ্টি হেসে) ওমা! পড়িনি আবার। আমার রহস্য-রোমাঞ্চ গল্প পড়তে, ছবি দেখতে ভীষণ ভাল লাগে।
প্রশ্ন: এই ছবিতে নাকি পরীই রহস্য ছড়িয়েছেন?
পরী: দেখা যাক... আপনি কিন্তু দুষ্টুমি করে চরিত্র জেনে নেওয়ার চেষ্টা করছেন!
প্রশ্ন: নায়ক-প্রযোজক সোহম চক্রবর্তী সম্বন্ধে পরে জানব। আগে সহ-অভিনেত্রী মধুমিতা চক্রবর্তী...
পরী: (উত্তেজিত ভঙ্গিতে থামিয়ে দিয়ে) আরে, ও তো আমাদের দেশে মধুমিতা কম, ‘পাখি’ বেশি! ধারাবাহিক ‘বোঝে না সে বোঝে না’র জন্য। ওর নামে আমাদের দেশে পোশাক তৈরি হয়েছিল। দেখি, সকলে ‘পাখি ড্রেস’ পরছে! আমিও পরেছি। কী যে মিষ্টি মেয়ে, যেন সত্যিকারের ‘মধু’। খুবই সহযোগিতা করেছে। কাজের ফাঁকে আড্ডাও দিয়েছি। ও বাংলাদেশের ‘পাখি’, আমি ‘পরী’। দুইয়ে মিলে মনে হয় ভাল কিছুই হবে।
প্রশ্ন: প্রযোজক-নায়ক সোহম চক্রবর্তী?
পরী: (একটু ভেবে) খুব বেশি আড্ডা দেওয়ার সুযোগ পাইনি। তখন একটাই চিন্তা, তাড়াতাড়ি শট দিয়ে পদ্মর কাছে যেতে হবে। সেটের প্রত্যেকে সেই বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন। যে কারণে, কেউ আমায় আটকাতেন না। এও জানি, এ সব হয়েছে সোহমদার জন্যই। খুবই সহযোগী তিনি।
প্রশ্ন: সোহম পশ্চিমবাংলার শাসকদলের বিধায়ক, জানেন?
পরী: আর বলবেন না! প্রথম দিনের দৃশ্যে অভিনয় করব। সোহমদার দেহরক্ষীরা বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে। গেটের সামনে, সিঁড়ির মুখে। আমরা শিল্পীরা তো এ ভাবে কাজ করে অভ্যস্ত নই। ফলে, মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটছিল। শেষে সুন্দর করে অনুরোধ জানালাম, সোহমদা, ওঁদের একটু সরে দাঁড়াতে বলবেন? একগাল হেসে সঙ্গে সঙ্গে অনুরোধ রাখলেন। সরিয়ে দিলেন দেহরক্ষীদের। একটু চিন্তা হয়েছিল, যদি সোহমদা ভুল বোঝেন। আসলে, একজন শিল্পীকে শিল্পীর মতো করে পেতে চেয়েছিলাম।
প্রশ্ন: পরী কি খুব দুষ্টু? না ছেলেমানুষ এখনও? পুরুষ বন্ধুর হাত নিয়ে খেলা করে সকলের ঘুম ছুটিয়ে দেন...
পরী: (হাসির দমকে কথা বন্ধ। তার পর নিজেকে সামলে) ও আমার ছোটবেলার বন্ধু। আমি যখন প্রথম নাচ করতাম তখনকার বন্ধু। এত ভাল নাচে যে ওকে ‘দীপিকা পাড়ুকোন’ বলে ডাকি। আসল নাম চঞ্চল। একদিন একসঙ্গে গাড়িতে আড্ডা দিতে দিতে ফিরছিলাম। হঠাৎ মনে হল, এ রকম কিছু করলে কেমন হয়? তার যে এই ফলাফল হবে বুঝতে পারিনি।
প্রশ্ন: অনুরাগীরা ভাবলেন, আপনি আবার প্রেমে। সকলে শুভেচ্ছায় ভরিয়ে দিলেন...
পরী: (একটু থমকে) কী করে যে বোঝাই, আমার আর প্রেম আসে না। ওই জ়োন থেকে বেরিয়ে এসেছি। সকলের শুভেচ্ছা পড়তে পড়তে মনে হল, বুঝি বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। পরের দিন ঘুম থেকে উঠে তাই সমাজমাধ্যমে ভিডিয়োর পুরো অংশ দিয়ে আত্মসমর্পণ করলাম। আরও একটা জিনিস উপলব্ধি করলাম...
প্রশ্ন: প্লিজ, বলুন।
পরী: ওই যে বলে না, ‘যার বিয়ে তার হুঁশ নেই, পাড়াপড়শির ঘুম নেই’। আমার যেন সেই দশা। আমার প্রেম নিয়ে আমার যত না মাথাব্যথা, বাকিদের যেন বেশি! আরে, আমার প্রেম, নতুন প্রেম— কোথায় আমি উত্তেজনায় ফুটব। জেগে স্বপ্ন দেখব। আনন্দে মেঘমুলকে ভাসব— তা না! তাঁদের দেখি কী উৎসাহ-উদ্দীপনা। আমার প্রেম হলে ওঁদের যে কী সমস্যা! দেখি, মন-টন ভেঙে যায়। আমি কারও হব না— তাতে লোকে খুশি। একজন কারও হলেই বিশাল ব্যথা! আনন্দবাজার অনলাইনের মারফত তাই সমস্ত অনুরাগীদের জানাচ্ছি, আমি কারও নই বাবা! তোমরা খুশি থাকো।
প্রশ্ন: পরী আর নায়িকা নয়, অভিনেত্রী হতে চান। দুষ্টুমি করতে চান না। নতুন করে প্রেমে পড়তেও নারাজ! জীবন কি পরীকে বড় করে দিল?
পরী: বড় না, জীবন অনেক কিছু শিখিয়ে দিল। অনেক রকম ভাবে চলতে শেখাল। সম্ভবত, আমার এখন সেই অবস্থা যাচ্ছে। তা ছাড়া, এত প্রেম করেছি! আমার মতো ফাটিয়ে প্রেম বোধহয় ইন্ডাস্ট্রিতে কেউ করেনি (হা হা হাসি)। আমার প্রেমের তাই কোটা শেষ।
প্রশ্ন: এটা পরীর বাইরের দিক, অন্তরে পরী কি খুব একা, ক্লান্ত?
পরী: (বড় করে দম নিয়ে) নিজেকে নিয়ে এ ভাবে কোনও দিন ভাবিইনি। হ্যাঁ, কখনও কখনও অবশ্যই ক্লান্ত লাগে। দিন দুই আগেও এক সাক্ষাৎকারে বলেছি, আমি নামেই পরী। আমার তো পরীদের মতো জীবন নয়। আমিও বাকিদের মতো রক্ত-মাংসের মানুষ। আমারও মনখারাপ হয়, রাগ হয়, দুঃখ হয়। তবে এখন রাগ-অভিমান-মনখারাপের কোনও জায়গা জীবনে নেই। কার উপর রাগ করব? এই সব অনুভূতি সরে যাওয়ায় আমি সুখি। কারণ, এই অনুভূতিগুলো মনের উপরে ছাপ, চাপ— দুই-ই ফেলে। বিশেষ করে প্রেমে পড়লে। কারও ফোন ধরতে না পারলে বা আমার ফোন না ধরলে মনখারাপ (বলেই হাসি)। কী জ্বালা বলুন তো! এ সব নেই বলেই ছেলেমেয়েদের সামলেও কাজে মন দিতে পারছি। আমার এটাই চ্যালেঞ্জ ছিল, একা হাতে সন্তান মানুষ করে পেশাজীবনেও উন্নতি করব। যাতে আমার দ্বিতীয় ইনিংস নিয়ে ওরা গর্ব করতে পারে। এই মনোযোগ যদি আরও আগে দেখাতাম, তা হলে আমার অবস্থান হয়তো আরও অন্য রকম হত।
প্রশ্ন: ছেলেমেয়েদের নিয়ে কী ভাবছেন? মায়েদের তো অনেক স্বপ্ন....
পরী: সবার আগে চাইব, যেন ভাল মানুষ হয়। তার পর ওরা যেটা হতে চাইবে, সেটাই হবে। পাশে থাকব। অভিনয় করতে চাইলে আপত্তি নেই। পদ্ম ফুটবল খেলতে ভালবাসে। খেলোয়াড় হতে চাইলে সেটাও হতে পারে। ওদের ইচ্ছে আর আমার সমর্থন— ভাল কিছুই হবে, কী বলেন?
প্রশ্ন: যুগ আধুনিক হয়েছে, সমাজ নয়। ‘একা মা’-এর যাত্রা তাই এখনও কঠিন। নিজেকে কী বলে সাহস দেন?
পরী: সত্যিই খুব কঠিন। আমি পারছি মানেই সেটা সহজ নয়। তার পরেও পারছি। হাসিমুখে পারছি। খুশি মনে পারছি। দিনের শেষে এই ‘পারছি’টাই আমায় এগিয়ে যাওয়ার সাহস জোগায়।
প্রশ্ন: কলকাতা আর বাংলাদেশের বিনোদন দুনিয়ায় কাজের মধ্যে অনেক ফারাক?
পরী: কোনও ফারাক নেই। দুই দেশেই ভাল কাজ হয়। গল্প বুঝে কোনওটা তাড়াতাড়ি, কোনওটা সময় নিয়ে হয়। কিন্তু ভাল কাজ হয়। ভাষাও এক। কেবল যাতায়াতে যে সময়টুকু লাগে। বিমানে উঠলেই মনে হয়, এই তো পাশের ঘরে পৌঁছে গেলাম। কলকাতা আমার কাছে বিদেশ নয়। হ্যাঁ, শুরুতে একটু নতুন নতুন মনে হয়েছিল। ছবির শুটিংয়ের আগে বিজ্ঞাপনী ছবিতে কাজ করলাম। করতে করতে দেখলাম, সবাই খুব চেনা। কাজের ধারাও জানা।
প্রশ্ন: কলকাতায় বাড়ি কিনবেন পরী? ফুচকা, রসগোল্লা...
পরী: (উমমমম) নেব নেব। একটা বাড়ি কিনব ভাবছি।
প্রশ্ন: আর কোন কোন পরিচালক, নায়কের সঙ্গে কাজের ইচ্ছে?
পরী: সেটাও তো ভেবে দেখিনি! দাঁড়ান, (সেকেন্ডে ভেবেই) আপনাদের বুম্বাদা, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়।
প্রশ্ন: বুম্বাদার সঙ্গে আপনার কাজের কথা হয়েছিল না?
পরী: ওই জন্যই ওঁর নাম নিলাম। হ্যাঁ, একটা কাজের কথা হয়েছিল। আমি তো আনন্দে ফুটছি। হঠাৎ প্রযোজনা সংস্থার তরফ থেকে সমস্যা তৈরি হল। ব্যস, আর হল না।
প্রশ্ন: শেষে একটা দুষ্টু প্রশ্ন করি?
পরী: (হেসে ফেলে) করুন।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে, কলকাতায় যেখানে আপনি সেখানেই পাশে অভিনেতা জয় চৌধুরী....!
পরী: (হাঁ হাঁ করে উঠে) আরে আরে! কী যে বলেন। ও তো আমার বান্ধবীর বর। ওর বৌ আমার বন্ধু, আমার বোন। জয় তাই ‘দুলাভাই’, আপনাদের ভাষায় জামাইবাবু।
প্রশ্ন: কলকাতা বলে, শ্যালিকা কিন্তু জামাইবাবুর ‘আধি ঘরওয়ালি’... খুব মিষ্টি সম্পর্ক
পরী: (হাসি আর থামেই না) সত্যিই আমাদের মধ্যে খুবই মিষ্টি সম্পর্ক। খুব মজা করি আমরা। (তার পরেই কণ্ঠে ছদ্ম শঙ্কা ফুটিয়ে) দোহাই, কলকাতায় আবার এই গুঞ্জনটা যেন ছড়িয়ে দেবেন না! সংবাদিকদের বড় ভয়।
ফের হাসিতে ফেটে পড়লেন পরীমণি। লজ্জায় লাল হতে হতেও কণ্ঠে তৃপ্তির রেশ...।