বাংলাদেশি অভিনেতা জিয়াউল ফারুক অপূর্ব। ছবি: সংগৃহীত।
বাংলাদেশের রোম্যান্টিক হিরো তিনি। বড় পর্দা নয়, বরং ছোট পর্দাই তাঁকে খ্যাতি দিয়েছে। তবে এ বার টলিউডে তাঁর প্রতিম ডি গুপ্ত পরিচালিত ছবি ‘চালচিত্র’র মাধ্যমে তাঁর বড় পর্দায় হাতেখড়ি হতে চলেছে। প্রথম ছবিতেই প্রেমের খোলস ছেড়ে খলচরিত্রে তিনি। এই মুহূর্তে ছবির শুটিংয়ে কলকাতায় রয়েছেন অভিনেতা। বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় ভবানীপুরের ক্যাফেতে আনন্দবাজার অনলাইনের মুখোমুখি জিয়াউল ফারুক অপূর্ব।
প্রশ্ন: কলকাতায় কি প্রথম বার এলেন?
অপূর্ব: এটা আমার কলকাতায় চতুর্থ বার। আগে বিজ্ঞাপনের কাজে এসেছিলাম। তবে সিনেমার কাজে প্রথম বার।
প্রশ্ন: কলকাতা সেজে উঠছে দুর্গাপুজোর জন্য, কেমন লাগে এখানকার পুজো?
অপূর্ব: এই প্রথম আমি দুর্গাপুজোর সময় এলাম। আসার সময় দেখছিলাম, প্যান্ডেল বাঁধা হচ্ছে। কিছু জায়গায় আলো লাগানো হয়েছে দেখলাম। তবে পুজোতে থাকতে পারব না। কারণ, পাঁচ দিনের মধ্যেই কাজ শেষ হয়ে যাবে। দেশে ফিরে যেতে হবে।
প্রশ্ন: আপনাকে বেশির ভাগ নাটকেই মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে কিংবা প্রেমিকের চরিত্রে দেখা গিয়েছে। আপনাকে নিয়ে অন্য রকমের চরিত্র বাংলাদেশের পরিচালকেরা ভাবেন না কেন?
অপূর্ব: আমার মনে হয় দর্শকের জন্যই ভাবেন না। যখন আমরা স্কুল-কলেজে পড়ি, তখন একটি বিষয়ে ভাল করলে পরবর্তী সময়ে সেটি নিয়ে এগিয়ে যাই। আমার মনে হয়, অপূর্বর সঙ্গে রোম্যান্স পরিপূরক। তবে খুব সৌভাগ্যবানদের কপালে ‘ইমেজ’-এর তকমা জোটে, সবাই সেটা পান না। আমি সেই সৌভাগ্যবানদের এক জন। আজ এই যা কিছু, তা দর্শকের জন্যই পাওয়া, আমি কৃতজ্ঞ।
প্রশ্ন: অভিনয়ে আসেন কী ভাবে?
অপূর্ব: আমি একটি সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হই। তার পর মডেলিং শুরু করি। সেখান থেকে বিজ্ঞাপনে কাজের সুযোগ। স্বনামধন্য পরিচালক অমিতাভ রেজা চৌধুরী সুযোগ দেন। মাত্র তিন দিনের মাথায় চেহারা চিনে ফেলেন লোকজন। তার পর গাজি রাকায়েত আমাকে নাটক করতে হবে বলে একটা চিত্রনাট্য হাতে ধরিয়ে বলেন রিডিং পড়তে। আমি তাঁকে বলেছিলাম, আমি এ সব করতে পারি না। উনি আশ্বস্ত করলেন। সেই শুরু হল নাটকের কাজ। তার পর তো ভাগ্য আজ এখানে এনে দিল।
প্রশ্ন: অভিনয়ে আসার তা হলে পরিকল্পনা ছিল না?
অপূর্ব: একেবারেই কোনও পরিকল্পনা ছিল না। তবে দেখতে দেখতে ১৭ বছর কেটে গেল। আর মডেলিং কেরিয়ারকে যদি ধরেন, তা হলে বিশ বছর হয়ে গেল কাজ করছি।
প্রশ্ন: শুনেছি, আপনার কপালে বদনাম জুটেছে আপনি নাকি বদমেজাজি?
অপূর্ব: হুমমম...(খানিক হেসে)। আসলে যাঁদের সঙ্গে রাগ করার প্রয়োজন পড়েছে, তাঁদের উপর রাগ করেছি। আমি তো ‘সাইকোপ্যাথ’ নই। খামোকা রাগ করব কেন? আমি খুব সাধারণ একটা ছেলে। হাসিখুশি থাকতে ভালবাসি। কেউ আমার সামনে আনন্দ করলে সেটা দেখতে ভাল লাগে। জীবনটা তো খুব ছোট। চেষ্টা করি সবার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করার। রাগ হওয়ার মতো কারণ থাকলে তখন তো রাগ দেখাতেই পারি।
প্রশ্ন: অনেকে বলেন, আপনার নাকি আচরণগত সমস্যা রয়েছে?
অপূর্ব: আসলে এক এক জন মানুষ এক এক রকম ভাবে ভাবেন। আমাকে কে কী ভাবে দেখছেন, সেটা তাঁদের সমস্যা। আমি কেমন, সেটা আমি জানি ও উপরওয়ালা জানে।
প্রশ্ন: টলিউডের প্রথম ছবিতেই রোম্যান্টিক নায়ক থেকে একেবারে খলচরিত্রে। কী প্রস্তুতি নিয়েছেন?
অপূর্ব: (একটু ভেবে...) আগেভাগে কিছুই বলতে চাই না। তবে গল্পের অনেকগুলি সাব প্লট আছে। আমি আসলে সোজাসাপটা কথা বলতে পছন্দ করি। কিন্তু কী বলতে কী বলব, তাই চুপ করে আছি।
প্রশ্ন: টলিউডের প্রথম ছবিই ‘মাল্টিস্টারার’। আপনার চরিত্রটা কতটা প্রাধান্য পাবে, সেটা নিয়ে আপনি কি চিন্তিত?
অপূর্ব: নাহ্! এত বছর পার করে এসে এ সব নিয়ে ভাবি না। যাঁরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন, তাঁরা এ ভাবে ভাবেন। আসলে আমি গল্পটা দেখি। আর ‘চালচিত্র’ ছবির গল্পটা দুর্দান্ত। ব্যস, আর খুব বেশি ভাবনাচিন্তা করিনি। একটা ভাল ছবির অংশ হয়ে থাকতে চাই। যাঁরা এ ভাবে ভাবেন, তাঁরা খুবই জটিল। আমার এত জটিলতা নেই।
প্রশ্ন: কলকাতায় কাজের ক্ষেত্রে কোনও পূর্ব পরিকল্পনা ছিল?
অপূর্ব: ভেবেছিলাম যাই করব, ভাল কিছু করব। আর এই কাজটা আমার অন্যতম সেরাই হবে। প্রতিম দারুণ এক জন পরিচালক। তাই আর চিন্তা নেই।
প্রশ্ন: এটা তো আপনার প্রথম কাজ, যেখানে কোনও নায়িকা নেই আপনার?
অপূর্ব: এ সব বিষয়েই এখনই কিছু বলছি না।
প্রশ্ন: কলকাতা ও বাংলাদেশে শুটিংয়ের পরিবেশে কতটা পার্থক্য রয়েছে বলে মনে হয়?
অপূর্ব: ওখানে আমাকে যতটা সম্মান দেওয়া হয়, এখানেও সেই একই সম্মান ও আন্তরিকতা পেয়েছি। আমাকে ছবির অন্য তারকারা বুঝতেই দেননি, আমি বাইরের কেউ। টোটাদা (রায়চৌধুরী) চমৎকার মানুষ, অনির্বাণদার (চক্রবর্তী) তো যতই প্রশংসা করি, কম। শান্তনু (মহেশ্বরী) ভীষণ প্রাণোচ্ছল ছেলে। কলকাতায় কাজ করা বাড়িতে কাজ করার মতো। আমি যে এটা প্রথম বলছি তেমন নয়। আমাদের দেশ থেকে যাঁরাই কাজ করতে এসেছেন, তাঁরাই এটা বলেছেন। এই জায়গাটাই এমন।
প্রশ্ন: চঞ্চল চৌধুরী, মোশারফ করিম, জয়া আহসান, তাসনিয়া ফারিনরা আগেই কাজ করেছেন, আপনি নতুন সংযোজন। একটি ইন্ডাস্ট্রির প্রতিনিধিত্ব অন্য দেশে করতে গেলে বাড়তি চাপ অনুভব করেন?
অপূর্ব: আমি আজকের দিনটাতে বাঁচি। আজ আছি, কাল নেই। আজকের দিনটা ভাল কাটলে সুন্দর একটা অতীত ছেড়ে গেলাম। যদিও কপালে ভাল কিছু হওয়ার থাকে। সেটা নিশ্চয়ই হবে। আমি আগে থেকে ভেবে কিছু করতে পারব না।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের বেশির ভাগ তারকা এখানে এসে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করেন। আপনার কার সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছে?
অপূর্ব: আমার কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করার খুব ইচ্ছে রয়েছে। ওঁর অভিনয় বলুন কিংবা পরিচালনা, সবই আমার ভাল লাগে। আমি ওঁর গুণমুগ্ধ। তাঁর সব কাজই পছন্দ। সৃজিতদার সঙ্গে পরিচয় আছে। কিন্তু কাজের কথা হয়নি কখনও।
প্রশ্ন: টলিউডের কোন নায়িকার সঙ্গে আপনি জুটি বাঁধতে চাইবেন?
অপূর্ব: এটা বলা খুব শক্ত। আসলে দর্শকের কারণেই কাজ করি। তাঁরা ভাল বুঝবেন।
প্রশ্ন: এ পার বাংলার কোন অভিনেত্রীর অভিনয় পছন্দ আপনার?
অপূর্ব: আমি বললে পুরনো নায়িকাদের নাম নেব। কার নাম বলব, অন্য কাউকে মিস্ করব, সেটা চাই না।
প্রশ্ন: আপনি কি সব সময় এতটাই ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ থাকেন?
অপূর্ব: আসলে ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ থাকাটা ভুল কিছু না। যদি না আমি কাউকে আঘাত দিচ্ছি। আমি অল্প সময়ের জন্য এসেছি এখানে। একটু ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ থাকাটাই কিন্তু ভদ্রতা।
প্রশ্ন: কলকাতার খাবার কেমন লাগে আপনার?
অপূর্ব: এখানকার মাছ রান্নার পদ্ধতি বাংলাদেশের তুলনায় আলাদা। তাই এখানকার মাছ খুব পছন্দ আর কলকাতার রাবড়ি খুব ভাল লাগে।
প্রশ্ন: কিছু দিন আগে নিশো এসেছিলেন কলকাতায়। আপনার ও নিশোর মধ্যে চেহারাগত সাদৃশ্যের কারণে কাকে বেশি বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে?
অপূর্ব: বিড়ম্বনায় নিশোকে পড়তে হয়েছে। প্রচুর মানুষ ওকে অপূর্ব বলে ডাকত। ওকে বেশ ভুগতে হয়েছে তার জন্য। থ্যাঙ্ক গড যে ও নিশো হয়ে উঠতে পেরেছে। আসলে নিশোকে নিয়ে এসেছিলাম আমি। অভিনেতা হওয়ার আগে থেকে আমরা বন্ধু। আমি যখন নাটক শুরু করি, তখনই রাকাত ভাইকে বলি ওকে নাটকে নেওয়ার কথা। তার পর মাঝে অন্য কাজে ব্যস্ত ছিল। এখন আবার কাজ শুরু করেছে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে কোন নায়িকাদের সঙ্গে আপনার জুটি সব থেকে মানানসই বলে মনে হয়?
অপূর্ব: আমার সব থেকে ভাল রসায়ন ছিল তারিন জাহানের সঙ্গে। আমি অনেক কিছু শিখেছি। আমি কৃতজ্ঞ ওঁর কাছে। আমাদের জুটি দারুণ জনপ্রিয় ছিল ডিজিট্যাল যুগ হওয়ার আগে। আর বর্তমান সময়ে মেহজাবীনের সঙ্গে আমার রসায়ন দর্শক পছন্দ করেন। আসলে গল্পের উপরে সবটা নির্ভর করে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনের সঙ্গে কাজ করে সাড়া পেয়েছি।
প্রশ্ন: আপনি নাটকে এত খ্যাতি পেয়েছেন। ঢালিউডের সিনেমায় আপনাকে সে ভাবে দেখা যায়নি কেন?
অপূর্ব: আমি ‘গ্যাংস্টার রিটার্নস’ বলে একটা সিনেমা করেছিলাম। কিন্তু আচমকা সিনেমাটা নির্ধারিত সময়ের এক সপ্তাহ আগে মুক্তি পেয়ে যায়। তখন কিছু একটা হয়েছিল। আমি তো সিনেমার লোক না, বুঝতাম না। ওটা একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা জীবনের। আমি অপূর্ব হয়েছি নাটকের জন্য। সিনেমার ক্ষেত্রে ব্যাটে-বলে মেলেনি। আসলে কখনও আমার গল্প পছন্দ হয়নি, কখনও পারিশ্রমিক পছন্দ হয়নি। সব কিছু মিললে তবেই তো ভাল কাজ হয়।
প্রশ্ন: এমন এক রোম্যান্টিক হিরোকে বড় পর্দায় সুযোগই দেওয়া হল না। আক্ষেপ হয়?
অপূর্ব: এই বিষয়টা প্রযোজকরা উত্তর দিতে পারবে না। এক জন অভিনেতার দরকার দর্শকের ভালবাসা। সেই বিষয়ে আমি খুব সৌভাগ্যবান। বহু দর্শকের ভালবাসা পেয়েছি ও পেয়ে যাচ্ছি। আমার কাছে কোনও পর্দার গুরুত্ব কম অথবা বেশি নয়। সব কাজেই সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করি।
প্রশ্ন: ঢালিউডে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হয়েছেন কখনও?
অপূর্ব: আমার প্রতিদ্বন্দ্বী আমি নিজে। ঢালিউডে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে কি না, বলতে পারব না।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে বড় পর্দার হিরো বলতে কি শুধুই শাকিব খান?
অপূর্ব: এগুলো নিয়ে কথা বলতে চাই না। পরবর্তী প্রশ্নতে চলে যাওয়াই সমীচীন। (একটু থমকে...) আমি শুধু বলতে পারি তিনি ‘সুপারস্টার’। এত বছর ধরে একটা ইন্ডাস্ট্রিকে ধরে রাখতে দম লাগে। সেই সম্মান তাঁর প্রাপ্য। কেউ কারও থেকে কম বা বেশি নয়। সবার জীবনে উত্থান-পতন থাকে। আজ যে ‘সুপারস্টার’, ভবিষ্যতে অন্য কেউ সেই জায়গা নেবে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের তারকারা কি ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অনেক বেশি খোলামেলা?
অপূর্ব: আসলে এটা নির্ভর করে কে কেমন মানুষ। কেউ খুব খোলামেলা, কেউ খুব গোপনীয়তা পছন্দ করেন। আমি মনে করি, সব জায়গা এই ধরনের মানুষ আছেন।
প্রশ্ন: অপূর্বর জীবনের চালিকাশক্তি কোনটা?
অপূর্ব: যে কোনও জিনিস মধ্যে পজিটিভিটি খুঁজে নেওয়া। সারা জীবন ইতিবাচক থাকা। আমার মাথা থেকে নেতিবাচক জিনিস বাতিল করে দেওয়া।
প্রশ্ন: অভিনেতা হিসাবে নিজেকে কোথায় দেখতে চান ভবিষ্যতে?
অপূর্ব: আসলে আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবি না। যত দিন আছি, সম্মনের সঙ্গে বাঁচতে চাই।