Mrinal Sen Death anniversary

‘সাফল্য পাওয়ার পরেও বার বার নিয়ম ভেঙেছেন’, মৃণাল সেনের প্রয়াণ দিবসে লিখলেন ‘শিষ্য’ অঞ্জন

৩০ ডিসেম্বর সোমবার পরিচালক মৃণাল সেনের প্রয়াণ দিবস। প্রয়াত পরিচালকের স্মৃতিতে কলম ধরলেন তাঁর ‘শিষ্য’ দীর্ঘ দিনের সহকর্মী অঞ্জন দত্ত।

Advertisement
অঞ্জন দত্ত
অঞ্জন দত্ত
শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:২৫
image of Mrinal Sen

মৃণাল সেন। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।

ছ’বছর হয়ে গেল মৃণালদা আর আমাদের মধ্যে নেই। আমি জানি না, মৃণাল সেনকে নিয়ে বাঙালি এখন কী ভাবে। কিন্তু এটুকু বিশ্বাস রয়েছে, কোথাও না কোথাও, কেউ না কেউ মৃণালদাকে নিয়ে আজও ভাবেন। তাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হন।

Advertisement

মৃণাল সেনের সঙ্গে আমার কাজের যোগসূত্র সকলেই জানেন। ‘চালচিত্র’ থেকে সেটা শুরু হয়েছে। আমি তাঁকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়ে চলতি বছরে ‘চালচিত্র এখন’ ছবিটা পরিচালনা করেছি। তবে আজকে আমি অন্য কতগুলি বিষয় নিয়ে লিখতে চাই। মৃণালবাবুর সব থেকে বড় গুণ ছিল, তিনি নিয়ম ভাঙতে জানতেন এবং চাইতেন। বাজারের বিরুদ্ধে গিয়ে, কাজ করার ইচ্ছা আমি তাঁর থেকেই পেয়েছি। এ রকম মানুষ কিন্তু এখন আমাদের চারপাশে কমে গিয়েছেন। এই জায়গা থেকে আজও মৃণালদার অভাব অনুভব করি। উদাহরণস্বরূপ যেমন এই মুহূর্তে নাট্যকার বাদল সরকারের কথা মনে পড়ছে।

খুব কম মানুষ রয়েছেন, যাঁরা বলবেন যে ভুল করো। ভুল করতে করতে তার পর শেখো। আমার জীবনে মৃণালদা ছিলেন তেমনই একজন। কম বাজেটেও যে ছবি তৈরি করা সম্ভব, সেটাও মৃণালদার থেকেই শেখা। কোনও দিনও বক্স অফিস বা টিকিট বিক্রি নিয়ে মাথা ঘামাতে দেখিনি। সব সময় বলতেন, ‘‘অল্প টাকায় ছবি করো। তা হলে নিজের মনের মতো কাজ করতে পারবে।’’ তাঁর কাজের ধারা বা কৌশলটিও আজকের দিনে বিরল, অভাব অনুভব করি। আমি নিজেও সেই ভাবেই কাজ করার চেষ্টা করি। জানি না তাতে সফল হয়েছি কি না। তিনি আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। এখন এই ধরনের ‘অনুপ্রেরণা’র বড় অভাব।

Anjan Dutt remembers director Mrinal Sen on his 6th death anniversary

‘খারিজ’ ছবির শুটিংয়ের ফাঁকে (বাঁ দিক থেকে) অঞ্জন দত্ত, হীরালাল কুন্ডু এবং মৃণাল সেন। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।

মৃণাল সেন সারা জীবন থাকবেন না, সেটা আমি জানতাম। কিন্তু তাঁর মতো মানসিকতা যদি রয়ে যায়, তা হলে সব দিক থেকেই সমাজের মঙ্গল। একটা স্বতন্ত্রতা— যেটা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। নিজের জন্য নিজের মনের মতো কাজের ইচ্ছা— এটা কিন্তু কমে যাচ্ছে। মানুষকে যেন সব সময়েই কিছু তাড়া করে বেড়াচ্ছে। সুমন যখন ‘তোমাকে চাই’ গানটা লিখেছিলেন, তিনি নিশ্চয়ই কে কী ভাববেন, তা ভেবে লেখেননি। তাঁর ইচ্ছে হয়েছিল তাই তিনি নিজের জন্য লিখেছিলেন। তার পর সেটা জনপ্রিয় হয়েছে। এই যে প্রবণতা— আমার যেটা মনে হচ্ছে, আমি সেটাই করব। মৃণালদাও মূলত সেটাই করতেন। এ রকম হলেই কিন্তু নতুন নতুন জিনিস তৈরি হয়।

অন্য পথে হাঁটা যদি ব্যতিক্রম হয়, তা হলে তারও কিন্তু একটা চাহিদা আছে। কিন্তু আমি ব্যতিক্রমী হতে চাই বলেই তো কেউ হয় না। তাঁকে ব্যতিক্রমী করে তোলে তাঁর দর্শন, চিন্তা এবং সময়। মৃণালদা সেটা জানতেন। দেখুন না, এই একটা বাংলা ছবি করছেন তো তার পর দুম করে একটা হিন্দি ছবি। তার পর আবার বসে রইলেন। আবার তার পর হয়তো নাটক দেখছেন, গান শুনছেন। অর্থাৎ শুধুই সিনেমা করছেন তা নয়। নিজে কিছু বলছেন। তার পর নিজেকেই আবার আত্মবিশ্লেষণ করছেন। একদম খামখেয়ালি একটা মানুষ। ‘অন্তরীণ’ ছবিতে ডিম্পল কপাডিয়ার মতো এক জন বড় তারকাকে নিলেন। বিপরীতে আমি! আমি তো তখন কেউই নই। এই ছবিটাই ভাবুন, ফোনে দু’জনের কথোপকথন এবং প্রেম। কেউই হয়তো দেখবে না। ভীষণ বোরিং। কিন্তু মৃণালদা সে সব না ভেবেই ছবিটা করে ফেললেন।

একটা জিনিস উল্লেখ করতে চাই, সাফল্য আসার পর মানুষ কিন্তু থেমে যায়। কারণ তখন তাঁর একটা বাজার তৈরি হয়ে গিয়েছে। এখানেই মৃণালদা সতন্ত্র। সফল হওয়ার পরেও কিন্তু বার বার নিয়ম ভেঙেছেন। বার বার পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন। বাজারের তোয়াক্কা করেননি। শিল্পের এই চাহিদাটাই আজকে চারপাশে খুব কম দেখি। মৃণালদার মৃত্যুদিনে যাঁরা আজ তাঁর কথা ভাববেন, তাঁরা নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে সহমত হবেন।

(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত।)

Advertisement
আরও পড়ুন