টালিগঞ্জেও মমতার দাঁড়ানো নিয়ে ভাবনা চিন্তা।
পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামের পাশাপাশি কি কলকাতার টালিগঞ্জ আসন থেকেও ভোটে দাঁড়ানোর বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল এবং মমতার ঘনিষ্ঠ সূত্রে তেমনই ইঙ্গিত মিলছে। প্রসঙ্গত, তৃণমূলের প্রার্থিতালিকা ঘোষণার দিন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই বলেছিলেন, ‘‘আমি পরে টালিগঞ্জ থেকেও দাঁড়াতে পারি।’’ তখন সেটিকে কথার কথা হিসেবেই ভেবে নিয়েছিলেন সেখানে উপস্থিত সকলে। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ বলছে, মমতা ওই বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন। কারণ, সূত্রের খবর, টালিগঞ্জ আসনের ঘোষিত প্রার্থী তথা রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসকে দেওয়াল লিখন এবং প্রচারের বিষয়ে আপাতত ‘ধীরে চলো’ নীতি নিতে বলা হয়েছে। অরূপকে আগেই প্রশ্ন করা হয়েছিল, মুখ্যমন্ত্রী মমতা কি তাঁর টালিগঞ্জ আসনে লড়ছেন? কৌশলী অরূপ কূটনৈতিক জবাব দিয়েছএন, ‘‘মমতা’দি তো বাংলার সমস্ত আসনেই প্রার্থী।’’
তবে একইসঙ্গে এ-ও ঠিক যে, ওই বিষয়ে এখনও কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি মমতা। আপাতত সমস্ত পরিস্থিতিই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, নন্দীগ্রামে ভোট দ্বিতীয় দফায়, আগামী ১ এপ্রিল। আর টালিগঞ্জ আসনে ভোট চতুর্থ দফায়, ১০ এপ্রিল। ওই দফায় মনোনয়ন পেশের শেষ দিন ২৩ মার্চ। অর্থাৎ, এখনও সময় রয়েছে ১২ দিন। সম্ভবত তার মধ্যেই টালিগঞ্জে লড়া বা না-লড়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের নিরিখে টালিগঞ্জে তৃণমূল পেয়েছিল প্রায় ৪২ শতাংশ ভোট। ৩১ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিল সিপিএম। তৃতীয় স্থানে ছিল বিজেপি। তারা পেয়েছিল ২৪ শতাংশ ভোট। পক্ষান্তরে, ভবানীপুরে তৃণমূল পেয়েছিল ৪৫.৫২ শতাংশ ভোট। ৪৩.১৬ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিল বিজেপি। সিপিএম ছিল বহু পিছনে ৬.৪৮ শতাংশ। আরও পিছনে কংগ্রেস— ৩.৪৭ শতাংশ।
তবে মমতা যদি শেষপর্যন্ত নন্দীগ্রামের পাশাপাশিই টালিগঞ্জ থেকেও লড়েন, তা মোটেই নজিরবিহীন হবে না। কারণ, আগে অসংখ্য মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষেত্রে এমন নজির রয়েছে। তার মধ্যে সাম্প্রতিকটি হল কর্ণাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া। তিনি অবশ্য একটি আসনে হেরে গিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন দু’টি আসনে লড়েছিলেন অধুনাপ্রয়াত জয়ললিতাও।
ইন্দিরা গাঁধীর ক্ষেত্রেও এমন নজির রয়েছে। ১৯৮০ সালের লোকসভা ভোটে তিনি লড়েছিলেন রায়বরেলী এবং মেডক থেকে। তবে তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না। এমনকি, এমন নজির রয়েছে দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ক্ষেত্রেও। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে মোদী গুজরাতের বডোডরার পাশাপাশি উত্তরপ্রদেশের বারাণসী কেন্দ্র থেকে লড়েছিলেন। দু’টি আসনেই তিনি জেতেন। তার পর বারাণসী আসনটি রেখে তিনি বডোডরা আসনটি ছেড়ে দেন। ফলে একইসঙ্গে দু’টি আসনে লড়া যে অগৌরবের, তা নয়। বরং এমন উদাহরণ তৈরি করেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রীরাই। এমনকি, ২০১৯ সালে রাহুল গাঁধীও উত্তরপ্রদেশের অমেঠির পাশাপাশি কেরলের ওয়েনাড় আসনে লড়েন। অমেঠিতে তিনি হেরে যান। রাহুলের মা সনিয়া গাঁধীও ১৯৯৯ সালের লোকসভা ভোটে উত্তরপ্রদেশের অমেঠির পাশাপাশি কর্ণাটকের বল্লারি থেকেও দাঁড়িয়েছিলেন। সনিয়া জিতেছিলেন দু’টি আসনেই। পরে তিনি বল্লারি আসনটি ছেড়ে দেন।
কেন মমতা নন্দীগ্রামের পাশাপাশি টালিগঞ্জ আসন নিয়েও ভাবনাচিন্তা করছেন, তা নিয়ে শাসক শিবিরের অন্দরে বিবিধ জল্পনা রয়েছে। প্রথমত, নিজের ভবানীপুর আসনটি শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়কে ছেড়ে দিয়ে নন্দীগ্রাম চলে যাওয়ায় বিরোধী বিজেপি মমতার বিরুদ্ধে লাগাতার রাজনৈতিক আক্রমণ করছে। তাদের বক্তব্য, শহরে নিজের আসন ছেড়ে দিয়ে গ্রামের আসনে গিয়ে ভোট লড়ছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই সমালোচকদের জবাব দিতে মমতা ভবানীপুরের পাশের আসন টালিগঞ্জে লড়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। ঘটনাচক্রে, পরিসংখ্যআন বলছে, গত লোকসভা ভোটে ভবানীপুরে যখন তৃণমূল এবং বিজেপি-র মধ্যে ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে শতাংশের ফারাক ছিল মেরেকেটে ২ শতাংশ, সেখানে টালিগঞ্জে তৃণমূল এবং বিজেপি-র মধ্যে শতাংশের হিসাবে ভোটপ্রাপ্তির ফারাক ছিল প্রায় ১৮ শতাংশ। তৃণমূলের অপর একাংশের বক্তব্য, মমতা প্রথমে ভেবেছিলেন বসিরহাট বা ওই ধরনের সংখ্যালঘু-প্রধান কেন্দ্র থেকে ভোটে দাঁড়াবেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে বিজেপি তাঁকে সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কের প্রশ্নে আরও আক্রমণ করার সুযোগ পেয়ে যেত। তাই তিনি শেষপর্যন্ত নন্দীগ্রাম আসনটি বেছে নিয়েছেন।
তৃণমূলের প্রথমসারির নেতারা মনে করেন, নন্দীগ্রামে লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে মমতা ‘মাস্টারস্ট্রোক’ দিয়েছেন। কারণ, তিনি জানেন, সেখানে সংখ্যালঘু ভোট থাকলেও আসনটি ‘সংখ্যালঘু-প্রধান’ নয়। বরং সেখানে হিন্দু ভোট বেশি। এখনও মনোনয়ন পেশ না করলেও আগে থেকেই মোটামুটি নিশ্চিত ছিল যে, পূর্ব মেদিনীপুরের ‘ভূমিপুত্র’ শুভেন্দু অধিকারী বিজেপি-র টিকিটে নন্দীগ্রামে লড়বেন। প্রত্যাশিত ভাবেই শুভেন্দু সেখানে ‘হিন্দু তাস’ খেলার চেষ্টাও করবেন। নাম ঘোষণার পর শুভেন্দু সে চেষ্টা শুরু করেছেন। তা আরও গতি পাবে বিজেপি হিন্দুত্বের ‘পোস্টারবয়’ উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে নন্দীগ্রামে প্রচার করতে আনায়। মুখ্যমন্ত্রীর জয় নিয়ে দ্বিধা না থাকলেও তৃণমূলের একাংশ মনে করছে ধর্মীয় মেরুকরণের জেরে নন্দীগ্রামের লড়াই ‘কঠিন’ হতে চলেছে। তবে সেই কারণে মমতা টালিগঞ্জ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছেন, এমন কথা মানতে নারাজ তাঁরা।