গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
শনিবার থেকে শুরু হয়ে যাচ্ছে বাংলার আট দফা নির্বাচন। শনিবার প্রথম দফা। আপাতদৃষ্টিতে লড়াই ত্রিমুখী হলেও এই ভোটে তৃণমূলের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উঠে এসেছে বিজেপি। তাদের তুলনায় অনেকটাই পিছনে পায়ে বাম-কংগ্রেস-সিদ্দিক জোট। তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদিও তৃতীয় বার ক্ষমতায় ফেরা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী। তাঁর দাবি, বাম-কংগ্রেসের ভোট ভাঙিয়েই রাজ্যে ঘাঁটি গাড়তে সক্ষম হয়েছিল বিজেপি। তাই তাঁদের ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু রাজনীতিকদের অনেকের মতে, কয়েক বছর আগে পর্যন্ত বাংলার রাজনীতিতে যাদের কার্যত অস্তিত্বই ছিল না, সেই গেরুয়া শিবিরই নীলবাড়ির লড়াইয়ে তৃণমূলের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের থেকে তিন বছরে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপি-র ভোট বেড়েছিল ৩৮ শতাংশ। বিধানসভাতেও গেরুয়া শিবিরের সেই উত্থান তিনি রুখতে পারবেন কি না, মমতার কাছে বড় চ্যালেঞ্জ সেটাই। শনিবার প্রথমদফার ভোট থেকেই সেই চ্যালেঞ্জের দিন শুরু। শেষ ২ মে, ভোটের ফল প্রকাশের দিন।
বিজেপি-র এই উত্থান যে ‘রাতারাতি’ হয়নি, তা বিগত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যাবে। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজ্যে প্রধান বিরোধীদল হয়ে ওঠাই লক্ষ্য ছিল বিজেপি নেতৃত্বের। কিন্তু সেই লক্ষ্যপূরণের অনেক আগেই থেমে যেতে হয়েছিল তাদের। খড়্গপুর সদর, মাদারিহাট এবং বৈষ্ণবনগর— বিধানসভায় মাত্র তিনটি আসন পেয়েছিল তারা। কিন্তু ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বাংলার রাজনৈতিক সমীকরণ অনেকটাই পাল্টে যায়। ২০১৯-এ ১৮টি লোকসভা আসনে জয়লাভ করে বিজেপি। শাসকদল তৃণমূলের সঙ্গে তাদের আসনের ব্যবধান ছিল মাত্র ২। সেখান থেকেই বাংলায় ‘গেরুয়া দাপটের’ সূত্রপাত।
জোড়াফুল শিবিরের যদিও বক্তব্য, বিধানসভা নির্বাচন এবং লোকসভা নির্বাচন এক নয়। কেন্দ্রীয় নির্বাচনে কোনও দল ভাল ফল করলে রাজ্যের নির্বাচনেও তারা ভাল ফল করবে, এমনটা বলা যায় না। কিন্তু শনিবার প্রথম দফায় রাজ্যের পাঁচটি জেলার যে ৩০টি আসনে ভোট হতে চলেছে, আগের তুলনায় সেখানে বিজেপি-র শিকড় বেশ মজবুত বলেই প্রাথমিক অঙ্ক বলছে। কারণ, শনিবার পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পূর্ব মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রাম— এই পাঁচ জেলার যে ৩০টি আসনে ভোটগ্রহণ, ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে সেখানে একটিতেও জয়লাভ না করলেও ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে ওই বিধানসভা কেন্দ্রগুলির মধ্যে ২০টিতেই এগিয়ে ছিল বিজেপি। তৃণমূল এগিয়ে ছিল মাত্র ১০টিতে। অথচ ২০১৬-র পরিসংখ্যান বলছে, ওই ৩০টি আসনের ২৭টিতে জয়লাভ করেছিল তৃণমূল। দু’টি আসনে পেয়েছিল কংগ্রেস এবং একটি আসন পেয়েছিল বামশরিক আরএসপি। সে বার ওই ৩০টি আসনের একটিতেও জেতেনি বিজেপি।
গত বিধানসভা নির্বাচনে পুরুলিয়ার বান্দোয়ান, বলরামপুর, জয়পুর, মানবাজার, কাশীপুর, পাড়া এবং রঘুনাথপুর— এই সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রেই জিতেছিল তৃণমূল। কংগ্রেস জিতেছিল বাঘমুণ্ডি এবং পুরুলিয়া কেন্দ্র দু’টি। কিন্তু ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে দেখা যায়, একমাত্র মানবাজার ছাড়া বাকি সব বিধানসভা কেন্দ্রেই এগিয়ে বিজেপি। একই ভাবে, ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতন, কেশিয়াড়ি, খড়্গপুর, গড়বেতা, শালবনি এবং মেদিনীপুর— সবক’টি কেন্দ্রে তৃণমূল জয়লাভ করলেও ২০১৯-এ খড়্গপুর এবং শালবনি ছাড়া বাকি কেন্দ্রগুলিতে এগিয়ে যায় বিজেপি। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে বাঁকুড়ার শালতোড়া, রানিবাঁধ এবং রাইপুরে জয়লাভ করে তৃণমূল। ছাতনায় জেতে বাম শরিক আরএসপি। ২০১৯-এ তাদের সকলকে ছাপিয়ে ওই চারটি কেন্দ্রেই এগিয়ে যায় বিজেপি। ২০১৬-য় পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুর, কাঁথি উত্তর, কাঁথি দক্ষিণ, ভগবানপুর, খেজুরি, রামনগর এবং এগরায় জয়লাভ করে তৃণমূল। আবার ২০১৯-এ এর মধ্যে শুধুমাত্র এগরাতেই এগিয়ে ছিল বিজেপি। কিন্তু তখন সুভেন্দু অধিকারী ছিলেন তৃমমূলে। এখন তিনি বিজেপি-তে। ২০১৬ সালে ঝাড়গ্রামের বিনপুর, নয়াগ্রাম, গোপীবল্লভপুর এবং ঝাড়গ্রাম— এই চার বিধানসভা কেন্দ্রেই জয়লাভ করে তৃণমূল। ২০১৯-এ একমাত্র বিনপুর ছাড়া বাকি তিনটি কেন্দ্রেই এগিয়ে যায় বিজেপি।
২০১৬-এর বিধানসভা নির্বাচন এবং ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি-র প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধানও ‘চমকপ্রদ’। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে প্রথম দফার এই ৩০টি কেন্দ্রে মোট ৫৬,৯৩,৬১৫টি ভোট পড়েছিল। তৃণমূল পেয়েছিল ২৮,৬৯,০৯১টি ভোট। অর্থাৎ মোট ভোটের ৫০.৩৯ শতাংশ। সে বার বামেরা পেয়েছিল ১৫,৯৭,৮২১টি ভোট অর্থাৎ মোট ভোটের ২৮.০৬ শতাংশ। বিজেপি-র প্রাপ্ত ভোট ছিল ৪,০৮৯,৫৯৪। অর্থাৎ মোট ভোটের মাত্রই ৮.৬ শতাংশ। ৩,৪২,৩২৩টি ভোট পেয়েছিল কংগ্রেস। যা ছিল মোট ভোটের ৬.০১ শতাংশ । কিন্তু ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে সেই সমীকরণ আমূল বদলে যায়। সে বার এই ৩০টি কেন্দ্রে মোট ৫৯,৭৮,৬৬৮টি ভোট পড়ে। তাতে তৃণমূল-কে টপকে প্রথম স্থানে পৌঁছে যায় বিজেপি। সে বার ২৭,৬৮,৭২৭টি ভোট পায় বিজেপি। অর্থাৎ মোট ভোটের ৪৬.৩১ শতাংশ। দ্বিতীয় স্থানে থাকা তৃণমূলের সে বার প্রাপ্ত ভোট ছিল ২৫,১১,৩৭৬ অর্থাৎ ৪২.০১ শতাংশ। সেই তুলনায় বাম এবং কংগ্রেসের ভোট কমে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৩,০৯,৩৬৫ এবং ১,৩০,৫৪৭। অর্থাৎ বাম এবং কংগ্রেস সে বার মাত্র ৫.১৭ এবং ২.১৮ শতাংশ করে ভোট পেয়েছিল।
অর্থাৎ, মাত্র তিন বছরের মধ্যে বিজেপি-র ভোট ৮.৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪৬.৩১ শতাংশ হয়েছে। তার পিছনে ‘বাম-রাম’ যোগসাজস রয়েছে বলে একাধিক বার কটাক্ষ করেছে তৃণমূল। বহুবার বামেদের ঘর সামলানোর পরামর্শও দিতে দেখা গিয়েছে তৃণমূল নেত্রী মমতাকে। কিন্তু ঘটনা বলছে, ২০১৯-এ তৃণমূলেরও ৮ শতাংশ ভোট কমে গিয়েছিল। তবে নীলবাড়ির লড়াইয়ে এ বার বাম-কংগ্রেস জোট বেঁধে মাঠে নেমেছে। তাঁদের সঙ্গী হয়েছে আব্বাস সিদ্দিকির আইএসএফ। জোরকদমে প্রচারও চালাচ্ছে তারা। কিন্তু নেপাল মাহাতোর মতো নেতা যেখানে এত দিন বাঘমুণ্ডির মতো আসন আগলে রেখেছিলেন, সেখানে এ বার প্রার্থী বদল করেছে কংগ্রেস। পূর্ব মেদিনীপুরের ভগবানপুরেও প্রার্থী বদল করেছে তারা। তাতে আসন ধরে রাখা যায় কি না, তা-ই দেখার। রাজনৈতিক মহলে জল্পনা, ভোটবাক্সের নিরিখে কোনও ভাবে তারা যদি আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারে, সে ক্ষেত্রে বিজেপি-কে কিছুটা হলেও অস্বস্তিতে পড়তে হতে পারে।