গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
লোকসভা ভোটে বীরভূমে বীরত্ব দেখাবে কোন দল? এ এক কঠিন প্রশ্ন। কারণ অনেক। গত লোকসভা নির্বাচনে এই আসনে বিজেপির উত্থান ছিল চোখে পড়ার মতো। বীরভূম লোকসভার অধীনস্থ চারটি বিধানসভা আসনেই এগিয়ে যান বিজেপির প্রার্থী দুধকুমার মণ্ডল। তবে বাকি তিনটি আসনে ব্যবধান এতটাই বেশি ছিল যে, তৃণমূলের শতাব্দী রায় ৮৮,৯৪২ ভোটে জিতেছিলেন।
শুধু জিতেছিলেন বললে হবে না, ‘হ্যাটট্রিক’ করেছিলেন। তিন বার জিতে চতুর্থ বারের জয়ের প্রস্তুতি তাঁর। অভিনেত্রী শতাব্দী ২০০৯ সালে প্রথম বার নির্বাচনে দাঁড়িয়েই জেতেন। তার পরের দুই লোকসভা ভোটেও তিনি জেতেন। প্রতি বারই ব্যবধান বাড়িয়েছেন। যেমন বিজেপিও শক্তি বাড়িয়েছে ধাপে ধাপে। ২০০৯ সালে বীরভূম কেন্দ্রে বিজেপির ভোট ছিল ৪.৬২ শতাংশ। ২০১৯ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছিল ৩৮.৯৯ শতাংশ।
শতাব্দীর পরিচয় এখন অভিনেত্রীর চেয়ে অনেক বেশি নেত্রী হিসাবে। চিরকালই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বীরভূমে তৃণমূলের ‘অলঙ্কার’। এত দিন সেই দ্বন্দ্ব চাপা দিয়ে রাখতেন একা অনুব্রত মণ্ডল। যিনি ‘কেষ্ট’ নামেই বেশি পরিচিত। তৃণমূলের নেতৃত্ব জানতেন, কেষ্ট মণ্ডলের কথায় বীরভূমে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খায়। দলের বিভিন্ন গোষ্ঠীও তাঁর কথায় ওঠাবসা করে। কিন্তু অনুব্রত এখন নয়াদিল্লির তিহাড় জেলে।
বীরভূম জেলার রাজনীতিতে শতাব্দী-অনুব্রত দ্বন্দ্ব ছিল আলোচনার বিষয়। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বীরভূম আসন থেকে শতাব্দীর বদলে নিজের এক অনুগামীকে সংসদে পাঠাতে চেয়েছিলেন অনুব্রত। কিন্তু স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে অনিচ্ছা সত্ত্বেও শতাব্দীকে প্রার্থী হিসাবে মেনে নেন তিনি। সারা বছর যতই লড়াই থাকুক, ভোটের ময়দানে সকলকে এককাট্টা করে দিত কেষ্টর বাঁশি। এমনকি, শতাব্দীর সঙ্গে অনুব্রতের ‘মধুর’ সম্পর্কের ছায়া পড়েনি ভোটের বাক্সে। তাঁর ‘গুড়-বাতাসা’ তিনি খাওয়াতে জানতেন দলের অন্দরে পরস্পরের বিরোধীদেরও। বীরভূমে কেষ্ট ছাড়া তৃণমূল কষ্ট পাবে কি না, তার সঠিক ছবি পাওয়া যেতে পারে এই নির্বাচনেই।
তবে ভোটের মরসুমে বীরভূমে না থেকেও রয়েছেন কেষ্ট। তাঁর মুখে ‘গুড়-বাতাসা’, ‘চড়াম চড়াম’ এই ভোটে শোনা যাবে না ঠিকই। কিন্তু এখনও জেলা সভাপতির তিহাড়বাস নিয়ে তৃণমূল নতুন স্লোগান তুলেছে বীরভূমে। দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা হয়েছে ‘তিহাড়ে বসেই খেলা হবে’ স্লোগান। জেলা নেতৃত্ব স্পষ্ট করেই বলছেন— অনুব্রতের শুভেচ্ছা, শুভকামনা, আশীর্বাদ, অনুপ্রেরণা নিয়েই কর্মীরা কাজ করছেন। ভোটের প্রচারে মুখ্যমন্ত্রী মমতার বক্তৃতাতেও অনুব্রতের নাম এসেছে।
এই ভোটে তৃণমূলের আরও একটা চিন্তা রয়েছে। সংখ্যালঘু ভোট। সেই চিন্তা বাড়িয়ে দিচ্ছেন বাম-কংগ্রেস জোটের প্রার্থী মিল্টন রশিদ। বীরভূম আসন বরাবর ছিল কংগ্রেস এবং সিপিএমের ‘গড়’। স্বাধীনতার পরে ১৯৫২ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত টানা কংগ্রেসের হাতে থাকা বীরভূম সিপিএমের দখলে যায় ১৯৭১ সালে। ২০০৪ পর্যন্ত সেই দখল অটুট থেকেছে। শেষের দিকে টানা জিতেছেন রামচন্দ্র ডোম। তবে এই পলিটব্যুরো সদস্যকে ২০০৯ সালে প্রার্থী করেনি সিপিএম। নতুন প্রার্থী ব্রজ মুখোপাধ্যায়কে হারিয়ে জয়ের সূচনা হয় শতাব্দীর। পিছোতে পিছোতে ২০১৯ সালে সিপিএম ভোট পায় মাত্র ৬.৬৮ শতাংশ।
এ বার জোটের হয়ে প্রার্থী কংগ্রেসের মিল্টন। হাসনের এই প্রাক্তন বিধায়ক সংখ্যালঘু ভোট কতটা নিজের ঝুলিতে নিতে পারবেন, তা-ই ঠিক করে দেবে এ বার ‘বীরভূমে বীর’। এই আসনে সংখ্যালঘুদের ভোট জেতা-হারায় নির্ণায়কও বটে। সেটিই সাতটি বিধানসভা এলাকাকে আলাদা করে রেখেছে। পরিসংখ্যান বলছে, গত লোকসভা নির্বাচনে হিন্দু এলাকায় ভোট বেশি পেয়েছিল বিজেপি। শতাব্দী ৬,৫৪,০৭৭টি ভোট পেয়েছিলেন। সেখানে বিজেপির দুধকুমার পান ৫,৬৫,১৫৩ ভোট। এই কেন্দ্রের অধীনে চারটিতে পিছিয়ে থাকা সত্ত্বেও সংখ্যালঘু অধ্যুষিত বিধানসভা নলহাটি, মুরারই এবং হাসন এলাকার ভোটই শতাব্দীকে জিতিয়ে দেয়। এই তিন কেন্দ্রের অন্তর্গত ব্লকগুলিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার সংখ্যালঘুরাই। কিন্তু এ বার সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে কি না, তা নিয়ে একটু সংশয় থাকছে।
এলাকায় ‘মিষ্টভাষী’ হিসাবে পরিচিত মিল্টন যুযুধান তিন দলের মধ্যে একমাত্র সংখ্যালঘু প্রার্থী। তিনি ভোট কাটতে পারেন। তবে সিএএ নিয়ে তৃণমূল যে ‘যুদ্ধং দেহি’ মনোভাব দেখিয়েছে, তাতে সংখ্যালঘু ভোট একত্রিত হয়ে তৃণমূলের পাশে থাকবে না, এমনও বলা যায় না।
ভোটের অঙ্ক যা-ই বলুক, বিজেপি এ বার প্রার্থী নিয়ে প্রথম থেকেই ল্যাজেগোবরে। শতাব্দীর টিকিট নিয়ে তৃণমূলে কোনও অনিশ্চয়তা ছিল না। ১০ মার্চ আনুষ্ঠানিক ঘোষণাও হয়ে যায়। সেখানে বিজেপি প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে মার্চের শেষে। প্রথমে মনে করা হয়েছিল, পদ্মের ‘আদি’ নেতা দুধকুমার আবার টিকিট পাবেন। কিন্তু জানা যায়, তিনি নন, প্রাক্তন আইপিএস দেবাশিস ধর প্রার্থী। পুলিশের চাকরি থেকে ইস্তফা দিলেও রাজ্যের তরফে যে নথি পাওয়ার কথা ছিল, তা না পেতেই মনোনয়ন জমা দিয়ে দেন দেবাশিস। শীতলখুচি-কাণ্ডে নাম জড়ানো কোচবিহারের প্রাক্তন পুলিশ সুপারের মনোনয়ন বাতিল করে দেয় কমিশন। হাই কোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে গিয়েও শেষরক্ষা হয়নি। তবে দেবাশিসের ওই ‘পরিণতি’ আগাম আন্দাজ করে ওই আসনে গত বিধানসভা নির্বাচনে হাওড়ার আমতায় প্রার্থী হওয়া দেবতনু ভট্টাচার্যের মনোনয়ন জমা দিয়ে রেখেছিল বিজেপি।
দেবাশিস প্রার্থী না দেবতনু, তা নিয়ে ভোটে প্রচারবিভ্রাটও দেখা গিয়েছে। একই পাড়ায় দুই দেওয়ালে বিজেপি প্রার্থী হিসাবে দেবাশিস ও দেবতনুর নাম রয়ে গিয়েছে। এখন অবশ্য দেবতনুর হয়েই ময়দানে লড়ছেন বিজেপির নেতা-কর্মীরা। তবে প্রার্থিবদলের ‘কাঁটা’ তাঁদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে বইকি!