(বাঁ দিক থেকে) নরেন্দ্র মোদী, বাবুন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
ভাইকে ‘ত্যাজ্য’ করলেন বটে। কিন্তু তার পাশাপাশিই নরেন্দ্র মোদীর ‘পরিবারতন্ত্র’-এর অভিযোগেরও সপাট জবাব দিয়ে রাখলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তথা শাসকদলের সর্বোচ্চ নেত্রী মমতার ভাই স্বপন (বাবুন) বন্দ্যোপাধ্যায় হাওড়া লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থীকে নিয়ে প্রকাশ্যে ক্ষোভপ্রকাশ করেছিলেন। খানিকটা ‘বিদ্রোহী’ হয়ে প্রকাশ্যে জানিয়েছিলেন, তিনি হাওড়ায় নির্দল প্রার্থী হয়ে ভোটে লড়বেন।
তৃণমূলের অন্দরে লোকজন বলাবলি করছিলেন, বাবুন নিজে হাওড়ায় তৃণমূলের প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। সে কারণে তিনি হাওড়ার ভোটারও হয়েছিলেন। তা না-হতে পেরেই তিনি ‘চাপ’ তৈরি করছেন। হতে পারে। না-ও পারে। কিন্তু বাবুন তথা গোটা বাংলার ‘দিদি’ উল্টো ‘চাপ’ তৈরি করে দিলেন পরিবারের অন্দরে। পাশাপাশিই, রাজনৈতিক বিরোধীদের উদ্দেশে বিবৃতিও দিয়ে রাখলেন।
বাবুনের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় মমতা সাফ জানান, তাঁর এবং সমগ্র বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের সঙ্গে বাবুনের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল। যা শুনে বাবুন আবার ‘ইউ টার্ন’ নিয়েছেন। বলেছেন, দিদি তাঁর ‘অভিভাবক’। তিনি আবার দিদির কাছে ঠিক নিজের জায়গা করে নেবেন। সেটা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের অন্দরের বিষয়। কিন্তু তার চেয়েও বৃহত্তর পরিসরে ‘বার্তা’ দিয়েছেন তৃণমূলনেত্রী মমতা।
আরামবাগ, কৃষ্ণনগর, বারাসত এবং শিলিগুড়ি— পশ্চিমবঙ্গে এসে সাম্প্রতিক চারটি সভাতেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ তুলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। শিলিগুড়ির সভায় ‘ভাতিজা’ (ভাইপো) শব্দবন্ধে নিশানা করেছিলেন তৃণমূলের সেনাপতি তথা পারিবারিক সম্পর্কে মমতার ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তৃণমূলের সঙ্গে এক বন্ধনীতে ফেলে কংগ্রেসকেও পরিবারতন্ত্র নিয়ে নিশানা করেছিলেন মোদী। বলেছিলেন, ‘‘তৃণমূল ও কংগ্রেস পরিবারতন্ত্রের হয়ে কাজ করছে। তৃণমূল এক ভাইপোর জন্য সব কাজ করছে আর কংগ্রেস এক শাহি পরিবারের সদস্যকে ক্ষমতায় বসাতে কাজ করে চলেছে।’’ মোদী ছাড়াও বিজেপি এবং কংগ্রেসের রাজ্য নেতারাও মমতাকে প্রায়শই অভিষেকের প্রসঙ্গ টেনে ‘পরিবারতন্ত্র’ নিয়ে আক্রমণ করেন। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী তো এক পা এগিয়ে তৃণমূলকে ‘পিসি-ভাইপোর লিমিটেড কোম্পানি’ বলে অভিহিত করে থাকেন।
তাঁদের সকলকেই বাবুনের সূত্র ধরে পাল্টা বার্তা দিয়েছেন মমতা। প্রাথমিক ভাবে বাবুনের সমালোচনা করে মমতা বলেছেন, ‘‘কিছু কিছু মানুষ আছে, যাদের সব ভোটে দাঁড়ানোর ইচ্ছা হয়! কাউন্সিলর, এমএলএ, এমপি— সব ভোটে দাঁড়াতে চায়। কিন্তু আমি পরিবারতন্ত্র করি না। মানুষতন্ত্র করি। লোভীদের আমি পছন্দ করি না।’’
বাবুনের প্রসঙ্গে মমতা আরও স্পষ্ট করে দিতে চেয়েছেন, পরিবারের লোক বলেই তিনি কাউকে ভোটে টিকিট দেন না। যাঁরা তৃণমূলে টিকিট পেয়েছেন, তাঁরা যোগ্যতার নিরিখেই পেয়েছেন। ভিন্ন প্রসঙ্গে মমতা বুধবার এ-ও বলেছেন যে, ‘‘আমি একা প্রার্থী ঠিক করিনি। যা করেছি, মিলিত ভাবেই করেছি।’’ যে প্রার্থিতালিকায় নবীন-প্রবীণের ভারসাম্যে মমতা-অভিষেকের যৌথ মতামতের ছাপ দেখা গিয়েছে। মঙ্গলবার আরও একবার তাঁর ‘বৃহত্তর পরিবার’-এর কথা বলেছেন মমতা। তৃণমূলের সর্বময় নেত্রীর কথায়, ‘‘আমার পরিবার বলে কিছু নেই। মা-মাটি-মানুষই আমার পরিবার।’’
মমতার রাজনৈতিক জীবন পাঁচ দশকেরও বেশি। তাঁর পরিবারের প্রথম সদস্য হিসাবে ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটে দাঁড়ান অভিষেক। তিনি জেতেনও। পর পর দু’বার ডায়মন্ড হারবার লোকসভা থেকে তিনি সাংসদ হয়েছেন। আসন্ন লোকসভা ভোটেও তিনি ওই আসনে তৃণমূলের প্রার্থী। অভিষেকের পরে গত কলকাতা পুরভোটে তৃণমূলের টিকিট পান মমতার ভাই কার্তিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী কাজরী বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিও জিতে কাউন্সিলর হয়েছেন। বিরোধীদের অভিযোগের মুখে অতীতে মমতা একাধিক বার বলেছেন, অভিষেকের রাজনীতিতে আসা কোনও পারিবারিক কারণে নয়। ছোটবেলা থেকেই অভিষেকের রাজনীতিতে আগ্রহ ছিল। মমতা বলেছিলেন, ‘‘সিপিএম যখন আমায় মেরেছিল, সেই সময়ে অভিষেক একা একা কাঁধে ঝান্ডা নিয়ে বাড়িতে মিছিল করে স্লোগান দিত, দিদিকে মারলে কেন? সিপিএম জবাব দাও!’’ পাশাপাশি, অভিষেক বার বার বলেছেন, একই পরিবারের একাধিক সদস্য ভোটে দাঁড়াতে পারবেন না— মোদী সরকার যদি সংসদে এমন বিল আনে ওই মর্মে আইন পাশ করাতে, তিনি গিয়ে সেই বিলে সকলের আগে ভোট দেবেন। ওই বিষয়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে খোলাখুলি চ্যালেঞ্জও জানিয়ে রেখেছেন তিনি।
মমতার বক্তব্যের সূত্র ধরেই জ্যোতিরাদিত্য শিন্ডে, অনুরাগ ঠাকুর, রাজনাথ সিংহের পুত্রের প্রসঙ্গ তুলে তৃণমূলের তরফে মোদীর বিরুদ্ধে পাল্টা পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ তোলা হয়েছে। ‘পরিবারবাদ’ নিয়ে প্রশ্ন তুলে বাংলার শাসকদল বলেছে, ‘‘এই নামগুলি কি পরিবারতন্ত্রের উদাহরণ নয়? বিজেপি এ সবের জবাব দেবে না! কারণ মোদীর গ্যারান্টি মানে জ়িরো ওয়ারেন্টি।’’