West Bengal Politics

তরুণ প্রজন্ম রাজনীতিবিমুখ নয়, বাংলায় ৪২ কেন্দ্রে মূল তিন পক্ষের ৫১ জন প্রার্থীর বয়সই ৫০ বছরের নীচে!

রাজনীতিতে বয়স নিয়ে বিভিন্ন মত এবং দর্শন রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, সব পেশার মতো রাজনীতিতেও অবসরের বয়স থাকা উচিত। আবার অনেকে মনে করেন, রাজনীতিতে বয়স নয়, অভিজ্ঞতাই আসল।

Advertisement
শোভন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০২৪ ০৯:০২
Out of 126 candidates from three mainstream political parties in 42 seats, 51 are under 50 years of age

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

কেন্দ্র যাদবপুর: তৃণমূল, বিজেপি এবং সিপিএম, তিন পক্ষের প্রার্থীরই বয়স ২৫ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে।

Advertisement

কেন্দ্র রায়গঞ্জ: তিন পক্ষের প্রার্থীরই বয়স ৫০ বছরের নীচে। যেমন দক্ষিণবঙ্গের কাঁথিতে তৃণমূল, বিজেপি এবং কংগ্রেস প্রার্থীর বয়সও ৫০-এর নীচে।

কেন্দ্র উত্তর কলকাতা: তিন প্রার্থীরই বয়স ৬০ পেরিয়ে গিয়েছে। যেমন উত্তরবঙ্গের মালদহ উত্তর, মুর্শিদাবাদ ও দমদমেও তিন প্রার্থীর সকলেই ৫০ পেরিয়ে গিয়েছেন।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

বয়সের নিরিখে বাংলার ৪২টি লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থীদের ‘বয়সবিন্যাস’ কী? মূল তিন পক্ষের প্রার্থীদের মধ্যে তরুণদের আধিক্য বেশি? না কি প্রবীণদের? আমাদের দেশের রাজনীতিতে তাঁদেরও ‘তরুণ’ বলে ধরে নেওয়া হয়, যাঁদের বয়স ৫০ পেরিয়ে গিয়েছে। আনন্দবাজার অনলাইন ততটা ‘নমনীয়’ না-হয়ে তরুণ প্রার্থী হিসেবে তাঁদেরই গণ্য করেছে, যাঁরা এখনও ৫০ পেরোননি। ৪২টি লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থীদের মূল তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ১. তরুণ (৫০ বছর অনূর্ধ্ব), ২. ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে, ৩. ৬০ বছর এবং তদূর্ধ্ব।

সেই নিরিখে যা দেখা যাচ্ছে, তাতে এটা বলা যায় যে, তরুণ প্রজন্ম ‘রাজনীতিবিমুখ’ নয়। কারণ, মোট প্রার্থীর এক-তৃতীয়াংশের বেশি অনূর্ধ্ব ৫০ বয়সের। ৬০ বছরের বেশি প্রার্থীর সংখ্যা ৪৪। আর ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে রয়েছেন ৩১ জন প্রার্থী।

ইতিহাস বলছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৮৪ সালে প্রথম সাংসদ হন। তখন তাঁর বয়স ২৯ বছর। ২০১৪ সালে যখন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম ডায়মন্ড হারবার লোকসভা থেকে জিতেছিলেন, তখন তাঁর বয়স সাতাশও ছোঁয়নি। ওই ডায়মন্ড হারবার থেকেই সিপিএমের শমীক লাহিড়ি প্রথম সাংসদ হয়েছিলেন ১৯৯৬ সালে। তখন তাঁর বয়স ২৯ বছর। তাঁকে ছাপিয়ে গিয়েছেন এই লোকসভা ভোটে তমলুকের তৃণমূল প্রার্থী দেবাংশু ভট্টাচার্য। তিনি এখন ২৮ বছরের। এই লোকসভা ভোটে তিনিই সর্বকনিষ্ঠ প্রার্থী। সিপিএমের তিন প্রার্থী দীপ্সিতা ধর, সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সৃজন ভট্টাচার্যের বয়স সদ্য ৩০ পেরিয়েছে। যেমন তৃণমূলের প্রার্থী সায়নী ঘোষও সবে ৩০ পেরিয়েছেন। গত লোকসভা ভোটেও তিরিশের কোঠায় প্রার্থী ছিলেন। নিশীথ প্রামাণিক। বিজেপির হয়ে কোচবিহার থেকে জেতার সময় তাঁর বয়স ছিল ৩৩ বছর। প্রসঙ্গত, ২৫ বছর বয়স হলেই লোকসভা ভোটে প্রার্থী হওয়া যায়।

সামগ্রিক ছবি এমন কথা বললেও সাধারণ ভাবে জনমানসে এই ধারণা রয়েছে যে, তরুণ প্রজন্ম ‘রাজনীতিবিমুখ’। রাজনীতির প্রতি তাঁদের অনীহা ক্রমে বাড়ছে। কিন্তু চলতি লোকসভা ভোটে বাংলায় মূল তিন রাজনৈতিক পক্ষের প্রার্থিতালিকা সে কথা বলছে না। দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলি তরুণ-তরুণীদের প্রার্থী করার ক্ষেত্রে জোর দিচ্ছে। প্রসঙ্গত, রাজনীতিতে অবসরের বয়স নিয়ে প্রথম প্রকাশ্যে বলেছিলেন তৃণমূলের সেনাপতি অভিষেক। তা নিয়ে তাঁর দলের মধ্যে বিস্তর বিতর্ক হয়েছিল (অভিষেক এখন ৩৬। তবে ৬০ বছরে রাজনীতি থেকে অবসর নেবেন বলে জানিয়েছেন)। শেষ পর্যন্ত লোকসভা ভোটে তৃণমূলের প্রার্থিতালিকা নবীন-প্রবীণ মিলিয়ে-মিশিয়ে হয়েছে। তৃণমূলে ৫০ অনূর্ধ্ব প্রার্থীর সংখ্যা ১৫ জন। ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে রয়েছেন আট জন। ষাটোর্ধ্ব মোট ১৯ জন।

নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় উল্লিখিত প্রার্থীদের বয়স অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে অনূর্ধ্ব ৫০ প্রার্থী দেওয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষে বিজেপি। এই বন্ধনীতে তাদের প্রার্থীর সংখ্যা ১৯ জন। বাম-কংগ্রেস জোটের ১৭ জন। তৃণমূল ১৫।

রাজনীতিতে বয়স নিয়ে বিভিন্ন মত এবং দর্শন রয়েছে। অভিষেক যেমন মনে করেন, সব পেশার মতো রাজনীতিতেও অবসরের বয়স নির্দিষ্ট হওয়া উচিত। তা কখনওই ৬৫-র বেশি নয়। কারণ, বয়স বাড়লে কায়িক পরিশ্রমের ক্ষমতা কমে যায়। তবে অভিষেক মমতা বা নরেন্দ্র মোদীর মতো ‘ব্যতিক্রম’-এরও উল্লেখ করেন। যেমন ক্রিকেটের ক্ষেত্রে বলেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনির কথা। অভিনয়ের ক্ষেত্রে অমিতাভ বচ্চনের কথা। তবে এর বিপরীত অভিমতও রয়েছে। যাঁরা মনে করেন, রাজনীতিতে বয়স কোনও ‘ফ্যাক্টর’ নয়। আসল বিবেচনা হল অভিজ্ঞতা। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যা বাড়ে। রাজনীতিতে অবসরের বয়স থাকার পক্ষপাতীরা সংসদীয় রাজনীতি বা ভোটে দাঁড়ানোকে ‘সূচক’ হিসেবে ধরেন। অর্থাৎ, ৬৫ বছর বয়স হয়ে গেলে নির্বাচনী রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষাকৃত কমবয়সিদের জায়গা করে দেওয়া উচিত বলে তাঁরা মনে করেন। কিন্তু অন্য অংশ মনে করেন, বয়সের ঊর্ধ্বসীমা ঠিক করে দিলে অভিজ্ঞতাকে অমর্যাদা করা হয়। মানুষ কী চাইছে, সেটাই সংশ্লিষ্ট নেতা বা প্রার্থীর ভোটের রাজনীতিতে থাকা বা না-থাকার ‘সূচক’ হওয়া উচিত। তৃণমূলের অন্দরে ফিরহাদ হাকিম এই মতামত পোষণ করেন।

লোকসভা ভোটের প্রার্থিতালিকা বলছে, তৃণমূলের মহুয়া মৈত্র, সায়নী, বিজেপির লকেট চট্টোপাধ্যায়, প্রিয়া সাহা, সিপিএমের সোনামণি মুর্মু (টুডু), দীপ্সিতা, কংগ্রেসের উর্বশী ভট্টাচার্যেরা পড়ছেন অনূর্ধ্ব ৫০ বছরের মাপকাঠিতে। এই মাপকাঠি খানিকটা শিথিল করা গেলে (৬০ বছর ঊর্ধ্বসীমা ধরলে) দেখা যাচ্ছে, ৮২ জন প্রার্থীর বয়স ষাটের মধ্যে। অর্থাৎ, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে বয়স, এমন প্রার্থীর সংখ্যা ৩১ জন। পরিসংখ্যান বলছে, এ বারের ভোটে তিন পক্ষ মিলিয়ে ষাটোর্ধ্ব প্রার্থীর সংখ্যা ৪৪। সেটিও মোট প্রার্থীর সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের চেয়ে সামান্য বেশি।

বঙ্গ রাজনীতিতে নবীন-প্রবীণ তত্ত্ব, বৃদ্ধতন্ত্র পরিচিত বিষয়। সেই প্রেক্ষিতে তরুণ প্রার্থী সংক্রান্ত এই পরিসংখ্যান নিয়ে প্রত্যাশিত ভাবেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন তৃণমূলের তারকা প্রচারক কুণাল ঘোষ। তাঁর কথায়, ‘‘আমি এই ধারাকে স্বাগত জানাই। যত বেশি কমবয়সি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করবেন, জনপ্রতিনিধি হবেন, তত বেশি রাজনীতি এবং পরিষেবা গতিশীল হবে।’’ প্রদেশ কংগ্রেসের অন্যতম মুখপাত্র সুমন রায়চৌধুরী এক জন ‘রাজনৈতিক কর্মী’ হিসেবে বলেছেন, ‘‘তরুণ প্রজন্মকে রাজনীতিবিমুখ করার নেপথ্যে রয়েছেন রাজনীতিকেরাই। আমরাই সে জন্য দায়ী। আমাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমাদেরই করতে হবে।’’ আর বিজেপির রাজ্যসভা সাংসদ শমীক ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘আমাদের দলে বয়সের মাপকাঠিতে কিছু হয় না। কিন্তু তা-ও আমরাই একমাত্র দল, যারা সারা বছর সংগঠন, রাজনীতিকে গতিশীল রাখতে নানাবিধ কার্যকলাপ জারি রাখি। নির্দিষ্ট সময় অন্তর সভাপতি বদল, প্রার্থী বদল, জয়ী সাংসদ বা বিধায়কের কেন্দ্র বদল করা হয়। সেই সামগ্রিকতার অংশ হিসেবেই তরুণেরাও জায়গা পান।’’ সিপিএম নেতা তথা দমদমের প্রার্থী সুজন চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘এই ৫০-এর মাপকাঠিকে ৩৫-এ নামিয়ে দিলে দেখবেন বামপন্থীরাই এগিয়ে। আমরা তরুণ, মধ্যবয়সি এবং প্রবীণদের ভারসাম্য রেখেই প্রার্থিতালিকা করার চেষ্টা করেছি। এটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। শুধু রাজনীতি নয়। সামাজিক বিভিন্ন সংগঠনেও এই অনুশীলন প্রয়োজন, তাতে ভবিষ্যৎ মসৃণ হবে।’’

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান প্রশান্ত রায়ও মেনে নিয়েছেন যে, ‘‘কমিউনিস্ট পার্টিগুলি চিরকালই নতুনদের সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু সার্বিক ভাবে রাজনীতিতে এই ধারার কারণ হিসেবে আমার মনে হয়, সব দলই চাইছে কলঙ্কমুক্ত হতে। নতুনদের প্রার্থী করলে তাঁদের দিকে কেউ আঙুল তুলতে পারবেন না। তাঁদের গায়ে কোনও দাগ নেই। সে কারণেই সম্ভবত এই প্রবণতা।’’ তবে পাশাপাশিই তাঁর অভিমত, কোথাও কোথাও ‘যোগ্য’ প্রার্থীর অভাবে অনেক সময় অনেক রাজনৈতিক দল তরুণদের সামনে এগিয়ে দেয়। তবে সার্বিক ভাবে এই প্রবণতা ভবিষ্যতের জন্য ‘ইতিবাচক’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement