CPM

চারটি ভোট, চারটি জোট, চারটি জট! আট বছর কেটে গেল, ‘কাঁটা’ বেছে খেতে শিখল না আলিমুদ্দিন স্ট্রিট

২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আগে আইএসএফ নিজেদের মতো প্রার্থী ঘোষণা করে দেওয়ার পর পুরনো কথাই ফিরে ফিরে আসছে বাম মহলে। এবং এ-ও বাস্তব যে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই কণ্টকবিদ্ধ হচ্ছে রাজ্য সিপিএম।

Advertisement
শোভন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০২৪ ১২:৩৩
In the last eight years, the Bengal CPM has suffered setbacks in the alliance formation process

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

আনন্দবাজার অনলাইনের ‘দিল্লিবাড়ির লড়াই: মুখোমুখি’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে একান্ত সাক্ষাৎকারে মহম্মদ সেলিম জোটের প্রশ্নে জট নিয়ে বলেছিলেন, ‘‘কাঁটা বেছেই মাছ খেতে হবে। কিন্তু কথা দিচ্ছি, গলায় আটকাবে না।’’

Advertisement

কিন্তু নওশাদ সিদ্দিকি সংক্রান্ত পরিস্থিতি যে দিকে গেল, তাতে জটায়ু থাকলে নির্ঘাত প্রশ্ন তুলতেন, ‘‘কাঁটা কি ওরা বেছে খায়?’’

একান্ত সাক্ষাৎকারে নওশাদদের নিয়ে তাঁর এবং তাঁদের আশার কথা শুনিয়েছিলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সেলিম। কিন্তু সেই সেলিমই বৃহস্পতিবার বলেছেন, ‘‘আইএসএফ অন্যের সেজে দেওয়া তামাক খাচ্ছে।’’ নওশাদ অবশ্য জোট ভাঙার দায় চাপিয়েছেন সিপিএমের ঘাড়েই।

আট বছর। চারটি বড় ভোট। দু’টি লোকসভা। দু’টি বিধানসভা। সেই চারটি ভোটেই ‘ধাক্কা’ খেয়েছে বঙ্গ সিপিএমের জোট পরিকল্পনা। কখনও তা দলীয় স্তরে। কখনও জোটসঙ্গীরা মাঝপথে হাত ছেড়েছে। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আগে আইএসএফ নিজেদের মতো প্রার্থী ঘোষণা করে দেওয়ার পরে পুরনো স্মৃতিই ফিরে ফিরে আসছে বাম তথা রাজনৈতিক মহলে। এবং এ-ও বাস্তব যে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই ‘কণ্টকবিদ্ধ’ হতে হয়েছে রাজ্য সিপিএমকে। ‘ধাক্কা’ যে অতীতেও খেতে হয়েছে এবং এ বারও হল, তা ঘরোয়া আলোচনায় মেনে নিচ্ছেন সিপিএমের প্রথম সারির একাধিক নেতাও।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার তখন প্রথম মেয়াদ শেষ করছে। সেই সরকারকে সরাতে ২০১৬ সালে জোট করেছিল বাম-কংগ্রেস। যে কংগ্রেস ২০১১ সালে তৃণমূলের সঙ্গে জোট গড়ে বামেদের ৩৪ বছরের শাসন থেকে উৎখাত করেছিল। মন্ত্রিসভাতেও গিয়েছিল। কিন্তু রাজ্যপাট মহাকরণ থেকে নবান্নে যাওয়ার আগেই মন্ত্রিসভা ছেড়ে দিয়েছিল কংগ্রেস। তার পরে তারা বামেদের হাত ধরে। বামেরাও মনে করেছিল, কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে পাঁচ বছরের তৃণমূল সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে। সেই ভোটে বাম এবং কংগ্রেস কর্মীদের মধ্যে নিচুতলায় ‘জড়তা’ ছিল। কিন্তু তার চেয়েও বড় হয়ে উঠেছিল সিপিএমের ‘অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব’। ভোটের পরে সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল, তাদের বাংলা ইউনিট কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে দলের লাইনকে লঙ্ঘন করেছে। পলিটব্যুরোর ডিভিশন বেঞ্চ কলকাতায় এসে বকুনি দিয়ে গিয়েছিল আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতাদের।

তার পরে অবশ্য সিপিএম পরবর্তী পার্টি কংগ্রেসে ঠিক করে, বিজেপি এবং কংগ্রেসের সঙ্গে সমদূরত্বের নীতি থেকে তারা সরে আসবে। ‘মূল শত্রু’ হিসেবে বিজেপিকেই চিহ্নিত করে তারা। এবং এ-ও ঠিক হয়, এক একটি রাজ্যের ‘রাজনৈতিক বাস্তবতা’ এক এক রকম। ফলে রাজ্যভিত্তিক নির্বাচনী কৌশল ঠিক হবে।

তার পরে আসে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোট। তখন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধুনাপ্রয়াত সোমেন মিত্র। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্বে সূর্যকান্ত মিশ্র। বাম এবং কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে একাধিক বৈঠক হয়। আসন সমঝোতা, কে কত আসনে লড়বে, কোন সূচকে কোন কোন আসন ভাগ-বাঁটোয়ারা হবে ইত্যাদি আলোচনার মধ্যেই দেখা গিয়েছিল, একতরফা প্রার্থিতালিকা ঘোষণা করে দিয়েছে বামেরা। পাল্টা কংগ্রেসও তাদের প্রার্থী ঘোষণা করে দেয়। সেই সময়ে সোমেনের সঙ্গে বিমান বসুর বাগ্‌যুদ্ধও হয়েছিল বিস্তর। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তোপ দেগে বিমান বলেছিলেন, ‘‘নিশ্চয়ই টাকাপয়সার খেলা হয়েছে।’’ পাল্টা সোমেন বলেছিলেন, ‘‘টেবিলের উপর দিয়ে বা নীচ দিয়ে কে টাকা নিয়েছেন, তা আমি বলতে পারব না। সেটা বিমানবাবু বলতে পারবেন।’’

তার দু’বছর পর ২০২১ সালের বিধানসভা ভোট। কিন্তু তার মধ্যে বাংলার রাজনৈতিক ভারসাম্য বদলে গিয়েছে। ২০১৯ সালের লোকসভায় রাজ্যে ১৮টি আসনে জিতে বিরোধী পরিসরে বাম-কংগ্রেসকে সরিয়ে দিয়ে গাঢ় হয়ে উঠেছে পদ্মের প্রভাব। ২০২১-এর বিধানসভায় ফের কাছাকাছি আসে বাম কংগ্রেস। সঙ্গে জুড়ে যায় সদ্যভূমিষ্ঠ আইএসএফ। তাদের গালভরা নামও হয়েছিল— ‘স‌ংযুক্ত মোর্চা’। ব্রিগেড সমাবেশও হয়েছিল। কিন্তু সেই মঞ্চেই তাল কেটে গিয়েছিল জোটের। মঞ্চে অধীর চৌধুরীর বক্তৃতা চলাকালীন আবির্ভূত হন পিরজাদা আব্বাস সিদ্দিকি। আবাসকে মঞ্চে অভিবাদন জানান সেলিম। মঞ্চের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরে আব্বাস হাত নাড়তে থাকেন জনতার দিকে। বক্তৃতা থামিয়ে দিতে হয়েছিল অধীরকে। পরিস্থিতি এমন হয় যে, পোডিয়াম ছেড়েই যচ্ছিলেন ক্রুদ্ধ অধীর। কোনও ক্রমে তাঁকে বুঝিয়েসুজিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে এনে দাঁড় করান বিমান। সেই মোর্চা আর ভোট পর্যন্ত ‘স‌ংযুক্ত’ থাকেনি। ভোটের আগেই অধীর বলে দিয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে বামেদের জোট থাকলেও আইএসএফের কোনও জোট নেই। আইএসএফকে কোথা থেকে নিয়ে আসা হল, সেই প্রশ্নে বিদ্ধ হতে হয়েছিল সিপিএমকেই।

সেই আইএসএফই এ বার জোট ভেঙে বেরিয়ে গিয়ে প্রার্থী ঘোষণা করে দিয়েছে! এমনকি, সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সেলিম যে কেন্দ্র থেকে লড়ছেন, সেই মুর্শিদাবাদেও প্রার্থী রয়েছে নওশাদদের।

বার বার কেন সিপিএমই ধাক্কা খাচ্ছে? বার বার কেন জোটে জট পাকছে? দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তথা দমদম লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘আমরা দেশের রাজনীতিকে যে দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখি, সকলে সেই একই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখবে, তা তো হয় না। কিন্তু উদ্দেশ্য ঠিক রেখে সমন্বয় রক্ষা করা, নির্বাচনী সমঝোতা করা, এগুলো সব ধারাবাহিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। কখনও তা মসৃণ হবে, কখনও হবে না। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য একটাই— দেশ বাঁচানো, সংবিধান রক্ষা করা।’’ প্রদেশ কংগ্রেসের অন্যতম মুখপাত্র সুমন রায়চৌধুরীর আবার বক্তব্য, ‘‘হতে পারে বামেরা কখনও কখনও ধাক্কা খেয়েছে। কিন্তু এখন তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক মসৃণ। তৃণমূল এবং বিজেপি-বিরোধী রাজনীতিতে সে ভাবেই আমরা আগামী দিনে এগোতে চাই।’’ তবে আইএসএফের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেছেন কংগ্রেসের সুমন। তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষের বক্তব্য অবশ্য স্পষ্ট, ‘‘ক্ষমতায় থাকার সময়েও সিপিএম শরিকদলের উপর দাদাগিরি করত। কিন্তু তখন ক্ষমতার মধু ছিল। তাই কখনও-সখনও শরিকেরা ফোঁস করলেও শেষ পর্যন্ত ফ্রন্টে থেকে যেত। কিন্তু এখন তো সিপিএম নামক জাহাজটাই ডুবে গিয়েছে। তাই তারা চাইছে খড়কুটো ধরতে। তাতে নীতি-আদর্শের বালাই নেই। ফলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে।’’

জটায়ু থাকলে বলতেন, ওরা কাঁটা বেছে খেতে জানে না।

আরও পড়ুন
Advertisement