নরেন্দ্র মোদী (বাঁ দিকে) এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র
কেন্দ্রে একটানা তৃতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় এলে ‘এক দেশ এক ভোট’ চালু করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হল বিজেপির ইস্তাহারে। রবিবার ইস্তাহার প্রকাশের পর বক্তৃতা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তিনি বলেন, “আমরা দেশে এক সঙ্গে সব ভোট করানোর পরিস্থিতি রয়েছে কি না, তা যাচাই করতে কমিটি গঠন করেছিলাম। আমরা (কমিটির) প্রস্তাবগুলি প্রয়োগ করতে কাজ শুরু করেছি।”
বিজেপি ফের ক্ষমতায় এলে এবং এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলে পশ্চিমবঙ্গের মতো অধিকাংশ রাজ্যেই লোকসভার সঙ্গেই বিধানসভা ভোট হবে। ইতিমধ্যেই এক দেশ এক ভোট নিয়ে আপত্তি তুলেছে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল-সহ অন্য বিরোধী দলগুলি। এই নীতি কার্যকরের দিকগুলি খতিয়ে দেখার জন্য প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে কেন্দ্র। গত ১৪ মার্চ লোকসভা ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার ঠিক আগে ‘এক দেশ এক ভোট’ নিয়ে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছে রিপোর্ট জমা দেয় কোবিন্দের নেতৃত্বাধীন আট সদস্যের কমিটি।
বিজেপি-বিরোধী আঞ্চলিক দলগুলির আশঙ্কা, ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতি কার্যকর হলে লোকসভার ‘ঢেউয়ে’ বিধানসভাগুলি ‘ভেসে যাবে’। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয়, সাংসদ এবং বিধায়ক নির্বাচনের ক্ষেত্রে যেটুকু বৈচিত্রের সম্ভাবনা রয়েছে, বিজেপির আগ্রাসী প্রচারের মুখে তা ভেঙে পড়বে। রবিবার ‘এক দেশ এক ভোট’ কার্যকর হওয়া নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তৃণমূলের প্রাক্তন রাজ্যসভা সাংসদ এবং দলীয় মুখপাত্র শান্তনু সেন বলেন, “বিজেপি চায় দেশে এক ভাষা, এক ধর্ম, এক রাজনৈতিক দল। এই জমিদারির বিরুদ্ধেই আমাদের লড়াই। গোটা দেশের বিরোধীরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তাই একজোট হয়েছে। কোনও ভাবেই এই আইন কার্যকর হবে না।” যদিও লোকসভা ভোটের সঙ্গেই সব রাজ্যের বিধানসভা ভোট সেরে ফেলার পক্ষে মোদী সরকারের যুক্তি হল, এতে নির্বাচনের খরচ কমবে। একটি ভোটার তালিকাতেই দু’টি নির্বাচন হওয়ায় সরকারি কর্মীদের তালিকা তৈরির কাজের চাপ কমবে। ভোটের আদর্শ আচরণ বিধির জন্য বার বার সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ থমকে থাকবে না। নীতি আয়োগ, আইন কমিশন, নির্বাচন কমিশনও এই ভাবনাকে নীতিগত সমর্থন জানিয়েছে বলে কেন্দ্রের দাবি। প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে প্রথম বার প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়ার পরেই মোদী ‘এক দেশ এক ভোট’ তত্ত্ব প্রকাশ্যে এনেছিলেন।
তৃতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় এসে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কোবিন্দ কমিটির সুপারিশ মেনে সংসদে আইন পাশ করালে ২০২৯ সাল থেকে দেশ জুড়ে একই সঙ্গে লোকসভা এবং সবগুলি রাজ্য ও দিল্লি, জম্মু-কাশ্মীর, পুদুচেরির মতো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির বিধানসভার ভোট হবে। পশ্চিমবঙ্গে পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা ২০২৬ সালে। পাঁচ বছরের মেয়াদ পূরণ করার পর পশ্চিমবঙ্গে ফের বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা ২০২৯ সালে। কিন্তু ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতি কার্যকর হলে পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনের সময়, অর্থাৎ ২০২৯ সালেই অকাল বিধানসভা ভোট হবে রাজ্যে। ২০২৬ সালে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ হবে মাত্র তিন বছরের।
বিরোধী দলগুলি আগেই প্রশ্ন তুলেছিল, ‘এক ভোট’ ব্যবস্থা চালুর পরে কেন্দ্রে বা কোনও রাজ্যে পাঁচ বছরের আগেই নির্বাচিত সরকার পড়ে গেলে কী হবে? সে ক্ষেত্রে কোবিন্দ কমিটির রিপোর্টের সুপারিশ হল, প্রয়োজনে বাকি সময়টুকুর জন্য আলাদা ভাবে নির্বাচনের আয়োজন করা যেতে পারে। কিন্তু ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর। ফলে ২০২৯-এ বেশ কিছু বিধানসভার ‘অকাল মেয়াদ শেষের’ মতোই এ ক্ষেত্রেও মোদী সরকারকে সংবিধান সংশোধন করতে হতে পারে। আর এখানেই আপত্তি বিরোধী দলগুলির।
তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগেই ‘এক দেশ এক এক’ ভোট নিয়ে নিজের আপত্তির কথা জানিয়েছেন। গত জানুয়ারি মাসে কোবিন্দ কমিটির সচিব নীতেন চন্দ্রকে চিঠি দিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী লেখেন, “আমি দুঃখিত যে এক দেশ এক ভোট ধারণার সঙ্গে একমত হতে পারছি না। আমরা এই প্রস্তাবকে সমর্থন করছি না।” চিঠিতে মমতা প্রথমেই ‘এক দেশ’ ধারণাটির সারবত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। জানান যে, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোবিশিষ্ট দেশে একটি কেন্দ্রীয় সরকার ছাড়াও একাধিক সরকার রয়েছে। এই প্রসঙ্গে তাঁর প্রশ্ন, তার পরেও ‘এক দেশ’ বা ‘ওয়ান নেশন’ ধারণায় কী ভাবে আসা হচ্ছে? চিঠিতে মমতা লেখেন, “আমি স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে। তাই আমি আপনাদের (কেন্দ্র) এই পরিকল্পনারও বিরুদ্ধে।” তা ছাড়া একাধিক জনসভা থেকেও এই নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। তাই অনেকেরই মত, এই নীতি চালু করার চেষ্টা হলে বিজেপির বিরুদ্ধে সরাসরি সংঘাতের পথে হাঁটবে শাসক তৃণমূল।
অবশ্য ভারতের অল্প কিছু রাজ্যে লোকসভার সঙ্গেই বিধানসভা ভোট হয়। সে ক্ষেত্রে এই রাজ্যগুলি থেকে কোনও বিরোধী স্বর উঠে আসার সম্ভাবনা দেখছে বিজেপি। গত দু’দশক ধরে লোকসভার সঙ্গেই অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, সিকিম এবং অরুণাচল প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন হচ্ছে। বস্তুত, ‘এক দেশ এক ভোট’ কার্যকর হলে ওই চার রাজ্য ছাড়া অন্য সবক’টি বিধানসভার মেয়াদই শেষ হবে নির্ধারিত পাঁচ বছরের আগেই।
শুধু লোকসভা-বিধানসভা নয়। পরবর্তী সময়ে সেই ‘এক ভোট’ কর্মসূচিকে পুরসভা এবং পঞ্চায়েতগুলিকেও যুক্ত করার কথা বলেছে কোবিন্দ কমিটি। রিপোর্টে সুপারিশ করা হয়েছে, পরবর্তী ধাপে লোকসভা-বিধানসভা ভোটের ১০০ দিনের মধ্যে যাতে পুরসভা ও পঞ্চায়েত ভোটগুলির আয়োজন করা যায়, তার ব্যবস্থাও করতে হবে। ফলে পরবর্তী ধাপে দেশের বিভিন্ন পঞ্চায়েত-পুরসভার মেয়াদও শেষ হতে পারে অকালেই।