প্রতীকী ছবি।
কলিকাতাবাসীর ভারী গর্ব, তাঁহাদের শহর ভারতের ‘সাংস্কৃতিক রাজধানী’। এই ‘সংস্কৃতি’ বস্তুটি কী, তাহা ভাবিবার সময় আসিয়াছে। শহরের সংস্কৃতির প্রকৃত পরিচয় তাহার সহৃদয়তা, সৌজন্য এবং সহযোগিতার ইচ্ছায়। কলিকাতা কি সেই শর্ত পূরণ করিবার দাবি করিতে পারে? পুর নির্বাচন উপলক্ষে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন নাগরিকরা এমন কিছু প্রশ্ন তুলিয়াছেন, যাহা কেবল জনপ্রতিনিধিদের নহে, গোটা শহরকেই আত্মসমীক্ষায় বাধ্য করিবে। কলিকাতায় রাস্তা পার হইবার সময়ে ট্র্যাফিক সিগন্যালের লাল-সবুজ সঙ্কেত কী করিয়া দেখিবেন দৃষ্টিহীন মানুষ? কী করিয়া ফুটব্রিজ অথবা আন্ডারপাস ব্যবহার করিবেন হুইলচেয়ারে আসীন ব্যক্তিরা? কেন র্যাম্পের অভাবে সরকারি দফতর হইতে সিনেমা হল, সবই ধরাছোঁয়ার বাহিরে থাকিবে? কেন অধিকাংশ গণশৌচালয়ে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের যোগ্য ব্যবস্থা নাই? নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করা পুর প্রশাসনের কর্তব্য। তাহাতে গাফিলতি এবং দীর্ঘসূত্রতার অর্থ কেবল কর্তব্যে ত্রুটি নহে, আইন লঙ্ঘন। প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের অধিকার আইন (২০১৬) বলিয়াছে, জনসাধারণের দ্বারা ব্যবহৃত সরকারি এবং বেসরকারি সকল ভবনকে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের ব্যবহারযোগ্য করতে হইবে। এ বিষয়ে নির্দিষ্ট বিধি না মানিলে নির্মাণকার্য সমাপ্ত হইবার শংসাপত্র দিতে পারিবে না পুরসভা। গণপরিবহণকে সকলের জন্য সুবিধাজনক করিবার নির্দেশও রহিয়াছে আইনে।
এই বিধি না মানিবার অর্থ, জনপরিসর হইতে প্রতিবন্ধীদের বিচ্ছিন্ন করিয়া রাখা, তাঁহাদের সুযোগ-বঞ্চিত করা। সংবিধানে বিধৃত সাম্যের অধিকার, এবং মর্যাদার সহিত বাঁচিবার অধিকারেরও লঙ্ঘন করা হয়। সংবিধানের আদর্শকে সরকার এমন অক্লেশে অবজ্ঞা করিলে তাহা ভয়াবহ। তবে দায় কেবল নির্বাচিত নেতাদের নহে। ফুটপাত দখল করিয়া কত না নির্মাণ হইয়াছে— মন্দির, শহিদ বেদি, পাড়ার ক্লাব ঘর, দলীয় দফতর, দোকান— কী নাই? অথচ ফুটপাতের কোনও একটি স্থান ঢালু করিয়া, তাহাকে হুইলচেয়ারের ব্যবহারযোগ্য করিবার কোনও নাগরিক-প্রচেষ্টা কোথাও চোখে পড়িবে না। তাহাতে খরচ কতটুকু? পাড়ার পূজাগুলিতেও হুইলচেয়ার প্রবেশের উপায় নাই, আক্ষেপ করিয়াছেন এক প্রতিবন্ধী সন্তানের মা। এই সামান্য ব্যবস্থা নির্মাণে ব্যয় সামান্যই। বস্তুত একটি পূজার জন্য সংগৃহীত অর্থে সমগ্র এলাকাটিই প্রতিবন্ধী-বান্ধব করা যাইতে পারে। তাহা যে এত বৎসরেও করা হয় নাই, ইহাও আমাদের সংস্কৃতি।
বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা-বঞ্চনার প্রতি। কলিকাতার বহু বিদ্যালয় আজও বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত শিশুদের প্রবেশাধিকার দিতে নারাজ। বৎসরের পর বৎসর ‘পরিকাঠামোর অভাব’ দর্শাইয়া তাহাদের দূরে রাখিয়াছে। ইহা আইনবিরুদ্ধ; অমানবিকও বটে। অথচ, পুরসভা অথবা শিক্ষা দফতর এই বিষয়ে উদাসীন, নিষ্ক্রিয়। যে কোনও বিদ্যালয়ে পড়িবার অধিকার বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর রহিয়াছে। তাহার চাহিদা মিটাইবার ব্যবস্থা না থাকিলে সেই বিদ্যালয়ের কাজ করিবার অধিকার নাই। পুর কর্তৃপক্ষ তথা রাজ্য সরকার এই বিষয়ে দায়িত্ব এড়াইতে পারে না। নাগরিক সমাজেরও কি হুঁশ ফিরিবার সময় হয় নাই?