সময়ের দাম কত, তাহার একটি হিসাব মিলিয়াছে। ভারতে পরিকাঠামো নির্মাণের ৫৪১টি বৃহৎ প্রকল্প যথাসময়ে শেষ হয় নাই, আরও কিছু প্রকল্প রূপায়ণ কালেই খরচ বাড়িয়াছে। সব মিলাইয়া অন্তত চার লক্ষ কোটি টাকা বাড়তি খরচ হইতেছে। তাহার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ভাগ আঠারো হাজার কোটি টাকা। রাজ্যে সাতাশটি প্রকল্প সময়সীমা পার করিয়াও সম্পূর্ণ হইতে পারে নাই। বর্ধিত ব্যয়ের সম্পূর্ণ হিসাব অবশ্য ইহা নহে; নিজেদের উদ্বেগ প্রকাশ করিয়া কেবল দেড়শত কোটি টাকার অধিক মূল্যের প্রকল্পগুলির হিসাবই প্রকাশ করিয়াছে প্রধানমন্ত্রীর দফতর। এই উদ্বেগ যুক্তিযুক্ত— ভারতের নানা প্রান্তে পরিকাঠামো অনুন্নত দেশগুলির সমান। তদুপরি সরকারের অর্থভান্ডারে বড়ই টানাটানি। অর্ধ-সম্পূর্ণ, সিকি-সম্পূর্ণ যে সকল নির্মাণ জলে-রোদে এবং চৌর্যবৃত্তিতে নষ্ট হইতেছে, তাহার পুনর্নির্মাণের ব্যয় রাজকোষের সঙ্কট বাড়াইবে। তবে নাগরিকের দৃষ্টিতে হিসাব করিলে সরকারি ক্ষতির হিসাবও সামান্য মনে হইতে পারে। রাস্তা, সেতু, পরিবহণ, হাসপাতাল প্রভৃতির নির্মাণ অসমাপ্ত, অর্ধসমাপ্ত থাকিবার জন্য কত মানুষের জীবন-জীবিকায় কত ক্ষতি হইয়াছে, কে তাহা নির্ধারণ করিতে পারে? এক একটি প্রজন্ম যথাযোগ্য রোজগারের সম্ভাবনা হারাইয়াছে, দেশ মানবোন্নয়নের সূচকে পিছাইয়াছে, আর্থিক বৃদ্ধির গতি মন্দ হইয়াছে। সরকারি প্রকল্পে অসম্পূর্ণতার ক্ষত অগণিত মানুষ প্রতি দিন বহন করিতেছেন। কেবল টাকা দিয়া তাহার হিসাব হয় না।
তবে টাকার হিসাবের প্রয়োজনও কম নহে। যেটুকু বলিলে রাজনৈতিক অসুবিধা নাই, কেবল ততটুকু প্রকাশ করিতেছে কেন্দ্র ও রাজ্য। কিন্তু রাজকোষের অর্থব্যয়ের বিশদ হিসাব জানিবার অধিকার নাগরিকের রহিয়াছে। যেমন, অনূর্ধ্ব দেড়শত কোটি টাকার কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সংখ্যাই অধিক, সেইগুলিতে কত বিলম্ব হইতেছে তাহার তথ্য হিসাব কোথায়? কেবল রাজ্য সরকারের অর্থে নির্মীয়মাণ প্রকল্পে কত বিলম্ব হইতেছে? রাজ্যের অধিকাংশ দফতর বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ বন্ধ করিয়াছে; রাজ্য বাজেট ও তৎপূর্ববর্তী আর্থিক সমীক্ষা সারবত্তা হারাইয়াছে; চতুর্থ অর্থ কমিশনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হইবার পাঁচ বৎসর পরেও নূতন কমিশন গঠিত হয় নাই, তাই রাজ্যের আয়-ব্যয়ের স্বাধীন বিশ্লেষণও নাই। সিএজি-র রিপোর্টে খণ্ডচিত্র মেলে শুধু। ফলে সরকারি প্রকল্পের অগ্রগতি, তথা সাফল্য-ব্যর্থতা সম্পর্কিত তথ্যের একমাত্র সূত্র হইয়া উঠিতেছে নির্বাচনী প্রচার। এই কারণেই রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় প্রকল্প প্রত্যাখ্যান করিতে উদ্যত, আর কেন্দ্র কেবল বিরোধী রাজ্যগুলির ব্যর্থতার উপর আলো ফেলিতে আগ্রহী।
কেন্দ্র ও রাজ্যে শাসক দল ক্ষমতার দ্বন্দ্বে উন্নয়নকে পণবন্দি করিয়াছে। মেট্রো রেল নির্মাণ বা জাতীয় সড়ক সংস্কারের প্রকল্পে কেন্দ্র ও রাজ্যের সহযোগিতার চাইতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই চোখে পড়ে অধিক। অথচ, পরিকাঠামো নির্মাণে গতি আনিতে হইলে আইন, বিধি, রীতি-নীতিতে সংস্কার প্রয়োজন, কেন্দ্র ও রাজ্যের সুসম্পর্ক ভিন্ন যাহা সম্ভব নহে। জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া এবং পরিবেশের ছাড়পত্র প্রাপ্তি, দরপত্র আহ্বান, বরাত দানে স্বচ্ছতা ও গতি, এই সকলের জন্য উভয় পক্ষের সংহতি আবশ্যক। তৎসহ নিয়মিত অডিট ও তাহার ফল জনসমক্ষে প্রকাশ করিলে অর্থ বাঁচিবে, গণতন্ত্রও।