জামিন পাইলেন আইনজীবী এবং সমাজকর্মী সুধা ভরদ্বাজ। তিন বৎসরেরও অধিক সময় পর। সুধা, ভীমা কোরেগাঁও-এলগার পরিষদ মামলায় গ্রেফতার হওয়া ১৬ জন ‘আরবান নকশাল’-এর এক জন। ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি মহারাষ্ট্রের ভীমা-কোরেগাঁওয়ে দলিতদের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করিয়া হিংসা ছড়ায়। অভিযোগ উঠিয়াছিল, মাওবাদীদের মদতে সমাজকর্মীরা হিংসার পরিকল্পনা করিয়াছেন। ইহা সেই মামলা, যাহাতে অন্যতম অভিযুক্ত ফাদার স্ট্যান স্বামী গত জুলাইতে জেলবন্দি অবস্থায় কার্যত বিনা চিকিৎসায় মারা যান। সুধার জামিনেও শেষ মুহূর্তে বাধা আসিয়াছিল। ১ ডিসেম্বর বম্বে হাই কোর্ট জামিন মঞ্জুর করিবার পর সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করিয়া সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হইয়াছিল তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ। সর্বোচ্চ আদালতে সেই আবেদন খারিজ হইয়াছে।
সুধা ভরদ্বাজ কে, এই প্রশ্নটি তাঁহার জামিন পাওয়া না-পাওয়ার সহিত অবিচ্ছেদ্য। তিনি দীর্ঘ সময় আদিবাসী অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। তিনি প্রশ্ন তুলিয়াছিলেন দলিত-আদিবাসীদের ন্যূনতম নাগরিক অধিকারগুলি লইয়া, প্রায় বিনামূল্যে আদিবাসীদের জমি বহুজাতিক কোম্পানিগুলির আত্মসাৎ করা লইয়া, ইহার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিলেই পুলিশের নির্বিচার গুলি, বিনা বিচারে আটক করা লইয়া। এমন প্রশ্ন করেন বলেই তিনি রাষ্ট্রের চোখে বিপজ্জনক, এবং সেই কারণেই তাঁহার জামিন সমানেই পিছাইয়া যায়। বস্তুত, ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় যাঁহারা গ্রেফতার হইয়াছিলেন, প্রত্যেকেরই মূল অপরাধ, তাঁহারা রাষ্ট্রের চোখে চোখ রাখিয়া প্রশ্ন করিতে ভয় পান না। সুধার পূর্বে এই মামলায় জামিন পাইয়াছিলেন প্রবীণ কবি ভারাভারা রাও। কিন্তু অন্য অভিযুক্তদের জামিনের আবেদন বারংবার খারিজ হইয়াছে। আশ্চর্যের বিষয় ইহাই যে, অভিযোগ এমন গুরুতর, অথচ অভিযুক্তদের কাহাকেও তিন বৎসরেও দোষী সাব্যস্ত করা গেল না। রাষ্ট্রের দাবি, সুধা ভরদ্বাজ সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্তে শামিল, এমন চক্রান্ত যাহাতে দেশের সার্বভৌমত্ব বিপদে পড়িবে। অথচ, এত দিন পরেও সেই কাজের সমর্থনে উপযুক্ত প্রমাণ পাওয়া গেল না। রাষ্ট্রশক্তির অন্যায়কে প্রশ্ন করেন, অতএব তাঁহাদের শায়েস্তা করা প্রয়োজন, ভারতে এখনও এই কথাটি স্পষ্ট বলা যায় না বলিয়াই যত মুশকিল— হরেক বাহানা খুঁজিতে হয়।
কাফিল খান হইতে সিদ্দিক কাপ্পান— শায়েস্তা করিবার উদাহরণ অনেক। গণতন্ত্রের প্রতি বর্তমান শাসকদের শ্রদ্ধা বা আস্থা আছে, তেমন প্রমাণ পেশ করা মুশকিল। মানবাধিকারও তাঁহাদের চর্চিত বিষয় নহে। ফলে, এই জমানায় প্রতিবাদীমাত্রেই সরকারি জেলে বিনা বিচারে পচিবার অধিকারী। সৌভাগ্যের বিষয়, অতি বিলম্বে হইলেও সুধা ভরদ্বাজের জামিন মিলিয়াছে। অবশিষ্ট কারাবন্দিদেরও অবিলম্বে জামিন দেওয়া হউক। রাষ্ট্র যেখানে তিন বৎসরেও কাহাকে দোষী প্রমাণ করিতে পারে না, তখন তাঁহাদের নির্বিচারে আটকাইয়া রাখিবার কোনও অধিকার রাষ্ট্রের থাকিতে পারে না। কে জামিন পাইলে তাহা বিচারের পক্ষে বিপজ্জনক, সেই বিষয়ে সরকারি কৌঁসুলির মতের গুরুত্ব কতখানি হওয়া উচিত, মহামান্য আদালত সেই বিচার করিবে।