Freedom of Expression

সদাই মরে ত্রাসে

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২১ ০৮:০৭

তামিলনাড়ুতে একটি বামপন্থী রাজনৈতিক দলের এক কর্মকর্তা যখন ফেসবুকে সপরিবার ভ্রমণের চিত্রাবলি প্রচার করিয়াছিলেন এবং সেখানে ঈষৎ কৌতুক সহকারে লিখিয়াছিলেন: ‘শুটিং অনুশীলনের জন্য সিরুমালাই সফর’, তখন তিনি ও তাঁহার স্বজনবন্ধুরা সম্ভবত স্বপ্নেও ভাবেন নাই যে, এই বার্তার জন্য তাঁহাকে পুলিশে ছুঁইতে পারে। কিন্তু বাস্তব অধুনা দুঃস্বপ্ন অপেক্ষা ভীতিপ্রদ। এই বার্তাটির জন্য তাঁহার বিরুদ্ধে পুলিশে এফআইআর করা হয়। ভারতীয় দণ্ডবিধির একাধিক ধারায় আনীত অভিযোগমালার সার কথা: তিনি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার ষড়যন্ত্র করিতেছিলেন। ‘শুটিং’-এর কথা যখন তিনি লিখিয়াছেন, তখন তো যুদ্ধঘোষণার অভিসন্ধি লইয়া আর কোনও সন্দেহই থাকে না! পুলিশের চাকুরি করিতে কৌতুকরস আবশ্যক নহে বটে, তবে কাণ্ডজ্ঞান থাকা দরকার বলিয়াই মনে হয়। অথচ তাহাদের আচরণে প্রায়শই সেই বস্তুটির বিস্ময়কর ঘাটতি প্রকট হইয়া উঠে। হয়তো বা সমস্যা কাণ্ডজ্ঞানের নহে, পুলিশের উপর চাপ থাকে, কেহ রাজনৈতিক প্রভুদের বিরাগভাজন কাজ করিলে পুলিশ সম্পূর্ণ অকারণে তাহাকে থানায় ডাকিয়া, হাজতে পুরিয়া বা অন্য ভাবে হেনস্থা করিয়া থাকে, কারণ তাহার উপর তেমন নির্দেশ আছে। আবার অনেক সময়েই পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত ক্ষমতা প্রদর্শনের তাগিদে নিজেই অতিসক্রিয় হইয়া উঠে। তামিলনাড়ু হইতে উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত হইতে পশ্চিমবঙ্গ, রাজ্যে রাজ্যে ইহাই গণতান্ত্রিক ভারতের অভিজ্ঞান।

মাদ্রাজ হাই কোর্টের মাননীয় বিচারপতি জি আর রামস্বামীকে কৃতজ্ঞ অভিবাদন জানাইতে হয়, কারণ ওই অভিযুক্ত নাগরিকের আবেদনের ভিত্তিতে তাঁহার বিরুদ্ধে দাখিল করা অবান্তর এবং উদ্ভট এফআইআরটি বিচারপতি রামস্বামী পত্রপাঠ খারিজ করিয়া দিয়াছেন এবং পুলিশকে তীব্র ব্যঙ্গের সহিত তিরস্কার করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন, দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রাণী অতি-পবিত্র বলিয়া গণ্য হয়, তাহাদের নামে কেহ কোনও রঙ্গকৌতুক করিলে প্রবল প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। কিন্তু একটি বিষয় আছে, যাহা সারা দেশেই অতি-পবিত্র, তাহার নাম জাতীয় নিরাপত্তা, এই বিষয়টি লইয়া আসমুদ্রহিমাচল কোথায়ও কেহ কোনও রসিকতা করিলেই মহাভারত অশুদ্ধ হইয়া যায়, শাস্তির খড়্গ নামিয়া আসে। এই প্রসঙ্গেই তাঁহার বক্তব্য, কৌতুক একটি জরুরি বস্তু। রঙ্গচ্ছলে তিনি কৌতুকের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসাবে সংযোজিত করিবার কথাও তুলিয়াছেন। এবং, তাহার পাশাপাশি বলিয়াছেন, হাসিবার কথায় হাসাও একটি দায়িত্ববিশেষ, কৌতুক-বিশারদরা তাঁহার জায়গায় থাকিলে হয়তো সংবিধানে মৌলিক কর্তব্যের তালিকায় হাসিবার কাজটিকে সংযোজন করিতে বলিতেন। স্পষ্টতই, পুলিশের নির্বোধ অতিসক্রিয়তায় বিচারপতি অত্যন্ত বিরক্ত।

Advertisement

বিরক্তি স্বাভাবিক ও সঙ্গত। যত দিন যাইতেছে, রাষ্ট্রযন্ত্রের চালক ও যন্ত্রীদের আচরণে সুস্থ স্বাভাবিক রসবোধের স্থানে বিভিন্ন ধরনের অসহিষ্ণুতার প্রকোপ ভয়ানক ভাবে বাড়িয়া চলিয়াছে। শুধু জাতীয় নিরাপত্তা লইয়া বাড়াবাড়ি নহে, প্রায়শই দেখা যায় যে ক্ষমতার আসনে যাঁহারা অধিষ্ঠিত তাঁহারা যে কোনও ধরনের সমালোচনা, অভিযোগ, এমনকি প্রশ্নও সহ্য করিতে পারেন না, ফলে তাঁহাদের সম্পর্কে কেহ কৌতুকের ছলে কিছু বলিলেও ন্যায়দণ্ড অন্যায়দণ্ড হইয়া নামিয়া আসে। সাম্প্রতিক কালে কৌতুক করিবার দায়ে কত জনকে যে রাষ্ট্রের কোপে পড়িতে হইয়াছে তাহার ইয়ত্তা নাই। অথচ রাষ্ট্রের অন্যায় লইয়া, ক্ষমতাবানের ত্রুটিবিচ্যুতি লইয়া রঙ্গব্যঙ্গ একটি সচল সজীব গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান চরিত্রলক্ষণ। তেমন কৌতুকের অজস্র নমুনা ইতিহাসে আছে, তেমন বহু নমুনা উৎকৃষ্ট এবং জনপ্রিয় শিল্পকৃতি হিসাবে বন্দিত হইয়াছে, ব্রিটিশ প্রশাসনকে লইয়া ‘ইয়েস মিনিস্টার’ এবং ‘ইয়েস প্রাইম মিনিস্টার’ ধারাবাহিক তাহার দৃষ্টান্ত। এই দেশেও সেই সুস্থ ধারাটি প্রবাহিত ছিল, ক্ষমতাবানেরাও তাহার কদর করিতে জানিতেন, প্রধানমন্ত্রী নেহরু নাকি প্রসিদ্ধ ব্যঙ্গচিত্রকারকে অনুযোগের সুরে বলিয়াছিলেন, সেই শিল্পী তাঁহাকে যথেষ্ট মাত্রায় নিশানা করেন না কেন! কী কেন্দ্রে, কী রাজ্যে, বর্তমান নায়কনায়িকারা এই সহজ কৌতুকবোধটিই হারাইয়া ফেলিয়াছেন, ব্যঙ্গচিত্র দেখিলে বা কৌতুকনাট্য শুনিলে তাঁহারা কুপিত হন, তিরস্কার করেন, কখনও বা পেয়াদা পাঠাইয়া দেন। নিজেদের লইয়া কি এই শাসকদের যথেষ্ট প্রত্যয় নাই? না কি, তাঁহারা রামগরুড়ের গোত্র, রসবোধবিহীন?

যৎকিঞ্চিৎ

সোভিয়েট আমলে নাকি ট্যাক্সি চালিয়ে, কুড়িয়ে-বাড়িয়ে দিন কাটত ভ্লাদিমির পুতিনের। মনে পড়ে, কংগ্রেস আমলে চা বিক্রি করে পেট চালাতেন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। উপলবন্ধুর পথে হেঁটেও যে রাষ্ট্রনায়ক হওয়া যায়, কেবল তা-ই নয়, দেখেশুনে মনে হতে পারে, বন্ধুরতার এমত ইতিহাস ছাড়া রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার মানেই বা কী। বলা বাহুল্য, ইতিহাস বই এই সব গল্প চেপে রাখে, ছাপে না। এ বার চাই নতুন ইতিহাস— ভোলগা থেকে গঙ্গা।

আরও পড়ুন
Advertisement