ফাইল চিত্র।
উত্তরবঙ্গে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার আঘাত বিপর্যস্ত করিয়াছে রাজ্যবাসীকে। শোকের বিহ্বলতাকে ভেদ করিয়া উঠিয়াছে তীক্ষ্ণ প্রশ্ন, কী করিয়া এমন ঘটিতে পারিল? প্রতিটি রেল দুর্ঘটনার পরে রেলের সুরক্ষা পরিকাঠামোর দুরবস্থা লইয়া শোরগোল উঠে, দ্রুত মেরামত ও সংস্কার করিবার অঙ্গীকার করে সরকার। অতঃপর একই কারণে একই ধরনের দুর্ঘটনা এবং প্রাণক্ষয়। বিকানের-গুয়াহাটি এক্সপ্রেস ট্রেনটি লাইনচ্যুত হইবার কোনও নিশ্চিত ব্যাখ্যা এখনও মেলে নাই। চালক বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের অভিযোগ করিয়াছেন, বিশেষজ্ঞরা ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশে গলদ খুঁজিয়া পাইয়াছেন, আবার অতি পুরাতন, বাতিলযোগ্য কোচ ব্যবহারের ফলেও প্রাণহানি বাড়িয়াছে, এমন তথ্যও সংবাদে আসিয়াছে। ইহার প্রত্যেকটিই উদ্বেগজনক। কারণ, তাহার প্রতিটি সেই পুরাতন সমস্যার দিকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করে, যাহার জন্য ভারতে পরপর ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা ঘটিয়া চলে—রক্ষণাবেক্ষণে ত্রুটি। ইঞ্জিনের অবস্থা যদি এতই খারাপ হইবে যে তাহার যন্ত্রাংশ, ট্র্যাকশন মোটর, খুলিয়া পড়িয়া যাইতে পারে, তাহা হইলে তেমন ইঞ্জিন-সহ ট্রেন চলিল কী প্রকারে? আর চলন্ত ট্রেনে যান্ত্রিক ত্রুটি সম্পর্কে চালককে অবহিত করিবার কোনও প্রযুক্তিই কি ভারতীয় রেলের নাই, না কি ওই ট্রেনে তাহা কাজ করে নাই? পুরাতন আইসিএফ কোচগুলি দুর্ঘটনাপ্রবণ, বাতিলযোগ্য, তাহা অজানা নহে। ছুটন্ত ট্রেন লাইনচ্যুত হইলে এই কামরাগুলি একের ভিতরে অপর একটি ঢুকিয়া যাইবার প্রবণতা থাকে বলিয়া প্রচুর প্রাণক্ষয় অতীতে হইয়াছে। তবু পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের বেশ কিছু ট্রেনে এই কামরাগুলি নিয়মিত ব্যবহৃত হয়। ট্রেনের চালক আর এক পা অগ্রসর হইয়া বলিয়াছেন, রেললাইনের ত্রুটির জন্যই লাইনচ্যুতি হইয়া থাকিতে পারে।
অতীতের অভিজ্ঞতা হইতে আশঙ্কা হয়, এমন নানা সম্ভাবনার আঁচড় কাটিয়া এই ট্রেন দুর্ঘটনাটিও বিস্মৃতির অন্ধকারে অচিরে মিলাইয়া যাইবে। কাহার ত্রুটি বা অবহেলার জন্য এত বড় দুর্ঘটনা ঘটিল, অভিযুক্ত ব্যক্তি বা বিভাগের কী শাস্তি হইল, এবং ভবিষ্যতে এমন সঙ্কট নিবারণে কী করিবার অঙ্গীকার লইল ভারতীয় রেল, এই সকল প্রশ্নের উত্তর ইতিপূর্বের ভয়ঙ্কর রেল দুর্ঘটনার পরেও মেলে নাই, এই বারেও মিলিবে না। বিবেক দেবরায় এবং কিশোর দেশাই ২০১২-১৬ সালের রেল দুর্ঘটনাগুলি বিশ্লেষণ করিয়া তাঁহারা জানাইয়াছিলেন, ইঞ্জিনিয়ারদের ত্রুটিতে চুয়াল্লিশটি লাইনচ্যুতি ঘটিয়াছে। আক্ষেপ, কোনও উচ্চপদস্থ রেলকর্তাকে দুর্ঘটনার দায় লইয়া পদত্যাগ করিতে দেখা যায় নাই।
রেল বিষয়ক স্থায়ী সংসদীয় কমিটিও তাহার দ্বাদশ রিপোর্টে (২০১৬-১৭) রেলকর্মীদের গাফিলতি, দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণ, চটজলদি কাজ এবং সুরক্ষাবিধির অবজ্ঞার প্রতিবিধানে ব্যবস্থা করিবার সুপারিশ করিয়াছিল। তাহার কোনওটি কার্যকর হইয়াছে কি? রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব স্বয়ং ঘটনাস্থলে আসিয়া ভগ্ন রেল ইঞ্জিন পরীক্ষা করিয়াছেন। সুসংবাদ, কিন্তু তাঁহার পূর্বসূরিরা নানা সময়ে সংসদে রেল দুর্ঘটনা নিবারণে যে কার্যসূচির তালিকা পেশ করিয়াছিলেন সেগুলির কী হইল, তাহা জানা আরও জরুরি প্রয়োজন। ২০২০ সালের লকডাউন পরিস্থিতিতেও প্রতি দিন গড়ে বত্রিশ জন রেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাইয়াছেন। যথাসময়ে যথাযোগ্য উত্তর মিলিলে বহু প্রাণ বাঁচিত।