Children

কুকথার স্রোত

শিশুমন কাগজের মতো। এই নিষ্কলুষ পৃষ্ঠাটিতে পারস্পরিক অশ্রদ্ধা, ঘৃণা, হিংসার অনুপ্রবেশ ঘটানো হলে তার রেশ সারা জীবন থেকে যায়। সেই কারণে শিশুকাল থেকেই সু-আচরণ শিক্ষার উপর এত গুরুত্ব দান করা হয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২৪ ০৪:২৫

সাধারণ কথোপকথনের মধ্যে অশ্লীল লিঙ্গবৈষম্যমূলক শব্দের প্রয়োগ যে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা ইতিপূর্বে বহু আলোচিত। আরও উদ্বেগ, বর্তমানে সেই প্রবণতা অপ্রাপ্তবয়স্কদেরও ছুঁয়ে ফেলেছে। শুধুমাত্র কুকথা বৃদ্ধিই নয়, এই অস্থির সময় এবং নারীবিদ্বেষের বাতাবরণের মধ্যে শিশুরা নিজেদের অজানতেই যে হিংসাসূচক আপত্তিকর শব্দগুলি ব্যবহার করছে, তা মেয়েদের প্রতি হিংসাকে এক রকম স্বাভাবিকত্ব দান করে, এই তথ্যটি আশঙ্কা জাগায়। সেই কারণেই এই প্রবণতাকে অঙ্কুরে বিনাশ করা প্রয়োজন। শিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংস্থা সম্প্রতি এই বিষয়ে খানিক দিশা দেখাতে উদ্যোগী হয়েছে। তারা শিশুদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে, যাতে তারা তাদের কথোপকথনের মধ্যে হুমকি বা লিঙ্গভিত্তিক হিংসাসূচক শব্দগুলি বর্জন করতে পারে।

Advertisement

শিশুমন কাগজের মতো। এই নিষ্কলুষ পৃষ্ঠাটিতে পারস্পরিক অশ্রদ্ধা, ঘৃণা, হিংসার অনুপ্রবেশ ঘটানো হলে তার রেশ সারা জীবন থেকে যায়। সেই কারণে শিশুকাল থেকেই সু-আচরণ শিক্ষার উপর এত গুরুত্ব দান করা হয়। অথচ, বর্তমান সামাজিক জীবন তার সেই সু-আচরণ শিক্ষার পথে বাধাস্বরূপ। সাম্প্রতিক কালে নারীর প্রতি বিদ্বেষ, হিংসার প্রদর্শন দৈনন্দিনতায় পর্যবসিত। শিশুমন সু-আচরণের শিক্ষা পাবে কোথা থেকে? যে কটুবাক্য, অশ্লীল শব্দের প্রয়োগ সে করে, তা প্রতিনিয়ত তার চার পাশেই উচ্চারিত হয়। ফলত সে এর মধ্যে অ-স্বাভাবিকতা খুঁজে পায় না। অন্য দিকে, অশ্লীল শব্দের প্রয়োগ এবং পৌরুষকে সমার্থক করে তোলার এক উৎকট প্রয়াস সমাজের মধ্যে ক্রমবর্ধমান। নিজেকে যথেষ্ট ‘পুরুষ’ প্রতিপন্ন করতে হলে তুলনায় দুর্বলতরদের, বিশেষত মেয়েদের প্রতি অসম্মানসূচক শব্দপ্রয়োগে যে কোনও অন্যায় নেই— এই ধারণা সমাজের এক বৃহৎ অংশে জাঁকিয়ে বসেছে। প্রায় সমস্ত অশ্লীল শব্দের মধ্যেই নির্ভুল ভাবে মেয়েদের পণ্য করে তোলা বা তাদের অবস্থানটিকে অনেক নীচে দেখানোর এক উদগ্র প্রয়াস লক্ষ করা যায়। এবং এই ক্ষেত্রে প্রান্তিক থেকে সচ্ছল শ্রেণি— প্রায় কোনও প্রভেদই নেই। স্বাভাবিক ভাবেই কটুভাষ্য প্রয়োগের ক্ষেত্রেও সেই বিভেদরেখাটি কালক্রমে মুছে গিয়েছে। বরং যারা সেই ‘প্রচলিত’ পথে হাঁটে না, লিঙ্গ, ধর্ম, জাত, আর্থিক অবস্থান নির্বিশেষে ‘অপর’কে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে, অন্যকে তাচ্ছিল্য করে আত্মসুখ অর্জন করতে চায় না, ধরে নেওয়া হয় তারা যথার্থ ‘পৌরুষ’-এর অধিকারী নয়, অতএব উপহাসের পাত্র।

এই প্রবণতাকে হ্রাস করতে হলে নারী-পুরুষের সমানাধিকার তত্ত্বটিকে শৈশবকাল থেকেই মনে গেঁথে দিতে হবে। অপ্রাপ্তবয়স্কদের উপযোগী আলোচনা চক্র, কর্মশালা প্রভৃতির মাধ্যমে বোঝাতে হবে সামাজিক বিন্যাসে নারীর স্থান পুরুষের নীচে নয়, বরং উভয়েই সহযোদ্ধা মাত্র। একই কথা প্রযোজ্য জাত, ধর্ম, ভিন্ন আর্থিক অবস্থানের ক্ষেত্রেও। একটাই পরিচয়— তারা মানুষ। অতএব সমান সম্মান পাওয়ার অধিকারী। একই সঙ্গে বিদ্যালয় শিক্ষকদেরও শব্দচয়নের ক্ষেত্রে সাবধানি হতে হবে। ব্যক্তিগত মত যা-ই থাক না কেন, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর সামনে তিনি এক আদর্শ শিক্ষকের ভূমিকা পালন করবেন, এমনটাই কাম্য। সমাজের হিংসা ক্রমবর্ধমান। এমতাবস্থায় শুধুমাত্র আইন নয়, শিক্ষিত, সচেতন পরবর্তী প্রজন্মই হয়ে উঠতে পারে আলোর দিশারি।

আরও পড়ুন
Advertisement