Terrible future

ভয়াবহ ভবিষ্যৎ

সমীক্ষার মূল প্রতিপাদ্য: দুনিয়ার এক বিপুলসংখ্যক শিশুর জীবনে এই এক বছরে নেমে এসেছে অকল্পনীয় বিপর্যয়। বিপর্যয়ের প্রধান কারণ যুদ্ধ বা যুদ্ধপ্রতিম হিংস্র সংঘর্ষ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ ০৫:৩৫

বর্ষশেষের কোলাহলে ২০২৪ সালের অনেক ভয়ঙ্কর খতিয়ানই জনচিত্তে কল্কে পায়নি। তেমনই একটি সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল বিগত বছরের শেষ সপ্তাহে। প্রকাশক রাষ্ট্রপুঞ্জের সংস্থা ইউনিসেফ। সেই সমীক্ষার মূল প্রতিপাদ্য: দুনিয়ার এক বিপুলসংখ্যক শিশুর জীবনে এই এক বছরে নেমে এসেছে অকল্পনীয় বিপর্যয়। বিপর্যয়ের প্রধান কারণ যুদ্ধ বা যুদ্ধপ্রতিম হিংস্র সংঘর্ষ। কেবল দুর্ভাগা প্যালেস্টাইনে এবং ইউক্রেনে নয়, বিশ্বের নানা অঞ্চলে নানা ধরনের সংঘাতের শিকার হয়েছেন যে অগণন নাগরিক, তাঁদের একটি বিরাট অংশ শিশু। তবে শুধু যুদ্ধ নয়, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রকৃতি-পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতির ফলে এবং অন্য নানা কারণে দুর্ভিক্ষ, উচ্ছেদ ইত্যাদি সঙ্কট এবং তীব্র থেকে তীব্রতর দারিদ্র। সব মিলিয়ে হাজার-হাজার শিশু হতাহত, লক্ষ-লক্ষ দেশছাড়া অথবা ঘরছাড়া, কোটি-কোটি অন্নহীন বস্ত্রহীন আচ্ছাদনহীন নরকে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। শিক্ষার সুযোগ দূরস্থান, জীবনের ন্যূনতম সংসাধন এবং নিরাপত্তাও তাদের কাছে বিলাসিতা। একটি হিসাবে, প্রায় এক-পঞ্চমাংশ, সংখ্যার হিসাবে ৫০ কোটি শিশু কোনও না কোনও ভাবে বিপন্ন।

Advertisement

বলা নিষ্প্রয়োজন, এই বিপদ ২০২৪ সালে শুরু হয়নি, শেষও হয়নি। মহাযুদ্ধের পর থেকে কোনও একটি বছরে এত শিশু এতটা সঙ্কটে পড়েনি, সেই হিসাবে গত বছরটি ঐতিহাসিক বটে, কিন্তু নবাগত বর্ষটিতে সেই রেকর্ড যে ভেঙে যাবে না, তার কিছুমাত্র ভরসা নেই। যে বিপর্যয় শিশুদের জীবনে নমে এসেছে, তার প্রকোপ চলতি বছরে আরও বেড়ে যেতে পারে। সেই আশঙ্কা অতিমাত্রায় প্রবল। তবে এক অর্থে সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণটি বোধ হয় নিহিত আছে ইউনিসেফের কর্ণধারদের একটি উক্তিতেই। তাঁরা বলেছেন, শিশুদের এমন অস্বাভাবিক মাত্রার বিপন্নতাকে ক্রমশ ‘স্বাভাবিক’ বলে মেনে নিতে দেওয়া চলে না। স্পষ্টতই, ভয়াবহ বাস্তবকে ক্রমশ স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া হচ্ছে, তা না হলে এই উক্তির কোনও প্রয়োজন হত না। মেনে নেওয়ার পিছনে একটি বড় কারণ অবশ্যই বিশ্ব জুড়ে সঙ্কীর্ণ স্বার্থের দাপট। যে-হেতু মার খাচ্ছে প্রধানত দরিদ্র বা যুদ্ধপীড়িত ভূখণ্ডের শিশুরা (এবং বড়রা), সুতরাং অবশিষ্ট দুনিয়ার নাগরিকরা, বিশেষত উন্নত দুনিয়ার সম্পন্ন ও ক্ষমতাবান নাগরিকরা এই বিষয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ দূরে থাকুক, বিশেষ কোনও আগ্রহও বোধ করেন না। অর্থাৎ, দুর্ভাগা শিশুদের জীবনে যত বড় বিপর্যয়ই নেমে আসুক, যাঁরা সেই দুর্ভাগ্যের শিকার নন তাঁরা উদাসীন থেকে যান। গত কয়েক দশকে বিশ্বব্যাপী আর্থিক ও সামাজিক অসাম্যের অভূতপূর্ব বৃদ্ধি এই সমস্যাকে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে।

কেবল আজকের সমস্যা নয়, গভীর সমস্যায় আকীর্ণ হচ্ছে আগামী প্রজন্মগুলি। শিশুরাই দেশের ভবিষ্যৎ— এই কথাটি বহুব্যবহারে জীর্ণ হয়েছে। কিন্তু কথাটির প্রকৃত অর্থ সুদূরপ্রসারী। দেশে-দেশে শিশুদের এক বিরাট অংশ যদি পুষ্টিহীন স্বাস্থ্যহীন শিক্ষাহীন এবং সমস্ত রকমের নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত জীবন কাটাতে বাধ্য হয়, তবে কেবল তাদের ভবিষ্যৎই অন্ধকার নয়, সেই অন্ধকার সমাজকেও গ্রাস করতে বাধ্য। বিশ্বায়িত পৃথিবীতে সেই সমাজের পরিধি দেশ বা অঞ্চলের গণ্ডিতে পুরোপুরি আবদ্ধ থাকবে না, সেই সত্যও সুস্পষ্ট। বস্তুত, কোটি-কোটি শিশুর এই বিপন্নতা এবং অনিশ্চয়তা বিশ্বের এক বিরাট অংশে অস্থিরতা ও অশান্তির পরিবেশকে আরও জটিল করে তুলবে, সংঘাত ও সংঘর্ষ আরও বেশি উত্তেজিত হবে। অবশ্যই তার ফলে আরও বহু শিশুর জীবন বিপন্ন ও বিপর্যস্ত হবে। অর্থাৎ, এ এক ভয়াবহ দুষ্টচক্র। এই সঙ্কটের কোনও সহজ সমাধান নেই, সে কথা নিতান্তই সহজবোধ্য। কিন্তু এই পৃথিবীকে শিশুদের বাসযোগ্য করে তোলার লক্ষ্যে সত্যকারের আন্তর্জাতিক উদ্যোগ এখনই শুরু না করলে শেষ অবধি কেউই নিরাপদ থাকতে পারে না। ইউনিসেফের সমীক্ষা সেই সত্যই জানিয়ে দিচ্ছে।

Advertisement
আরও পড়ুন