কোভিড-ধ্বস্ত বিশ্ব সবেমাত্র ঘুরিয়া দাঁড়াইবার তোড়জোড় করিতেছিল। ঠিক তখনই রঙ্গমঞ্চে ওমিক্রনের অনুপ্রবেশ এবং ছন্দপতন। এই অতি সংক্রামক ভ্যারিয়্যান্টটিতে আক্রান্ত দেশের সংখ্যা ৯০ অতিক্রম করিয়াছে। টিকার দুইটি ডোজ় লইবার পরও ব্রিটেনে দৈনিক সংক্রমিতের সংখ্যা রেকর্ড গড়িয়াছে। ভাল নাই আমেরিকাও। নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সি, ওয়াশিংটনে করোনা-আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৯০ শতাংশের অধিক ওমিক্রনে আক্রান্ত। অতঃপর, ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে ফিরিতেছে লকডাউনের ন্যায় কড়াকড়ি। ইউরোপের একাধিক দেশ বড়দিনের উৎসবে লাগাম পরাইয়াছে। বিদেশযাত্রায় আরোপিত হইয়াছে বিবিধ নিয়ম, নিষেধাজ্ঞা।
ইহা শুধুই তথ্য-পরিসংখ্যান নহে। ইহার মধ্যে নিহিত আছে ভারতের জন্য এক জরুরি সতর্কবার্তা— দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা হ্রাস পাইয়াছে বলিয়া উল্লাস করিবার সময় ইহা নহে। ভারতে ওমিক্রন আক্রান্তের সংখ্যা ইতিমধ্যেই দুইশতের গণ্ডি ছাড়াইয়াছে। ডেল্টার অভিজ্ঞতা বলিতেছে, সংক্রমণের ক্ষেত্রে ইহার পরবর্তী লম্ফনে সময় খুব সামান্যই লাগে। এবং, ওমিক্রনের সংক্রমণ ক্ষমতা ডেল্টার তুলনায় অন্তত তিন গুণ অধিক। অর্থাৎ, এখনই প্রস্তুত হইতে হইবে। ভারত কি আদৌ সেই প্রস্তুতি লইতেছে? শুধুমাত্র রাজ্যগুলিকে সতর্ক করা আর নিয়মবিধি পালনে জোর দিয়া কর্তব্য শেষ করিলেই চলিবে না। স্বাস্থ্যকর্মী এবং যাঁহাদের ঝুঁকি বেশি, তাঁহাদের বুস্টার ডোজ় দিবার কী ব্যবস্থা হইল? ইজ়রায়েল, ব্রিটেন সেই পথে হাঁটিয়াছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ হইতেও বুস্টার ডোজ়ের প্রয়োজনীয়তার কথা বারংবার বলা হইয়াছে। অথচ, ভারতে তাহা ঘোর তমসাচ্ছন্ন। দেশে এখনও সকলের টিকার দুইটি ডোজ়ই নিশ্চিত করা যায় নাই। শিশুদের টিকা লইয়া অস্পষ্টতাও কাটে নাই। দেশে প্রায় সর্বত্র স্কুল-কলেজ খুলিয়াছে। এমতাবস্থায় একটিও টিকা না পাওয়া শিশুদের বিপদ সম্পর্কে কি সরকার এখনও যথেষ্ট সচেতন নহে? ব্রিটেনও সম্প্রতি ৫ হইতে ১১ বৎসরের শিশুদের টিকার অনুমোদন দিয়াছে। ভারত কেন পারিতেছে না, জানিবার অধিকার নিশ্চয়ই নাগরিকের আছে।
এবং নাগরিককে নিজ দায়িত্ব সম্পর্কেও সচেতন হইতে হইবে। সেই সচেতনতা, দুর্ভাগ্যবশত, প্রায় উধাও। ওমিক্রনে গুরুতর অসুস্থ হইবার সম্ভাবনা নাই— এ-হেন এক ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হইয়া নাগরিকদের একাংশ ন্যূনতম কোভিডবিধিও মানিতেছেন না। বিশেষত, পুরভোট-পরবর্তী কলিকাতায় যে দৃশ্যগুলি দেখা গেল, তাহা আতঙ্ক জাগায়। বিধানসভা ভোটের পর রাজ্যে কী হইয়াছিল, স্পষ্টতই কলিকাতাবাসী তাহা ভুলিয়াছেন। বিস্মরণ ক্ষেত্রবিশেষে ভাল। কিন্তু যে বিস্মরণ ধ্বংস ডাকিয়া আনে, তাহা পরিত্যাগ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। অথচ, রাজ্য সরকারও সেই বিস্মরণের পথ ধরিয়াছে। কর্নাটক, দিল্লি উৎসব মরসুমে জমায়েত নিষিদ্ধ করিয়াছে। অথচ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার নৈশ কড়াকড়িটুকুও উৎসব-কালে তুলিয়া লইল। ওমিক্রনের মারণক্ষমতা কত বেশি, ভারতীয় টিকা তাহার সঙ্গে লড়িতে পারিবে কি না, তাহা ভবিষ্যৎ বলিবে। আপাতত বিদেশ হইতে শিক্ষা লইয়া কঠোর ভাবে কোভিডবিধি পালন জরুরি। সরকার, নাগরিক— উভয়কেই সেই পথে হাঁটিতে হইবে। অবিলম্বে।