Samaresh Basu

সম্পাদক সমীপেষু: দূরদর্শী কলমচারী

নদীমাতৃক মানবজীবনের কথা পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, এত উপাদান জানতে গিয়ে এই সব বিস্তৃত জায়গার কত গভীরে যেতে হয়, কত মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়েছে, কত সময় দিতে হয়েছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৮:৪৭

তিলোত্তমা মজুমদারের লেখা ‘এক কলমে সমরেশ, আর একটিতে কালকূট’ (রবিবাসরীয়, ১-১২) প্রবন্ধ পড়ে মনে এল জন্মনাম সুরথনাথ বসুর আরও একটি ছদ্মনাম ‘ভ্রমর’। সমরেশ বসু, কালকূট ও ভ্রমর নামে লেখা তাঁর মোট উপন্যাসের সংখ্যা দেড়শোরও বেশি। এ ছাড়া গল্পগ্রন্থের সংখ্যাও অনেকগুলি— বহুপ্রজ লেখক তিনি। আঞ্চলিক ইতিহাসে চন্দননগর বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে পেলাম সমরেশ বসুর একটি উপন্যাসের কথা, নাম জগদ্দল। সেখানে নদীমাতৃক মানবজীবনের কথা পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, এত উপাদান জানতে গিয়ে এই সব বিস্তৃত জায়গার কত গভীরে যেতে হয়, কত মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়েছে, কত সময় দিতে হয়েছে। সমরেশ বসু সংসার করেছেন কখন, ঘুরেছেন কখন, আর লিখেছেনই বা কখন! দেশ-এ (২-১২-২৪) পড়লাম, অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্ত্রী লীলা রায় এক বার সমরেশ বসুকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তুমি কেন লেখো?’— সমরেশ বিব্রত ভাবে বলেছিলেন, ‘জানবার জন্যই লিখি।’ অসাধারণ এই অকপট স্বীকারোক্তি। যে কোনও লেখককে কোনও বস্তুনিষ্ঠ উপন্যাস লিখতে গেলে অনেক কিছু জানতে হয়। ‘কী জানবার জন্য?’— স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্নের পিঠে এসেছিল এই প্রশ্ন। সমরেশ বসু তখন একটুও না ভেবে উত্তর দিয়েছিলেন, মানুষকে জানবার জন্য।

Advertisement

জগদ্দল-এ আছে বিস্তর প্রান্তিক চরিত্র। উনিশ শতকে শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠার প্রাক্কালে জমিদার, কায়স্থ, নায়েব, কর্তা, সাহেব, মিস্ত্রি-সহ রকমারি চরিত্রের শ্রেণিসংগ্রাম উঠে এসেছে। ফলে, সমাজবিজ্ঞানেরও চর্চা হয়ে যায়। আমার মনে হচ্ছিল যেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহেশ’ গল্পের পরের পর্বে আসছে এই জগদ্দল, যেখানে গফুরের মতোই প্রান্তিক চরিত্ররা কাশীপুরের মতো গ্রামাঞ্চল থেকে এসে ফুলবেড়ের মতো হুগলি বা গঙ্গার পাড়ে মিল, কলকারখানায় নতুন জীবন শুরু করেছেন। জগদ্দল-এর উপসংহারে আছে হুগলি নদীর দুই তীরে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক সাহেবদের মধ্যে শিল্পপুঁজি বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হওয়ার কথা। “নতুন মিল, অনেক মিল; আর কোম্পানি মিছিল করে আসছে। আর মিছিলের সঙ্গে মিছিলের সংঘর্ষ, তাদের বিবাদের পালাও শুরু হয়েছে।” দূরদর্শী অনুজ কথাশিল্পী সমরেশ বসু অগ্রজ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো আঞ্চলিক ইতিহাসে আগামী পর্বের আভাস দিলেন। তাঁর ‘কলম’-এর দর্শন অসামান্য।

শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি

মানুষরতন

তিলোত্তমা মজুমদারের ‘এক কলমে সমরেশ, আর একটিতে কালকূট’ শীর্ষক প্রবন্ধ মনে করায়, ব্যক্তিগত জীবনেও সমরেশ বসুকে নানা সমস্যা, সঙ্কট-বিড়ম্বনার অভিঘাতে ঢাকা ও নৈহাটির মধ্যে আনাগোনা করতে হয়েছে। তাঁর প্রথাবদ্ধ পড়াশোনা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত, তাও আবার নৈহাটির মহেন্দ্র স্কুলের ক্লাস এইটের রেজ়াল্টে রয়েছে ‘নট প্রোমোটেড’। উপার্জনহীন আঠারো বছরের তরুণ সমরেশ যোগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের বিবাহবিচ্ছিন্না মেয়ে গৌরীকে বিয়ে করেন বাড়ির অমতে। এর পর চলে ক্যান্টিনে, দোকানে ডিম, মুরগি বিক্রি করে টিকে থাকার প্রাণপাত চেষ্টা। পাশাপাশি চলতে থাকে দেশি বিদেশি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা। মাথায় ঘোরে ফ্রয়েড, এলিস, ইয়ুং-এর যৌনতা সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ। যোগাযোগ ছিল কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে।

সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্পটি সাহিত্য-সমাজকে চমকে দেয়। সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী এই গল্পে সরল নিরীহ নির্বিরোধী মানুষের অসহায়তার মধ্যেও লেখক মহামিলনের কথা শুনিয়েছেন। ‘আদাব’-এর অভিঘাত আজও যেন প্রবল এবং প্রাসঙ্গিক। বিত্তহীনতার প্রেক্ষিতে কৃষক শ্রমিক বা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে কোনও পার্থক্য নেই তার গভীর ভাবময় প্রকাশ ঘটেছে তাঁর ‘আবর্ত’, ‘ন’নম্বর গলি’, ‘সাধ’ প্রভৃতি গল্পে।

আবার প্রেমের অপরূপ রূপমহিমার বৈচিত্রপূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে সমরেশের অনেক গল্পে। সে প্রেমে আছে আকুলতাও, আছে যৌন বিকারের ক্লেদাক্ত ছবি। অবশ্য বিভিন্ন গল্পে তিনি যৌনচেতনাকে জীবনবোধের পরিপূরক হিসাবে রূপায়িত করেছেন দক্ষতার সঙ্গে। সেই সঙ্গে মানবমনের রহস্য-জটিলতা ও জৈবচেতনার বিচিত্র প্রকাশে তাঁর ‘ছেঁড়া তমসুক’, ‘তৃষ্ণা’ প্রভৃতি গল্প আজও স্মরণীয়।

সমাজমনস্ক ও প্রগতিশীল চেতনাসম্পন্ন ঔপন্যাসিক হিসাবেও সমরেশ বসু প্রশংসিত ও অত্যন্ত জনপ্রিয়। উপন্যাস উত্তরঙ্গ-এ শুনিয়েছেন চটকলকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় রূপান্তরের কাহিনি। আবার কলকারখানা-কেন্দ্রিক মানুষের জীবনভাষ্য হয়ে উঠেছে তাঁর বি. টি. রোডের ধারে উপন্যাস। সর্বহারা শ্রমিকজীবনের দারিদ্রলাঞ্ছিত জীবনকথার বাস্তবায়ন এই উপন্যাস। দেশভাগের পটভূমিতে লেখা বাস্তবগ্রাহ্য অত্যন্ত মর্মস্পর্শী দু’টি রচনা হল সুচাঁদের স্বদেশযাত্রা ও বিশ্বাস। এগুলি উদ্বাস্তু মন, শূন্য ও ছন্নছাড়া জীবন নিয়ে লেখা সমরেশের অসাধারণ দু’টি উপন্যাস।

প্রজাপতি-সহ বিবর, পাতক প্রভৃতি উপন্যাসে সমরেশ বসু সমাজের গ্লানি অবক্ষয় ও রুচিহীন কাম-কলুষের রূপায়ণ ঘটিয়েছেন। “প্রবল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও বিচ্ছিন্নতাবোধ, প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধের প্রতি অনির্ভরতা ও পাপ-পুণ্যবোধের অতিশায়ী এক নীতিশূন্যতা” (সংসদ বাংলা সাহিত্যসঙ্গী, সঙ্কলন ও সম্পাদনা, শিশিরকুমার দাশ, সাহিত্য সংসদ, ২০০৩) বিবর-কে বিশিষ্টতা দিয়েছিল। সমকালে নিন্দিত ও প্রবল ভাবে অভিনন্দিত এই উপন্যাস সমরেশ বসুর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা।

নিরন্তর অসহায়তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বার্তা নিয়ে এসেছে সমরেশের মানুষ শক্তির উৎস, মহাকালের রথের ঘোড়া, শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে, শ্রীমতী কাফে, জগদ্দল, পুনর্যাত্রা প্রভৃতি উপন্যাস। মানুষ শক্তির উৎস-এ নায়ক মনে করেছিল যে সশস্ত্র লড়াই আনবে মানুষের মুক্তি, সমাজের মুক্তি। সামাজিক মুক্তি ও মানবিক প্রত্যয়ের কথা আছে শ্রীমতী কাফে উপন্যাসেও। আসলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, মতাদর্শ ও নানা জিজ্ঞাসার প্রতিফলন ঘটেছে এ সব উপন্যাসে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তাঁর আত্মজৈবনিক উপন্যাস যুগ যুগ জীয়ে-র কথা। পাশাপাশি বিষ্ণুপুরের তাঁতিদের নিয়ে তাঁর অসামান্য লেখা টানা-পোড়েন হল নিখুঁত এক বাংলা উপন্যাস। আর মৎস্যজীবী সমাজের অনিশ্চিত জীবন ও অস্তিত্বের লড়াই নিয়ে এসেছে গঙ্গা উপন্যাস।

সমরেশ বসুর লেখকসত্তার আর একটি দিক হল কালকূট ছদ্মনামে লেখা রচনাগুলি। তবে অমৃতকুম্ভের সন্ধানে, কোথায় পাবো তারে প্রভৃতি রচনায় তাঁর মনের মানুষের সন্ধানই মুখ্য হয়ে উঠেছে। জগৎ ও জগজ্জনের মাঝে নিজেকে খোঁজ করার জন্য তাঁর এই কালকূট নামের আড়াল। কালকূটের এ সব পথ চলার আখ্যানের মধ্যে ভারতের সমন্বয় ভাবনাই প্রধান হয়ে উঠেছে। সমরেশ বসু আবার মহাভারতের শাম্ব-কাহিনির নবরূপায়ণ ঘটিয়েছেন তাঁর শাম্ব উপন্যাসে। পুরাণ-ইতিহাস ভেঙে আধুনিক মনের আলোয় গড়া শাম্ব তাঁকে বিশাল পরিচিতি এনে দিয়েছে। লেখকের নিজের ভাষায় “এক বিপন্ন ব্যক্তির উত্তরণকে শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখাতে চেয়েছি, দেখতে চেয়েছি কালের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। (‘লেখকের ভূমিকা’, ১লা বৈশাখ, ১৩৮৫)। আর রামকিঙ্কর-অনুধ্যানে মগ্ন থেকে সমরেশ লিখেছিলেন দেখি নাই ফিরে, যা “বঙ্গ সাহিত্যে এক ধ্রুপদী কীর্তি, দৃষ্টান্তহীন ক্লাসিক জীবনোপন্যাস” (সাগরময় ঘোষ, ভূমিকা, দেখি নাই ফিরে, ১ম সংস্করণ)। প্রাবন্ধিক যথার্থই বলেছেন, লেখক সর্বত্রই খুঁজেছেন ‘মানুষ-রতন’। যা আজ বড্ড প্রয়োজন।

সুদেব মালতিসা, হুগলি

স্ত্রীর কথা

সমরেশ বসুকে নিয়ে তিলোত্তমা মজুমদারের প্রবন্ধে লেখকের জীবনের একটি দিক অনালোকিত থেকে গেল। সমরেশ বসুর সফল লেখক হয়ে ওঠার পিছনে তাঁর স্ত্রীর ভূমিকা বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। লেখকের ছেলে নবকুমার বসু চিরসখা উপন্যাসে বিস্তারিত ভাবে তাঁর বাবার জীবনে মায়ের এই ভূমিকা ফুটিয়ে তুলেছেন। উপন্যাসের মূল চরিত্র যে সমরেশ বসুর আদলে তৈরি তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। চিরসখা তাই আত্মজৈবনিক উপন্যাস। কথায় আছে, প্রতিটি সফল পুরুষের পিছনে এক নারীর ভূমিকা থাকে। লেখক সমরেশ বসুও তার ব্যতিক্রম নন।

শঙ্খমণি গোস্বামী, কলকাতা-১২২

Advertisement
আরও পড়ুন